একদিন, ঢাকা চিড়িয়াখানায়

তারেক মাহমুদ সজীব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৯:২৫, জুন ২৭, ২০১১

রাজধানীতে যে কয়টি বেড়ানোর জায়াগা আছে ঢাকা চিড়িয়াখানা তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিনই দূর-দুরান্ত থেকে প্রচুর দর্শক আসছে এখানে।

ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং জাতীয় চিড়িয়াখানা। প্রথমে এটি হাইকোর্ট এলাকায় ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয়। পরে ১৯৭৪ সালে একে বর্তমান অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং এই বছরেরই ২৩ জুন তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মোট ১৮৬.৬০ একর জায়গার ওপর বিস্তৃত ঢাকা চিড়িয়াখানা।

ঢাকা চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা, শিক্ষা, গবেষণা ও বিনোদন। ঢাকা চিড়িয়াখানায় সর্বমোট ১৫টি শাখা আছে। ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী এখানে মাংসাশী শাখায় ১০ প্রজাতির ৪৮টি প্রাণী, বৃহৎ প্রাণী (তৃনভোজী) শাখায় ২২ প্রজাতির ১৫৯টি, ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ শাখায় ৩৩ প্রজাতির ২৩৯টি প্রানী, পাখি শাখায় ৬১ প্রজাতির ১২১৭টি, ফিশ অ্যাকুরিয়াম শাখায় ২৬ প্রজাতির ২১৯টি প্রাণী আছে।

চিড়িয়াখানায় বাচ্চাদের খেলার জন্য আলাদা একটি শিশুপার্ক আছে। এছাড়া আছে দুটি লেক এবং উৎসব ও নিঝুম নামে দুটি পিকনিক স্পট। ঢাকা চিড়িয়াখানায় জনপ্রতি বর্তমান প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। সপ্তাহের রোববার দর্শকদের জন্য বন্ধ থাকে। দেশের একমাত্র প্রাণী জরিপ দপ্তরও চিড়িয়াখানার ভেতরে। প্রতিষ্ঠার সময় কত প্রাণী ছিল তা সম্পর্কে চিড়িয়াখানার তথ্য প্রদান কেন্দ্র কোনো তথ্য দিতে পারেনি, যদিও চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় সাইনবোর্ডে বলা আছে, যে কেউ তথ্য কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবেন।

অন্যান্য বিনোদন স্পটের মতো ঢাকা চিড়িয়াখানা নিয়ে অভাব-অভিযোগের অন্ত নেই। চিড়িয়াখানার বাইরে ও ভেতরে হকারদের দৌরাত্ম্য, চিড়িয়াখানার ভেতরের নোংরা পরিবেশ, রেস্টুরেন্টে খাবারের গলাকাটা দাম নিয়ে সবার অভিযোগ থাকলেও বর্তমানে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার কারণে চিড়িয়াখানায় অন্যরকম একটি পরিবেশ লক্ষ করা গেলো। মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে যেখানে এতোদিন ভ্রাম্যমাণ হকারদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ দর্শনার্থীরা ভোগান্তির শিকার হতেন, সেখানে এখন দু-একজন ছাড়া আর কোনো হকারই নেই।

 হকারদের টানা-হ্যাঁচড়া ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বানরের বাঁদরামি দেখার জন্য খাঁচার সামনে উৎসুক দর্শকের ভিড়। ছোট-বড় সবাই খুব উপভোগ করছেন । হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লো। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে খাদ্যদ্রব্যর মূল্যতালিকার বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে মূল্য তালিকায় উল্লেখ করা নির্ধারিত মূল্যে মানা হচ্ছে কিনা যাচাই করতে দেখা গেল বিরিয়ানির মূল্যে ৬০ টাকা লেখা থাকলেও ৭০ টাকা রাখা হচ্ছে। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের যুক্তি তারা বিরিয়ানির পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে বিক্রি করছে, যার কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি। এদিকে মূল্য তালিকায় উল্লিখিত অনেকগুলো খাদ্যদ্রব্য, যেগুলোর তুলনামূলক দাম কম, সেগুলো তারা বিক্রি করছে না। সবচেয়ে কমদামি খাবার কেক ২০ টাকা এবং চিকেন বার্গার ৪৫ টাকা।

