ঢাকা: বিতর্কিত এশিয়া এনার্জির হাতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি তুলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এ পদক্ষেপকে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডকে রহস্যজনক উল্লেখ করে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে জাতীয় কমিটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, “দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেতা থাকার সময় ফুলবাড়ী আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে উন্মুক্ত খনি করা হবে না। ” এখন শেষ মুহূর্তে এসে যদি সরকার এশিয়া এনার্জির পক্ষে অবস্থান নেয় তা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক নেতা বলেন, “সরকারের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের কিছু লোক ঘাপটি মেরে বসে আছে। যারা সরকারের মঙ্গল চায় না। মূলত তারাই আওয়ামী লীগকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করতে এ উদ্যোগ নিয়েছেন। ”
সরকারের শেষ মুহূর্তে এসে ফুলবাড়ী কয়লাখনি এশিয়া এনার্জিকে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের মতে “এখন খনিটি উন্নয়নের জন্য এশিয়া এনার্জিকে দেওয়া হলে কয়লা উত্তোলন করতে সময় লাগবে কমপক্ষে তিন বছর, যার সুফল ভোগ করবে পরবর্তী সরকার। ”
তাহলে কার স্বার্থে এই বিশাল ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না তারা। শেষ মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এশিয়া এনার্জিকে খনিটি উন্নয়নের জন্য দেওয়া হলে আগামী নির্বাচনে দিনাজপুর এলাকায় এর প্রভাব পড়তে পারে বলে তারা মনে করছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আজিজুল ইমাম চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ফুলবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবলু বাংলানিউজকে বলেন, “সরকার পাটোয়ারি কমিটির সুপারিশ আমলে না নিয়ে নিজেদের লোক দিয়ে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করেছে, যা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এর জবাব জনগণ দেবে। এশিয়া এনার্জিকে মেনে নেওয়া হবে না। এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ”
ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়ন এবং খনিমুখে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প হাতে পেতে এশিয়া এনার্জির মূল প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট (জিসিএম) ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে কোম্পানিটি এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক দেন দরবার করছে। এমনকি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা নানারকম লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে। তারা নামে-বেনামে বিভিন্ন লিফলেট প্রচার করছে।
সম্প্রতি সচেতন এলাকাবাসির ব্যানারে একটি লিফলেট প্রচার করে যাতে বলা হয়, “এলাকাবাসি এই খনির পক্ষে। ”
গত ৯ জুলাই জিসিএম রিসোর্সেস-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে জ্বালানি সচিব মেজবাহ উদ্দীন একটি বৈঠক করেন। এছাড়া জিসিএম প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরীর কাছে গত ৩০ আগস্ট একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে তারা হতাশা ব্যক্ত করে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে জিসিএমের চেয়ারম্যান জেরার্ড হোলডেনের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয় বলে সূত্র দাবি করেছে।
এশিয়া এনার্জি জানায়, সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি অনুসন্ধান, মজুদ নির্ধারণ, খনির পানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, পুনর্বাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে ইতিমধ্যে বেশকিছু সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে উন্নয়ন প্রস্তাব জমা দেয়।
নিয়মানুযায়ী এশিয়া এনার্জির সমীক্ষা রিপোর্ট তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে মূল্যায়ন করা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই রিপোর্টের মূল্যায়ন করাই হয়নি। অথচ সরকারের একটি মহল এশিয়া এনার্জিকে খনিটি তুলে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে।
গত মাসে এশিয়া এনার্জির কাজে সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “কোম্পানি অনুসন্ধান কার্যক্রম ও খনি উন্নয়ন সম্পর্কে সামগ্রিক ফলাফল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে চায়। অনুসন্ধান লাইসেন্সপ্রাপ্ত হওয়ায় তাদের সে অধিকার রয়েছে। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করা উচিত। ”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের সিনিয়র সহকারী সচিবের সই করা এই চিঠি গত ১৪ অক্টোবর দিনাজপুরে এসে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। এশিয়া এনার্জি আগামী দুই বছর জরিপ কাজ চালাবে। তাদের জরিপ কাজ নির্বিঘ্ন করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে সার্বিক সহায়তা দিতে বলা হয়েছে।
স্থানীয়রা মনে করছে, এ ধরনের উদ্যোগ জনমনে শঙ্কা তৈরি করতে পারে। এর ফলে জনগণ ফুঁসে উঠতে পারে।
ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নে সম্প্রতি এশিয়া এনার্জি ৬ শতাংশ রয়্যালটি ছাড়াও ১০ শতাংশ ‘ইকুইটি শেয়ার’ প্রদান এবং নিজস্ব বিনিয়োগে খনিমুখে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, “এশিয়া এনার্জি একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান। মাইনিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই তাদের দিয়ে ফুলবাড়ী খনি প্রকল্প উন্নয়ন করা হবে আত্মহত্যার শামিল। ”
এছাড়া ২০০৬ সালে সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি মতামত দিয়েছিল এশিয়া এনার্জিকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার জন্য।
কয়লানীতি রিভিউ কমিটির একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সূত্র জানিয়েছে এতে বলা হয়েছে, “উন্মক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে প্রাণ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। ”
খনি থেকে ৩৮ বছরে যে পরিমাণ লভ্যাংশ পাবে বাংলাদেশ, খনি অঞ্চলে তার চেয়েও বেশি অর্থের ফসল নষ্ট হবে। পাশাপাশি গোটা উত্তরবঙ্গের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে।
তবে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করার সুপারিশ তৈরি করেছে।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে গত বছর ৮ আগস্ট ১৫ সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে খুব শিগগিরই জমা দেবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সমাবেশকে কেন্দ্র করে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। ফুলবাড়ীর ব্রিজ এলাকা থেকে ঢাকা মোড় পর্যন্ত সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। প্রতিবাদে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির শনিবার হরতালের ডাক দিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা এরই মধ্যে ফুলবাড়ীতে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১২
ইএস/সম্পাদনা: রানা রায়হান, আউটপুট এডিটর [email protected]