কার্যত, ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই ভূখণ্ড শাসন করছে চায়নিজ জাতির লোকেরাই। আর চায়নিজদের প্রভাব দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে চায়না টাউনেই।
সিঙ্গাপুর যখন ব্রিটিশ শাসনে ছিল তখন স্থানীয়দের জন্যে দক্ষিণ সিঙ্গাপুরে বসবাসের জায়গা করা হয়। আর পশ্চিমারা বাস করতো উত্তরে। রাফেল নদী দিয়ে সিঙ্গাপুরকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যদিও এই নদী দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের খালের মতোই। এই খালের এক পাশে দক্ষিণ সিঙ্গাপুরেই অবস্থান চায়না টাউনের।
এজেএফ ফেলোশিপের অংশ হিসেবে একদিনের চায়না টাউন ট্যুর রয়েছে। ইতিহাসের অধ্যাপক ভিক্টর ঘুরে দেখালেন চায়না টাউন। শোনালেন এখানকার মানুষের অতীত আর বেঁচে থাকা সংগ্রামের গল্প।
এই বাজারে ব্যাঙ-সাপ-কচ্ছপ
চায়না টাউনের আন্ডারগ্রাউন্ডে কাঁচা বাজার। ভিক্টর আগেই বলে দিয়েছেন, বাজারে গেলে ছবি তোলা যাবে, তবে ক্রেতা বা বিক্রেতাদের যেন অসুবিধা না হয়।
দুপুরেও বাজারে বেশ ভিড়। মাছের বাজারের পাশেই কচ্ছপের বাজার। বড় বড় খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে কচ্ছপগুলোকে। কোনো কোনোটা খোলস থেকে মুখ বের করে রেখেছে। যেন দেখছে ক্রেতাদের। সবচেয়ে দীর্ঘায়ু প্রাণীগুলোর আয়ু আর বেশি দিন নেই।
তবে ভিক্টর শোনালেন, এখন সিঙ্গাপুরে আইনত কচ্ছপ ধরা অপরাধ। তবে এ বিষয়টি এড়িয়ে যায় সরকার। আবার অনেকেই এখান থেকে কচ্ছপ নিয়ে সাগরে ছেড়ে দিয়ে প্রশান্তি লাভ করেন।
অ্যাকুরিয়ামের মতো কাঁচের পাত্রেও জীবন্ত কচ্ছপ। তেমনি কচ্ছপের শুটকিও জীবনে প্রথম দেখা।
বেশ বড় আকৃতির ব্যাঙগুলো যেন হাঁপাচ্ছে। রাখা হয়েছে অ্যাকুরিয়ামের মতো খাঁচায়। আর বিভিন্ন আকৃতির সাপ বন্দি করে রাখা হয়েছে পাত্রে। ভিক্টর বলেন, এগুলোর কোনটিরই বিষ নেই। বিষধর সাপ খাওয়া যায় না।
মাছের বাজারে রয়েছে রেড গারৌপা, সিবাস, পোলাকাডো, টং সিং, এমপুরাউ। এগুলো বিশাল বিশাল আকৃতি মাছ। এছাড়াও বিভিন্ন আকৃতির চিংড়ি তো রয়েছেই। কাঁকড়ার মধ্যে দেখা মিললো গেলোসি মান্টিস এবং আলাস্কা কিংয়ের।
শহর দেখার জাদুঘর
সিটি হলে সিঙ্গাপুর সিটি মিউজিয়াম বা জাদুঘর। পুরো তিন তলা ভবন জুড়ে সিঙ্গাপুরের স্থাপত্যশৈলী উপস্থাপন করা হয়েছে। পুরো সিঙ্গাপুরের কোথায় কি ধরনের উন্নয়ন কাজ চলছে এবং কতোটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার একটি মডেল উপস্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকরা এই মডেল দেখে নিজেদের অবস্থান খুঁজতে থাকেন।
কোন দিক থেকে সিঙ্গাপুরকে দেখতে কেমন মনে হয়, তা উপভোগেরও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। আর এই উন্নয়নের পেছনে যেসব প্রকৌশলীর ভূমিকা রয়েছে, তাদের ছবি টানানো রয়েছে প্রথম তলাতেই।
শিশুদের জন্যে খেলার জায়গা রয়েছে এখানে। শিশুরা সিঙ্গাপুরকে কেমন দেখতে চায় বা নিজেদের বাড়ি কিভাবে বানাতে চায় সে চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে এখানে ভিডিও গেমসের মতোই খেলতে পারে তারা। এজেএফএ’র পরিচালক এলান জন আমাদের ঘুরে দেখালেন এই মিউজিয়াম। এখানেও রয়েছে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক বর্ণনা।
