রোববার (১৪ জুন) জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
শোক প্রস্তাবে বলা হয়, মোহাম্মদ নাসিম ১৩ জুন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলী বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর ২ মাস ১১দিন।
মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল পাবনা জেলায় (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলা) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাতীয় চার নেতার অন্যতম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং মাতা আমেনা মনসুর। তার স্ত্রী লায়লা আরজুমান্দ বানু। তিনি তিন পুত্র সন্তানের জনক।
মোহাম্মদ নাসিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তিনি। রাজনৈতিক কারণে বহুবার কারাবরণ করেছেন।
মোহাম্মদ নাসিম তৃতীয় জাতীয় সংসদ (১৯৮৬), পঞ্চম জাতীয় সংসদ (১৯৯১), সপ্তম জাতীয় সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম জাতীয় সংসদ (২০০১), দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪) এবং একাদশ জাতীয় সংসদ (২০১৮)-এ মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ নাসিম। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। ১৯৯৭ সালের মার্চে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও দেওয়া হয় তাকে।
মোহাম্মদ নাসিম একই সঙ্গে দুইটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত। পরবর্তীতে, মন্ত্রিসভায় রদবদলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
দশম জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাসিম।
একাদশ জাতীয় সংসদে তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাজনীতির সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম সম্পৃক্ত হন ষাটের দশকে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকারের ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পিতা এম মনসুর আলীর সঙ্গে কারাগারে যেতে হয় মোহাম্মদ নাসিমকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে মোহাম্মদ নাসিম যুব সম্পাদক হন। ১৯৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৯ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দেশপ্রেমিক ত্যাগী নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসা মোহাম্মদ নাসিম আজীবন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেলে থাকা অবস্থায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অপর তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পিতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ন্যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জ্বীবিত ও অটল থেকে মোহাম্মদ নাসিম ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে তিনি বার রাজপথে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার, যুদ্ধাপরাধীসহ সব ঘাতকের বিচারের আন্দোলন সংগ্রাম এবং বিচার কার্যকরণ প্রক্রিয়ায় মোহাম্মদ নাসিম সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। দেশের সব অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্র সৈনিক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মোহাম্মদ নাসিম সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ, কাজিপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজসহ সিরাজগঞ্জ জেলায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ভ্রমণ করেছেন। বই পড়া, গান শোনা ছিল তার প্রিয় শখ ছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২০
এসকে/এনটি