বানরের খাঁচা পার হয়ে কিছুটা সামনে এগোলেই বাঘ ও সিংহের খাঁচা। সিংহের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখা গেলো সিংহকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। খাবার দেবার পর কথা হলো সিংহের খাঁচার দায়িত্বে থাকা মোঃ বাবুল মিয়ার সাথে। তিনি জানান, ১৯৯১ সালের ১লা জুন তিনি চাকরিতে যোগ দেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি প্রতিদিন সিংহের খাঁচায় খাবার দেন। মাঝে মাঝে বাঘের খাঁচায়ও খাবার দেন। যেহেতু তিনি সরাসরি নিজেই প্রতিদিন খাবার দেন সেহেতু পশুপাখিদের খাবারের অনিয়মের কথা, মানসম্পন্ন খাবারের অভাব ও খাবারের কম দেবার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, গত এক বছর ধরে তিনি খাবারে কোনো অনিয়ম পাননি। তবে এর আগে অনিয়ম হয়েছে। বর্তমানে বাঘ-সিংহকে যে মাংস দেওয়া হয়, তার এই চাকরি জীবনের গত বিশ বছরে তিনি এরকম মাংস কখনও বাঘ বা সিংহকে খেতে দেননি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যে ধরনের মাংস দেওয়া হয় তা তাদের কপালে ও জোটে না। প্রতিদিন সিংহকে ১০ কেজি মাংস দেওয়া হয়। সাধারণত প্রতিদিন সকাল ১১টার দিকে চিড়িয়াখানার সকল প্রাণীকে খাবার দেওয়া হয়। বাবুল মিয়া জানান, প্রায়ই সকালে মাংস দেবার সময় তিনি দেখেন গত দিনের মাংস উদ্বৃত্ত পড়ে আছে। তখন তা ফেলে দেওয়া হয়। কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে তার চাকরিজীবনের নানা কথা। ১৯৯১ সালে যখন চাকরিতে যোগ দেন তখন তার বেতন ছিলো ৭০০ টাকা। আর এখন পান প্রতিদিন ১৫০ টাকা হারে। বিশ বছর ধরে চাকরি করলেও তার চাকরি এখনও স্থায়ী হয়নি। চাকরি স্থায়ী করার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অথচ কিছুদিন আগেও স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরো কয়েকজনকে। এরকম ১৮ জন কর্মচারী আছেন যাদের অনেকের চাকরির বয়স ২৫ বছরও পার হয়ে গেছে। এরমই একজন ব্যক্তি আবদুল লতিফ যিনি ২৮ বছর ধরে বাগান শাখায় কাজ করে আসছেন কিন্তু এখনও তার চাকরি স্থায়ী হয়নি। পাচ্ছেন দৈনিক ১৫০ টাকা হারে। অথচ তাদের পরে এসে অনেকে দিব্যি স্থায়ী হয়ে গেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে বাবুল মিয়া প্রতিদিন সিংহের খাঁচায় খাবার দেন তিনি অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের নিয়ে কেউ ভাবেও না, কথাও বলে না। অথচ আমরা অনেক বঞ্চনার ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করছি।

সিংহের খাঁচা পার হয়ে ভেতরের দিকে এগোলে সামনে পড়বে সাপ, পাখি ও নানা জাতের প্রাণী। চারদিকে লক্ষ করা গেলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। খুলনা থেকে নাতনিকে নিয়ে বেড়াতে আসা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১০ বছর আগে চিড়িয়াখানায় যে ধরনের কোলাহল ছিলো তা এখন আর চোখে পড়ে না। আগে চিড়িয়াখানাভরা প্রাণী ছিল আর এখন সব জায়গা কেমন যেন শূন্য শূন্য।

চিড়িয়াখানার ভেতরে প্রাণী জাদুঘর ও ফিশ অ্যাকুরিয়াম নামে একটি প্রর্দশনী কেন্দ্র আছে যাতে ২৪০ প্রজাতির নমুনা আছে। তবে এই জাদুঘর দেখার জন্য আলাদা  দুই টাকা মূল্যের টিকেট লাগবে।

প্রাণীর মৃত্যু ও নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় একজন কর্মকর্তার সাথে। তিনি বলেন, আমাদের সবার একটি ধারণা, খাবারের স্বল্পতার কারণে প্রাণীর মৃত্যু হয়। আসলে এটা ঠিক নয়। প্রতিটি প্রাণীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণয় করে যার যতটুকু প্রয়োজন সে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায় এই খাবারই প্রায়শ উদ্বৃত্ত থেকে যায়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বন্দিত্বসহ বিভিন্ন কারণে প্রাণীদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

এত বিশাল এলাকা হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি ক্লান্ত হন তাহলে একটু বিশ্রাম নিন  বিশাল গাছের নিচে নির্মল বাতাসে। অথবা গিয়ে বসুন লেকের পাড়ে আর উপভোগ করুন প্রকৃতির অসাধারণ সুন্দর। আর আপনার সন্তানকে ছেড়ে দিন শিশু পার্কে। খোলা বাতাসে একটু না হয় দুষ্টুমি  করুক।

বাংলাদেশ সময় ১৯০৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১১


সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান