ঢাকা: ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৩ সালে ঢাকার হাজারীবাগে স্থাপিত ক্লাবটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের একটি উজ্জ্বল নাম।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তারই ক্রান্তিকালে হাল ধরে মোহামেডান। এ সময় কলকাতা মোহামেডানের বিখ্যাত ফুটবলার মোহাম্মাদ শাহজাহান ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা মোহামেডানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সে সময় দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে একক প্রাধান্য ছিল ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের। তবে বসে থাকেনি মোহামেডান, সুসংগঠিত ও পুর্নগঠিত হয়ে মাঠে কাঁপাতে প্রস্তুত হয় তারাও। এরমধ্যে ১৯৫৬ সালে ঢাকা ওয়ান্ডার্সের কিছু তারকা ফুটবলার ও ক্লাব কর্মকর্তা সাদা-কালো শিবিরে যোগ দেয়। এরপরই মূলত ঢাকা মোহামেডানের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৬ সালে প্রথম বারের মত ঢাকা লিগের ফাইনাল খেলে তারা। তবে সেবার সবপ্ন পূরণ হয়নি, রানার্সআপ হয় মোহামেডান। আর ১৯৫৭ সালে প্রথম বারের মতো মোহামেডান ঢাকা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়।
সে বছরটি ছিল মোহামেডানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৫৭ সালে মোহামেডান স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে তারা মোহামেডান ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, দাবা, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার ইত্যাদি খেলাতেও শিরোপা জয় করে। এছাড়া হ্যান্ডবল, জিমন্যাস্টিকস টিমও গঠন করে ক্লাবটি। তাই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রায় তাদের অবদান অবশ্যই স্মরণীয়।
তবে দিন বদলের সাথে সাথে সেই পুরোনো জৌলস হারায় ঢাকা মোহামেডানে। ফুটবলে সেই অপ্রতিরোধ্য মোহামেডানকে অনেকদিন দেখেনি সমর্থকরা। খেলা দেখতেও মাঠে দর্শক আসে না তেমন। দলটিতে নেই ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড়। ভালো মানের দেশি ফুটবলার রয়েছে তাদের। তবে, এই শক্তি নিয়ে শেখ জামাল, শেখ রাসেলের বিদেশি ফুটবলার নির্ভর দলগুলোর সাথে পেরে উঠছে না মোহামেডান। তাই ঐতিহ্যবাহী দলটির এখনও ছুঁয়ে দেখা হয়নি পেশাদার লিগের শিরোপা।
তবে গত সাত আসরে তিনবার দলটি রানার্সআপ হয়েছে। এতটুকু হিসেবেই বেরিয়ে এসেছে মোহামেডানের বর্তমান অবস্থা। স্বাধীনতার পরে এ বছরই প্রথম মোহামেডান জাতীয় দলের কোন ফুটবলার ছাড়াই দল গঠন করেছে। এবার মান্যবর প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্ব শেষে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দলটি। তবে ভয় একটাই, শেষ সময়ে বাজে খেলে শিরোপা হাতছাড়া করার অভ্যাস আছে সাদা-কালোদের!
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে তাদের প্রতাপ নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র মোহামেডানের দাবা দলটি ছাড়া আর কেউ নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির নেই নিজস্ব কোনো মাঠ। মতিঝিলস্থ মোহামেডান ক্লাবটি এখন আর সমর্থকদের ভিড়ে উৎসবের পরিবেশের সৃষ্টি করে না।
এ বিষয়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক সরোয়ার হোসেন তাদের সীমাবদ্ধতা ও পরিকল্পার কথা তুলে ধরেন। তার কথাতেই প্রকাশ পেল অর্থনৈতিক কাঠামোর ভীত অনেক দুর্বল মোহামেডানের। 'ভালো মানের দল গড়তে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তা আমাদের নেই। বছরে ১১/১২ কোটি টাকা খরচ হয় আমাদের। কোথা থেকে আসে এ সকল অর্থ? অনেকটা ধার দেনা করেই চলতে হচ্ছে। আসলে খেলাধুলায় প্রচুর টাকা দরকার। আর আমরা তো শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দাবা, হ্যান্ডবল, ভলিবল, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার, জিমন্যাস্টিকস সব ক্ষেত্রে তো আমাদের অবাধ পদচারনা ছিল। অনেক ক্লাবই তো শুধু ফুটবল বা ক্রিকেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ক্রীড়া নিয়ে অনেক পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। শুধুমাত্র অর্থের অভাবে এগিয়ে যেতে পারছি না। '
ক্লাবের নিজের একটি মাঠ নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, বুয়েট মাঠে ভাড়ায় প্রাকটিস করতে হয় দলটিকে। মাঠের বিষয়ে সরোয়ার হোসেন জানালেন, 'ক্লাবের মধ্যে যে ছোট মাঠটি আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মোহামেডানের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ খেলার মাঠ না থাকার বিষয়টি। অর্থের অভাবের থেকেও এটি আমাদের বেশি ক্ষতি করেছে। '
তাহলে এ থেকে মুক্তির উপায় কি? জবাবে তিনি জানালেন, '৫২ তলা একটি ভবনের কাজ হাতে নিয়েছি আমরা। এ স্বপ্নের ভবনটি তৈরি হলে সহজেই অর্থনৈতিক সমস্যা দূর হবে ক্লাবের। কারণ এখান থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা মুনাফা আসবে। ফলে ক্রীড়ার বাজেট ১২ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকা করতে আমাদের কোন বাধাই থাকবে না। মাঠ, একাডেমি থেকে শুরু করে মানসম্পন্ন বিদেশি খেলোয়াড় ও ভালো মানের দল গড়তে আমাদের কোন বাধা থাকবে না'
মোহামেডানের একাডেমি কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সাভারে স্পোর্টস একাডেমির জন্য ২৫ বিঘা জমি আছে আমাদের। এখন কাজ যত তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারবো ততই মঙ্গল হবে আমাদের জন্য। তবে এখনই বলা যাচ্ছে না কবে নাগাদ শুরু হবে এর কাজ। '
মোহামেডানের আরেক পরিচালক লোকমান হোসেন ভূইয়া জানালেন, 'একটি নির্দিষ্ট আয়ের উৎস নেই মোহামেডানের। অর্থ না থাকলে ভালো মানের দল গঠন করা সম্ভব নয়। পুরুষ বিভাগে ক্রিকেট, ফুটবল, দাবা থেকে শুরু করে নারী ক্রিকেট, ফুটবলেও আমাদের দল আছে। আছে বেশ কিছু অনূর্ধ্ব দলও। অনেক টাকা খরচ হয়, কিন্তু আয়ের খাত কি? কিছুই নেই, অনেকটা কর্জ করেই চলছে ক্লাবের কার্যক্রম। সময়টা ভালো যাচ্ছে না মোহামেডানের। এ অবস্থা থেকে গুছিয়ে উঠতে সময় দরকার। আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি, বাস্তবায়ন সম্ভব হলে অচিরেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। '
তাই মোটা দাগে বলা চলে, অর্থ সমস্যাই থমকে দিয়েছে মোহামেডানের পথচলা। একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের খাত থাকলে হয়তা বাঁচবে ক্লাবটির 'প্রাণ'। এখন হাড্ডি-কঙ্কাল শরীর নিয়ে পথ চলছে ঢাকা মোহামেডান। আর এ ক্লাবগুলোর আলোতেই উজ্জ্বল হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। তাই অনেক ক্রীড়া সংগঠকদের মতে এর দায় এড়াতে পারে না সরকার। কারণ ক্লাবগুলোর মূল সমস্যা একটাই 'অর্থ'। তাই এ সকল ক্লাবগুলোর দিকে যথাযথ দৃষ্টি না দিলে একদিন পঙ্গুত্ব বরণ করবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। না হলে সোনালী অতীত, ওয়ারী আর ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের মতো 'জীবন্ত লাশ' এ পরিণত হবে এ ক্লাবগুলোও।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, ২৬ জুন ২০১৫
ইয়া/এমআর