সাতক্ষীরা থেকে ফিরে : নদীর নাম ইছামতি। পার হলেই ভারত।
তবু আশ্চর্য শান্ত গ্রাম, গ্রামের মানুষ। এখানকার মানুষের বিনোদন বলতে একমাত্র টিভি। তা-ও দূরত্বের বাধা পেরিয়ে ডিশ সংযোগ আসতে পারেনি নদীর পাড় পর্যন্ত। গোটা এলাকা ঘুরে হাতেগোনা মোটামুটি অভিজাত দু’একজনের বাড়ির ছাদে দেখা গেলো মিনি ডিশ।
তবু এখানকার মানুষ প্রসেনজিৎকে তো চেনেই। গৌতম ঘোষকেও চেনে। তাদের নাম জানে আট-দশ বছর বয়সী বাচ্চারাও! ভাতশালায় ঢুকে যখন ‘শঙ্খচিল’ ছবির শুটিং স্পট খুঁজছি, আমাদেরকে ঘিরে নিলো একদল স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। তারা দেখিয়ে দিলো, ‘গৌতম ঘোষের শুটিং? এই দিকে। ’
বিস্ময়ের খাদে ডুবে যেতে যেতে আবিষ্কার করা গেলো দু’জন মোটরসাইকেল চালকের কথোপকথন। বলে নেওয়া ভালো, এ এলাকায় মোটরসাইকেল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আভিজাত্য নয়, আয়ের মাধ্যম। ভাড়ায় চালিত হয় এগুলো। এক চালক অন্যজনকে বলছেন, ‘কার ছবি জানিস? গৌতম ঘোষের!’
ইছামতির পাড়ে একটি বাড়ি পাওয়া গেলো। দু’রুমের ছোটো পাকা বাড়ি। ওপরে টালির ছাউনি। সামনে ছোট্ট উঠোন। শুটিংয়ের প্রপস নেওয়া হচ্ছে ভেতরে। সাজানো হচ্ছে। বাড়ি থেকে কয়েক হাত দূরত্বে নদী। বাংলানিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শেখ তানজির আহমেদ ছিলেন সঙ্গে। জানালেন, বাড়িটি এখানে আগে ছিলো না। ‘শঙ্খচিল’-এর শুটিংয়ের জন্যই বানানো হয়েছে।
গৌতম ঘোষ এমন একটি সীমান্ত এলাকা খুঁজছিলেন বহুদিন ধরে। ‘শঙ্খচিল’ নামে একটি ছবি বানাবেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রতিদিনকার হাসি-কান্না, সংগ্রাম-জটিলতার গল্প নিয়ে। সীমান্তের বিডিআর-বিএসএফ, চোরাকারবারী, গুলিবর্ষণ, অনিশ্চিত জীবন, দারিদ্র্য; এতোকিছুর মধ্যেও কিভাবে বেঁচে থাকে জনপদ- উঠে আসবে গল্পে।
তার জন্য একটি বাড়ি দরকার। যেখানে বাড়ির শেষ মানেই নদীর শুরু। নদী শেষ মানেই শুরু ভারতের সীমানা। বাড়িটি হবে ভূগোল শিক্ষক বাদল মাস্টার, মানে প্রসেনজিতের। একমাত্র কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি থাকেন সেখানে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা- ওই জেলাগুলোও ঘুরে এসেছেন গৌতম। কিন্তু চিত্রনাট্যের সঙ্গে খাপ খায়, এমন জায়গা পাননি। শেষমেষ সাতক্ষীরা। এ জেলায়ও বহুদিন ঘুরে, তবেই জায়গাটির সন্ধান মিলেছে।
কিন্তু শুটিংয়ের বাড়ি বানানোর জন্য জমি দিতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না এর মালিক। যখন শুনলেন প্রসেনজিৎ আসবেন এখানে, রাজি হলেন। মাসখানেক ধরে বাড়িটি বানানো হলো। শুটিংও হলো প্রথম ধাপের। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় কাজ শুরুর আগে বেঁকে বসলেন জমিওয়ালা।
কিছুতেই সেখানে কাজ করতে দেবেন না তিনি। শুধু তিনি নয়, আশপাশের আরও অনেকেই। কারণ বজ্রপাত! সাতক্ষীরায় টানা বর্ষণ চলছিলো কয়েকদিন ধরে। এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় বজ্রপাত হয় বাড়িটির পাশেই, জমিওয়ালার নারকেল গাছে।
ব্যস! এলাকাবাসী ধরে নেন, একে তো রমজান মাস! তার ওপর শুটিংয়ের মতো ‘পাপকাজ’ চলছে! ‘বাজ’ পড়ার এটাই কারণ! এখনই বন্ধ না করা হলে আরও কঠিন ‘শাস্তি’ নেমে আসবে! সৃষ্টি হলো ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ ইস্যু। শুটিংয়ের তখন আর মাত্র একদিন বাকি। বিপাকে ‘শঙ্খচিল’ টিম। চিন্তিত গৌতম ঘোষ। স্থানীয় গণ্যমান্যদের নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলোচনা চললো মধ্যরাত পর্যন্ত। সমাধান হলো কোনোমতে।
কিন্তু এই ঘটনাকে মাপকাঠি ধরে, ভাতশালা অধিবাসীদের মানসিক অবস্থান নির্ণয় করলে মিলবে না কিছুতেই। আমরা শুনছিলাম এলাকাবাসীদের আরেকটি ঘটনা। ছবির কাজ শেষ হলেই বাড়িটি ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন ‘শঙ্খচিল’ টিম।
কিন্তু বাধা দিয়েছেন এলাকাবাসী। যেখানে প্রসেনজিতের পা পড়েছে, এসেছেন গৌতম ঘোষ, যেখানে নির্মিত ‘শঙ্খচিল’, যা কি-না তাদেরই জীবন-সংগ্রামের-সংকটের প্রতিচ্ছবি; সেই বাড়ি তারা ভাঙতে দেবেন না। রেখে দিতে চান। স্মৃতি হিসেবে।
বাংলাদেশ সময় : ২১৫১ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