সাতক্ষীরা: সৌম্য সরকার, মুস্তাফিজুর রহমান, সাবিনা কিংবা সুরাইয়া খাতুন- যার নামই বলা হোক না কেন, এদের সবার নামের সঙ্গে উঠে আসবে সাতক্ষীরার নাম। বিশ্বের দরবারে সাতক্ষীরার এসব খেলোয়াড়ই উজ্জ্বল করেছে দেশের নাম, সঙ্গে গোটা বিশ্বের সামনে সাতক্ষীরাকে তুলে ধরেছেন।
ক্রিকেটে রবিউল ইসলাম শিবলু, সৌম্য সরকার ও মুস্তাফিজ এবং ফুটবলে গোল মেশিনখ্যাত সাবিনা খাতুন, সুরাইয়া, লিজু, মাছুরা ও রওশনদের অনবদ্য পারফরম্যান্সে পুলকিত সাতক্ষীরাবাসী।
তবে, ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নয়- তায়কোয়ান্ডে, টেবিল টেনিস, ভলিবল, ক্যারামসহ অসংখ্য খেলায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নের কৃতিত্ব রয়েছে ‘সাতক্ষীরা’র।
এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাতক্ষীরার কৃত্বি সন্তান সোহেল ইসলাম মিলু। ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসানও সাতক্ষীরাকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে।
সব মিলিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এসব খেলোয়াড়ের অনবদ্য অবদানে উজ্জ্বল হয়েছে সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গনে।
খুলনা বিভাগের পর ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরর্সের হয়ে মিরপুর স্টেডিয়াম কাঁপানো বাঁহাতি অলরাউন্ডার সৌম্য সরকার ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে জাত চিনিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সফরকারী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে এই হার্ড হিটারের। অভিষেকেই ম্যাচ জয়সহ বাংলাওয়াশের স্বাদ নিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে যান সাতক্ষীরার এই তারকা। এরপর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের প্রথম শতক হাঁকান তিনি।
২৪ এপ্রিল জেলার অপর কৃত্বি সন্তান সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস খ্যাত মুস্তাফিজ ও সৌম্য সরকারের অভিষেক ঘটে টি-২০তে।
১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান জীবনের প্রথম দুই ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সাতক্ষীরার নাম আরও প্রস্ফুটিত করেন। সাতক্ষীরার গণমুখি সংঘ ও ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহনী লিমিটেডের এই বাঁহাতি পেসারের অভিষেক ঘটে ১৯ জুন ভারতের বিপক্ষে।
জাতীয় দলে খেলেছেন সাতক্ষীরার অপর ডানহাতি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার রবিউল ইসলাম শিবলু। ২০১৩ সালের ৩ মে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে অভিষিক্ত হয়ে ২৭ মে ২০১০ ঐতিহাসিক লডর্সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি।
আর বিপিএল-এ রংপুর রাইডার্সের হয়ে অনবদ্য নৈপূণ্য দেখিয়েছেন সাতক্ষীরার এরিয়ান্স ক্লাব’র তাপস ঘোষ। শুধু বিপিএল নয়, অনুর্ধ্ব ১৬ ও ১৮ জাতীয় দলের হয়েও বিদেশ সফর করেছেন বিকেএসপি’র সাবেক এই ক্রিকেটার।
বর্তমানে অনুর্ধ্ব-১৬ জাতীয় ক্রিকেট দলের ৪২ জনের প্রাথমিক ক্যাম্পে আছেন সাতক্ষীরার তানভীর সজিব।
ক্রিকেটবোদ্ধাদের মতে, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সাতক্ষীরা জেলার সুনাম বরাবরই। জেলায় ক্রিকেটার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সীমান্ত ক্রিকেট একাডেমি ও সাতক্ষীরা ক্রিকেট একাডেমি নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমি নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলেন, ক্রিকেট কোচ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তিনজন প্রশিক্ষকের নিজ জেলা সাতক্ষীরা। সোহেল ইসলাম মিলু বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছেন, শাহ আলম শানু চুয়াডাঙ্গা ও মোফাচ্ছেনুল ইসলাম তপু সাতক্ষীরা জেলার সহকারী ডিস্ট্রিক্ট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া আরও ৪/৫ জন ইতোমধ্যে কোচেচ ট্রেনিং নিয়েছেন। জেলায় বর্তমানে ৫৫ জন ক্রিকেট আম্পায়ার রয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৫০ জনই কোয়ালিফাইড। এর মধ্যে লুৎফর রহমান সৈকত, দেবাশিস বসু শেখর ও মাহাবুবর রহমান বিসিবি’র আম্পায়ার্স কমিটির ডিস্ট্রিক্ট প্যানেলভুক্ত এবং সামিউল ইমাম আযম মনির ট্রেইনি প্যানেলভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
সাতক্ষীরা এক্সপ্রেসখ্যাত মুস্তাফিজুর রহমান ও সাতক্ষীরা জেলা দলের কোচ মোফাচ্ছেনুল ইসলাম তপু বাংলানিউজকে বলেন, খেলোয়াড় তৈরির উর্বর ক্ষেত্র হলো সাতক্ষীরা। এক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির লীগ, বয়সভিত্তিক খেলা এবং টুর্নামেন্টগুলো বেশ ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিতে এবং আরো ভাল খেলোয়াড় তৈরির জন্য একটি জিমনেশিয়াম খুবই প্রয়োজন। এছাড়া লীগ, বয়সভিত্তিক খেলা ও টুর্নামেন্টগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দরকার।
ক্রিকেট এগিয়েছে তবে, থেমে নেই ফুটবল
জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির খান বাপ্পি বাংলানিউজকে বলেন, জাতীয় দলের খেলোয়াড় গোল মেশিনখ্যাত সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে সাতক্ষীরার সুরাইয়া, লিজু, মাছুরা, গোল রক্ষক রওশন সাতক্ষীরাকে নিয়ে গেছে এক অন্য শিখরে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য হাজী আব্দুল খালেক এবং ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসান বাবু আন্তর্জাতিক ফুটবলের অন্যতম নাম। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বয়সভিত্তিক অনুর্ধ্ব-১৩ ফুটবলে ইরান সফর করেছে সাতক্ষীরার ছেলে ফয়সাল। এছাড়া শ্যামনগরের আলমগীর কবীর রানা খেলছেন শেখ জামাল ক্লাবে, অনুর্ধ্ব-১৬ দলে কলারোয়ার বাবু, সদরের আশিক, চাঁদপুরের জহির নিজ নিজ নামের প্রতি সুবিচার করে চলেছেন। জেলায় বর্তমানে ১২০ জন কোয়ালিফাইড ফুটবল রেফারি রয়েছে। এর মধ্যে তৈয়ব হাসান আন্তর্জাতিক প্যানেলভুক্ত এবং ইমাদুল হক খান ও তিনি নিজে এএফসি’র লাইসেন্সধারী রেফারি। এছাড়া মাধব দত্ত, সুজা খান ও সিরাজুল ইসলাম খানের রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ।
এদিকে, সাতক্ষীরার টেবিল টেনিস তারকা সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সাকিব এবং জাতীয় ক্যারাম চ্যাম্পিয়ন ফারজানা বানু ও ফারহানার (শিল্পী-প্রীতি জুটি) অনবদ্য অবদান জেলার ইনডোর ইভেন্টকে সমৃদ্ধ করেছে।
প্রশিক্ষক মোয়াজ্জেম কবিরের নেতৃত্বে তায়কোয়ান্ডে গেমসে জাতীয় বিভিন্ন ইভেন্টে স্বর্ণ ও রৌপ্যের গর্বিত অংশীদার সাতক্ষীরা জেলা। ভলিবলে মনির, রনি, রুহুল আমিনরা বয়ে এনেছেন অনন্য কীর্তি।
সাতক্ষীরা এরিয়ান্স ক্লাবের সভাপতি মুজিবর রহমান বাংলানিউজকে জানান, জেলার ক্লাব ইতিহাসও যথেষ্ট গৌরবগাঁথা। ইতোমধ্যে দেশের হাতে গোনা শতবর্ষী ক্লাবের সিঁড়িতে নাম লিখিয়েছে সাতক্ষীরার এরিয়ান্স ক্লাব। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি আজও নিজেদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া পিকে ইউনিয়ন ক্লাব ১৯৩৮ সালে, ইউনাইটেড ক্লাব ১৯৭৫ সালে এবং মুন্সিপাড়া যুব সংঘ ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জেলার ক্রীড়াঙ্গনে তাদের গৌরবময় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার তালিকাভুক্ত ৭৫টি ক্লাব নিয়মিতভাবে জেলার ক্রীড়ার মান্নোয়নে অবদান রাখছে।
সম্প্রতি সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের অনুকূলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ হতে বরাদ্দকরা ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকার উন্নয়ন কাজে প্রাণ ফিরেছে ক্রীড়াবিদদের মাঝে। ইতোমধ্যে মূল ভবনের উপরে ড্রেসিং রুমসহ অফিসিয়াল রুমের কাজ শুরু হয়েছে। স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে ১৬০ ফুট গ্যালারি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে সীমানা প্রাচীর, মাঠ সংস্কার ও পুরাতন গ্যালারি সংস্কারে ব্যয় হবে এই টাকা। এসব কাজ সম্পন্ন হলে এবং আগামীতে চারপাশে গ্যালারি নির্মাণ সম্পন্ন হলে সাতক্ষীরা স্টেডিয়াম রূপ নিবে সৌম্য, মুস্তাফিজ, রবিউল, সাবিনাদের স্বপ্নের স্টেডিয়ামে।
সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, জিমনেশিয়ান নির্মাণের বিষয়টি প্রস্তাব আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। এছাড়া জেলার ক্রীড়াঙ্গনেকে সমৃদ্ধ করতে নিয়মিত লীগের পাশাপাশি চায়না বাংলা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, বঙ্গবন্ধু ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, জেলা প্রশাসক কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫১ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৫
এসএইচ