ঢাকা : ‘বিদ্যুৎ নিয়ে যত কথা’ শীর্ষক ধোঁকাবাজীর বিজ্ঞাপন বন্ধ করা উচিত। কুইক রেন্টালের পক্ষে সাফাই গাইতে এ ধরণের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করার অধিকার তৌফিক-ই-ইলাহীকে কেউ দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, “বিদ্যুৎ নিয়ে যত কথা” শীর্ষক যে সব বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে সবগুলোতেই প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করা হয়েছে। ”
তিনি জানান, ওই বিজ্ঞপানের পর্ব ৫-এ বলা হয়েছে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২ ধরনের খরচ হয়। একটি অপরেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স (ওএন্ডএম) খরচ অন্যটি হচ্ছে জ্বালানি ব্যয়। রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে যে কোটি কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে তার কোনো হিসেব তারা দেয়নি। “সৎ সাহস থাকলে তারা এ হিসেবটিও তুলে ধরত” বলে মন্তব্য করেছেন পাওয়ার সেলের সাবেক এই মহাপরিচালক।
তিনি জানান, অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকলে তার কোনো খরচ হয়না। কিন্তু রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখলেও তার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় নিয়মিত।
বিজ্ঞাপনটিতে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন হয় গ্যাস দিয়ে। আর সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ডিজেলে। গ্যাস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি খরচ দাঁড়ায় ২.৫০-৩.৫০ টাকা, কয়লা ৪.৫০-৫ টাকা, ফার্নেস অয়েল ১৫-১৬ টাকা, আর ডিজেল ১৭-১৮ টাকা।
এখানে ডিজেলে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো। আর জনসাধারণের অসুবিধার কারণে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব ছিলো না। এছাড়া কয়লা ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ৫-৬ বছর সময় প্রয়োজন।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসাতে ৫-৬ বছর সময় লাগে পিডিবির এ যুক্তি সম্পূর্ণটাই মিথ্যা। তাদের কথা যে মিথ্যা তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে সম্পাদিত ৩টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তির দিকে তাকালেই। এ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রের মধ্যে ২টি ৩৬ মাসে ও একটি ৪৫ মাসে উৎপাদনে আসবে। তাহলে তারা কেন রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে?
এছাড়া কয়লা সংকটের প্রসঙ্গও মেনে নিতে পারছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা দাবি করেছেন, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা বিগত বছরগুলোতে বেশিরভাগ সময় অবিক্রিত পড়েছিলো। কয়লাখনির গত এপ্রিল মাসের রিপোর্টে দেখা গেছে তাদের অবিক্রিত কয়লার মজুদ ছিল ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ১৪২ মেট্রিক টন।
কয়লা মজুদ প্রসঙ্গে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে প্রতি মাসে ৭০- ৮০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করছে। বতর্মানে (৩১ জুলাই) প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে।
কয়লা আমদানি করেও দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয় বলে দাবি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অবিজ্ঞ মহলের প্রশ্ন, তাহলে এখন আমদানি নির্ভর কয়লা দিয়ে এত বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোন আশায় করা হচ্ছে।
সরকারের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (১২৫ মেগাওয়াট) একটি ইউনিট উৎপাদনের বাইরে ছিলো। অথচ সামান্য মেরামত করে এটি চালু করা যেতো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলানিউজকে বলেন, আমি এই ফাঁকিবাজীর বিজ্ঞাপন বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। এভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করতে রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করার এখতিয়ার কারও নেই।
বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৪.০২ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার ও রসিকতা আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, আমি গতমাসে বিল দিয়েছি প্রতি ইউনিট ৮ টাকা দরে। তাহলে তার এই ৪.০২ টাকা প্রচারের অর্থ কি দাঁড়ায়।
সাধারণ মানুষ কত টাকায় বিদ্যুৎ কিনছে সে বিষয়টি বড়। তারা কোন সংস্থাকে কত টাকায় বিদ্যুৎ দিচ্ছে সে বিষয়টি বড় হতে পারে না।
প্রসঙ্গত রেন্টাল (ভাড়া ভিত্তিক) ও কুইক (দ্রুত) রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোকসান কমানো যাচ্ছে না। এ সমালোচনার দায় এখন সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে।
অথচ মানুষ এখনো লোডশেডিংয়ের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি। সংসদে ও দলীয় ফোরামে সংসদ সদস্য ও সরকারি দলের নেতারা বলছেন, বিদ্যুৎ সংকট আগামী নির্বাচনে সরকারি দলের জন্য বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে। এ নিয়ে তারা বেশ উদ্বিগ্নও।
এ অবস্থায় বিজ্ঞাপনদাতার পরিচয় গোপন রেখে সংবাদপত্রে সরকারের ‘রেন্টাল নীতি’ ও লোড শেডিং-এর পক্ষে কৌশলী প্রচারণায় প্রতীয়মান হয়, রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে লাভবান হওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের স্বার্থান্বেষী মহলটিই প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করতে বিজ্ঞাপনের নামে নিম্নমানের প্রচারের কৌশল নিয়েছে।
একে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের নৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে জানতে পিডিবির পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মাহবুব সারোয়ার-ই-কায়নাতকে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “মিথ্যা বিজ্ঞাপন দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। যে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে তার সবই সঠিক। ”
রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জনগণকে সচেতন করতে এবং প্রকৃত তথ্য জানাতে এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ”
সাশ্রয়ী রেটে এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন,
“৪টি পত্রিকায় ‘বিদ্যুৎ নিয়ে যত কথা’ শীর্ষক ৫ পর্বের এই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, ০২ আগস্ট, ২০১২
ইএস/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর