ঢাকা: জনপ্রিয় ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার আলফাজউদ্দিন আহমেদের খেলাধুলার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চায় ছিল প্রবল আগ্রহ। স্বাধীনতার আগে ভলিবলের কোর্ট, ক্রিকেটের মাঠে সরব উপস্থিতি ছিল তার।
আলফাজউদ্দিনের ধারাভাষ্যে আসা হুট করে-নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরেই, ‘আমি গ্রুপ থিয়েটারে নাটক করতাম। মনে হতো মঞ্চে নাটক করার চাইতে টেলিভিশন কিংবা বেতারে নাট্যশিল্পী যদি হওয়া যায়..মর্যাদা বেশি। সেই সুবাদে বেতারে বেশ কিছু কর্মকর্তার সাথে পরিচিত হই। বেতারে অডিশন দিয়ে নাট্যশিল্পীও হয়ে যাই। রেডিওর কমকর্তা সালাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা হয়। মাঝে মধ্যে আগারগাঁও বেতার অফিসে বসতেন তিনি। আমার বাসা তখন মোহাম্মদপুরে, অফিস মতিঝিলে। তবুও আমি আগারগাঁও যেতাম। ’
সেই সালাউদ্দিনের সূত্র ধরেই ধারাভাষ্যকার হিসেবে বেতারে অডিশন দেয়ার সুযোগ আসে আলফাজউদ্দিনের। অডিশন দেয়ার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে এখনও আপ্লুত হয়ে পড়েন, ‘আমি তখন রুপালি ব্যাংকের ইব্রাহিম ম্যানশন ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। সালাউদ্দিন ভাইয়ের কাছে গিয়েছি, সে খুবই ব্যস্ত। চেয়ারে বসছেন, এদিক-ওদিক যাচ্ছেন। আমাকে সময় খুব বেশি দিচ্ছেন না। ’
‘তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আসলেই ব্যস্ত নাকি ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন? কি হয়েছে বলুন? তখন তিনি বললেন, দেখ আব্দুল হামিদ, মঞ্জুর হাসান মিন্টু এদের তো রোজ রোজ পাওয়া যায় না। আমাদের নতুন ধারাভাষ্যকার দরকার। কিন্তু আমরা মোটেও বের করতে পারছি না। তখন নতুন কেউ আসছে না বা তারা পাচ্ছে না। তখন সালাউদ্দিন ভাইকে বললাম, আমি ধারাভাষ্য দিতে পারি। তখন ওনি বললেন , ইয়ার্কি মারার সময় না এটা। ’-যোগ করেন আলফাজউদ্দিন।
পরে সালাউদ্দিন বাংলাদেশ বেতারে অডিশনের সুযোগ করিয়ে দেন আলফাজউদ্দিনকে। অডিশন কেমন হয়েছিল সেটি জানুন আলফাজউদ্দিনের মুখ থেকেই, ‘আমি কিন্তু হামিদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনে কপি করার চেষ্টা করতাম। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, বিশ্বাস ছিল আমি পারবো। অডিশন দিতে ৩০-৩২ জন এসেছে। আমি যেহেতু সবার পরে আবেদন করেছি আমার সিরিয়ালটাও সবার শেষে। যাই হোক, আমার অডিশনের সময় আসলো। অডিশন বোর্ডে ৩-৪ জন ছিলেন। আশফাক সাহেব নামে একজন ছিলেন ওনি আবৃত্তি করতেন। ভেতরে যাওয়ার পর মাইক্রোফোন রাখা, সামনে জায়গাটা কাঁচে ঘেরা। সবাই ফুটবলের ধারাবর্ণনা করেছে; ব্যতিক্রম করার জন্য আমি ক্রিকেট করতে চাইলাম। অডিশন বোর্ড থেকে বলা হলো, ধরেন শারজাতে খেলা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান। মনের মাঝে কাল্পনিক মাঠ বানিয়ে ধারাভাষ্য দিতে শুরু করলাম। এভাবে এক ওভার-দুই ওভার করে যাচ্ছি। আমাকে থামতে বলছে না। ৭ মিনিট হওয়ার পর থামতে বললেন। ’
কেবল কন্ঠ আর কথা বলার ধরণ দেখেই মুগ্ধ হননি অডিশন বোর্ডে থাকা ব্যক্তিরা। ক্রিকেটের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে আলফাজউদ্দিন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন সবাইকে। অডিশনে আলফাজউদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বোলার যখন বাউন্সার মারবে তখন একজন ব্যাটসম্যানের কিভাবে খেলা উচিত।
জবাবে আলফাজউদ্দিন বলেছিলেন, ‘শরীর বলের লাইনে নিয়ে যেতে হবে। বলের উপর চোখ রাখতে হবে। তারপর পুল বা হুক করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। যদি আগে খেলে ফেলেন ক্যাচ উঠে যেতে পারে। যদি বেশি দেরি করেন গায়ে লাগার সম্ভাবনা থাকবে। ভয় পেলে ‘ডাক’ করতে পারেন। আরও বিস্তারিত আকারে বলার পর তাদের একজন আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি সালাউদ্দিনের রুমে গিয়ে বসলাম। সালাউদ্দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া শুরু করলো। বললো সবাই ফেল করেছে তুমি পাশ করেছ। সালাউদ্দিনকে ওনারা বললেন, এতদিন ওনাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। ’
১৯৮১ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচে ধারাভাষ্যকার হিসেবে অভিষেক ঘটে আলফাজউদ্দিনের। প্রয়াত ধারাভাষ্যকার আব্দুল হামিদ ও মঞ্জুর হাসান মিন্টুর মাঝে বসে প্রথমবার ধারাভাষ্য দেন তিনি। তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন যুগ। বেতার কিংবা টেলিভিশন, থেমে নেই আলফাজউদ্দিনের কন্ঠ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৬
এসকে/এমআরএম
** তিন যুগ পেরিয়ে ধারাভাষ্যে আলফাজউদ্দিন