ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একাত্তর

৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২২
৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুর: ১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ি বীজ গোডাউনে ক্যাম্প স্থাপন করে।

সেখানে একটি টর্চার সেল স্থাপন করে তারা।  

নিরীহ বাঙালিদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো সেখানে। পরে মৃতদেহ আশপাশের বাগানে পুঁতে ফেলতো তারা। ধর্ষণ করে হত্যা করতো নারীদের। ৫১ বছর আগের সেই বীজ গোডাউনটি এখনো আছে। পাশেই রয়েছে একটি গণকবর।  
 
নির্যাতন এবং হত্যার আরেকটি নির্মম স্থান পাশের রহমতখালী খালের ওপর থাকা মাদাম ব্রিজ। ব্রিজের পাশে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বাংকার ছিল। ব্রিজের ওপর মুক্তিকামী এবং সাধারণ বাঙালিদের ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে বার্স্ট ফায়ার করে হত্যা করা হতো। লাশগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হতো রহমত খালী খালে। কিছু লাশ আবার ব্রিজের পশ্চিম পাশের একটি গর্তে ফেলে দেওয়া হতো।

যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এই দেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনী হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়।

লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের পাল বাড়িতে তাণ্ডব চালায় হানাদাররা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাড়িঘর। এসময় হত্যা করা হয় বেশ কয়েকজনকে।

তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লক্ষ্মীপুর থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণ করে রাজাকার ও আলবদররা। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর হানাদার মুক্ত হয়।  

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী লক্ষ্মীপুরে আসতে শুরু করে। এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের তাণ্ডবলীলা।

হানাদারদের প্রতিহত করতে মে মাসের দিকে লক্ষ্মীপুর শহরের সার্কিট হাউস সংলগ্ন রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সড়কের রহমতখালী খালের ওপর থাকা ব্রিজটি গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পরে হানাদার বাহিনী সেখানে একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করে। ব্রিজের পাশেই তাদের একটি বাংকার ছিল। আর ব্রিজের ওপর হাজার হাজার মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। মাদামের ভগ্নদশা ব্রিজটি এখনো হত্যা এবং নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  

এদিকে লক্ষ্মীপুরকে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটি পরিকল্পনা করেন। কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ২ ডিসেম্বর রাতে হানাদারদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীরা পালিয়ে যায় এবং ক্যাম্পে থাকা রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে।  

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহবুবুল আলম রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজকে বলেন, লক্ষ্মীপুর থানা থেকে শুরু করে উত্তর মজুপুর, সাহাপুর, বাগবাড়িসহ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলি। ৩ ডিসেম্বর হানাদারদের সঙ্গে যখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়, তখন হানাদাররা টিকতে না পেরে তাদের দোসর রাজাকার ও আলবদরদের ক্যাম্পে রেখে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। ওই দিন আমরা হানাদারদের ক্যাম্পে থাকা রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করতে বলি। তারা আত্মসমর্পণ না করায় আমরা মুক্তিকামী স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি মিছিল বের করি।  

তিনি বলেন, চর্তুদিক থেকে মিছিলের শব্দ শুনে নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় রাজাকার-আলবদররা। ৪ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করলেও ওই রাতে চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হতে হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। পিয়ারাপুরের রাজাকার আব্দুল হাইর নেতৃত্বে কাউন্টার একটি হামলা করে হানাদাররা। হামলায় আবু ছায়েদ নামে আমাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন তিনজন মুক্তিসেনা। ওই রাতেই হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশ নেন। এটাই ছিল লক্ষ্মীপুরে হানাদার বিরোধী শেষ প্রতিরোধ।

মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প তৈরি করে। শহরের মাদাম ব্রিজ এবং বাগবাড়ি সিড গোডাউন ক্যাম্প ছাড়াও দালাল বাজার গালর্স হাই স্কুল, মডেল হাই স্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদরাসা, এলএম হাই স্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদরাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারি হাই স্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো ছিলো হানাদার ও রাজাকারদের ক্যাপ এবং গণহত্যার স্থান।

এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাই স্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদরাসা ও এলএল হাই স্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়।  

মুক্তিযোদ্ধারা জানায়, নয় মাসে লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩৭টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। এতে শহীদ হন ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিহত হন হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ।  
 
শহীদ ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরের মোট ১১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।