খুলনা: খুলনা নগরীর অলি-গলি, চায়ের দোকানে একটাই আলোচনার ঝড়। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনিরকে সাময়িক বরখাস্ত করায় তোলপাড় চলছে পুরো নগরীজুড়ে।
সোমবার (০২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর বাগমারা এলাকার রিকশাচালক মোহাম্মদ হাবিব অনেকটা স্বস্তিভরে বলেন, এলাকার রাস্তা-ঘাট ভালো না। বর্ষা হইলেই পানি ওঠে। অথচ মেয়র দুই বছরের বেশি সময়েও এগুলো মেরামত করতে পারেননি। যারে দিয়া কাজ হয় না তারে রাইখা লাভ কি?
একই সুরে এলাকার রিকশাচালক নাসিম বলেন, সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়র থাকা অবস্থায় আমাগো এলাকার রাস্তাঘাট এমন খারাপ ছিলো না। এতো মশাও ছিলো না।
মনি মেয়র হওয়ার পর বাগমারার রাস্তা একবারও মেরামত হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি আশা করেন, মেয়রের চেয়ারে যিনি বসবেন তিনি নগরীর রাস্তাঘাট ঠিক করবেন।
শান্তিধাম মোড় এলাকার কলেজছাত্র রাশেদ বলেন, ময়লা আবর্জনার গন্ধে মানুষ রাস্তায় নামতে পারছেন না। বিউটিফিকেশন নগরীর সড়কদ্বীপে নির্মিত রয়েল চত্বরও জৌলুস হারিয়েছে। সাতরাস্তার মোড়ের সড়কদ্বীপে নির্মিত ভাস্কর্য ছেয়ে গেছে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের প্যানা-ফেস্টুনে। যা শহরকে সৌন্দর্যহানি করেছে। মেয়র এগুলো অপসারণ করতে পারেননি। পারেননি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।
অভিযোগ রয়েছে, মনি মেয়র হওয়ার পর নাগরিক সেবা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন নগরবাসী। যে কারণে কাউন্সিলরদের অধিকাংশও মেয়রের কর্মকাণ্ডে ছিলেন নাখোশ।
সাধারণ নগরবাসীর মতোই খোদ মেয়রের দল বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি অংশ তার বরখাস্তে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। যে কারণে বরখাস্ত ঘোষণার পর বরখাস্তকৃত মেয়রের পক্ষে কোনো বিক্ষোভ বা মিছিলও হয়নি। যদিও তিনি বিএনপির মহানগর সাধারণ সম্পাদক।
বিএনপি কর্মী মিজানুর রহমান বলেন, ভোটের সময় তার জন্য অনেক খেটেছি। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার সঙ্গে দেখা করতে অনুমতি লাগতো।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা কেসিসি আর হাজী মহসিন রোডের মেয়রের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অনেক আগে থেকেই যান না। কারণ একটাই তার দাম্ভিকতা। সাবেক মেয়র শেখ তৈয়েবুর রহমান আর তালুকদার আব্দুল খালেক যখন মেয়র ছিলেন তাদের বাড়িতে সন্ধ্যার পরে নেতাকর্মীদের ঢল নামতো। রাস্তায় গাড়ি, মোটরসাইকেল এতো বেশি থাকতো যে রিকশাচালকরা সন্ধ্যার পরে গগন বাবু রোডের তাদের বাড়ির পথে যেতে রাজি হতেন না। কিন্তু বরখাস্তকৃত মেয়র মনির বাসা হাজী মহসিন রোডে এমনটি কেউ দেখেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা বলেন, মনি মেয়র হয়ে যে চেয়ারটিতে বসেছিলেন সেটা মেয়রের হলেও তাকে বসানোর পেছনে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবদান ছিলো। কিন্তু তিনি কোনো বিএনপি নেতাকর্মীর মূল্যায়ন করেননি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ভোটের সময় যারা লিফলেট আর পোস্টার ভোটারদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছিলেন, মেয়র হওয়ার পর নেতাকর্মীদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ শুকানোর আগেই সব ভুলে গেছেন মনি।
সোমবার (০২ নভেম্বর) দুপুরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. আব্দুর রউফ মিয়া স্বাক্ষরিত এক ফ্যাক্স বার্তায় খুলনা সিটি মেয়র মনিকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে খুলনা থানার দু’টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে ফ্যাক্স বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার পর দুই বছর এক মাস আটদিনের মাথায় তিনি বরখাস্ত হলেন।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোকুল কৃষ্ণ ঘোষ ফ্যাক্স বার্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ফ্যাক্স বার্তায় উল্লেখ করা হয়, কেসিসি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির নামে খুলনা সদর থানায় ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ফৌজদারি মামলা দায়ের হয় (নম্বর-১৯)। গত ৩০ এপ্রিল ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয় (নম্বর-১০৪ ও ১০৪ (ক)। গত বছরের ৪ জানুয়ারি খুলনা সদর থানায় তার নামে অপর একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয় (নম্বর-৫)। গত ৩১ মে ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয় (নম্বর-১৫৯)। স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ (২০০৯-এর ৬০ নং আইন) এর ধারা-১২ এর উপ-ধারা (১) মোতাবেক সিটি কর্পোরেশন মেয়রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করলে তাকে সাময়িক বরখাস্তের বিধান রয়েছে। ওই একই আইনের ১২ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. আব্দুর রউফ মিয়া এ ফ্যাক্স বার্তায় স্বাক্ষর করেন।
২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি বিজয়ী হন। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে নগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও মেয়র মনিরুজ্জামান মনিসহ বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ওই দু’টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।
এদিকে মেয়র মনির বরখাস্তের খবর পেয়ে সোমবার (২ নভেম্বর) বিকেলে কেসিসি ভবনে মেয়রের দফতরে গিয়ে মেয়রকে পাওয়া যায়নি। তিনি দুপুর সাড়ে ৩টায় অফিসে প্রবেশ করে আধা ঘণ্টা পর ৪টায় একটি অনুষ্ঠানে বের হয়ে যান। এরপর বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে ফের অফিসে প্রবেশ করে বরখাস্তের খবর পেয়ে ৫ মিনিট পর ৫টা ২৫ মিনিটে অফিস ত্যাগ করেন বলে তার দফতর সূত্রে জানা গেছে।
মনিরুজ্জামান মনির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়রকে বরখাস্তের বিষয়ে নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৬২ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে মনিরুজ্জামান মনি নির্বাচিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতেই এ বরখাস্তাদেশ। অবিলম্বে বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৫
এমআরএম/এএসআর
** খুলনা সিটির মেয়র মনিরুজ্জামান সাময়িক বরখাস্ত