এছাড়াও গত দশ বছরে সিঙ্গাপুরে কি উন্নয়ন হয়েছে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি সেগুলোও এখানে ফাইল আকারে রাখা হয়েছে। এখানে কোন কিছু গোপনীয় নয়। চাইলেই যে কেউ উল্টিয়ে দেখতে পারেন পরিকল্পনা। কিভাবে জেলেদের একটি শহর পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী একটি দেশে পরিণত হলো তার ধারাবাহিক ইতিহাস অবলোকনের সুযোগ আছে এখানে।
বাড়ির কাছে সাগরপাড়
সিঙ্গাপুর বস্তুত জলঘেরা দ্বীপদেশ। উত্তরে মালয়েশিয়াকে পৃথক করা জোহর প্রণালী, দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপকে পৃথককারী সিঙ্গাপুর প্রণালী, পশ্চিমে মালাক্কা প্রণালীর দক্ষিণ মুখ আর পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ বেড় দিয়ে রেখেছে সিঙ্গাপুরকে। প্রভাবটা আসলে দক্ষিণ চীন সাগরেরই। কিন্তু দু'সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সাগর বা জলরাশির দেখা মেলে না। কেন্ট ভেলের পেছনে ক্লেমেন্টি উড পার্ক। সেটাকে পেছনে রেখে সোজা ১০ মিনিট হাঁটলেই ওয়েস্ট কোস্ট পার্ক।
পুরো পার্কটাই ছবির মতো। এখানে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হয় শহরবাসী। বেশ বড় কয়েকটি মাঠ রয়েছে এখানে। কিন্তু সেখানে হাঁটা যায় না বা বসা যায় না ঘাসের ওপর। বেঞ্চিতে বসতে হয়। না হলে সাগর পাড়ে।
পার্কের শেষ প্রান্তে মালাক্কা প্রণালী আর দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সিঙ্গাপুর প্রণালী। দক্ষিণ চীন সাগরের অংশ বলে এটাকে সাগরই বলেন স্থানীয়রা। সেখানে অলস সময় কাটাচ্ছে কয়েকটি জাহাজ। সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক সিয়ান বলেন, পুরো সিঙ্গাপুর ঘিরেই আসলে বন্দর। এই জাহাজগুলো গভীর সমুদ্র থেকে কার্গো থেকে মাল পরিবহন করে। তবে গভীর সমুদ্রে এই মুহূর্তে কার্গোর চাপ এখন অনেকটাই কম।
সাগরের বিশুদ্ধ বাতাস এখানে। কারণ এখানে বায়ুদূষণ নেই বললেই চলে। নেই হর্নের শব্দ। এই সাগর পাড় দেখলেই প্রতি দিন আসতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু এজেএফ এর ব্যস্ত রুটিন আসতে দেয় না প্রতিদিন। তবে ভাবতে ভাল লাগে, কেন্ট ভেলে দক্ষিণ চীন সাগরের বাতাসই পাওয়া যায়।
যুদ্ধ সাংবাদিকতার গল্প
ফিলিপিনের এএফপি'র রিপোর্টার ডেনিস সান্টোস। দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পরিচালিত অভিযানগুলোতে রিপোর্ট করেছেন তিনি। সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সঙ্গে তার ভ্রমণ, গোলাগুলির মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাওয়া, আবার অনেক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সঙ্গে তার বৈঠকের ছবি ও গল্প শিহরিত করে সবাইকে।
এজেএফ'এর রুটিন অনুযায়ী, সাংবাদিকরা নিজেদের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্যে একটি উপস্থাপনা পেশ করেন। একই দিনে শ্রীলংকার সাংবাদিক সানিকা এলটিটিই'র বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, মেয়ে হিসেবে এটা সহজ কাজ ছিল না। আমি নিজের মা এবং শাশুড়ি উভয়কেই মিথ্যা বলে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে স্বামীর সমর্থন অনুপ্রাণিত করেছে।
বর্তমানে ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। শ্রীলংকার যুদ্ধে এলটিটিই'র পক্ষে অংশ নেয়া শিশু যোদ্ধাদের স্মৃতি কাঁদায় সানিকাকে। যুদ্ধ বিষয়ে সাংবাদিকের গল্প অনুপ্রাণিত করে সবাইকে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
এমএন/জেডএম