ফেনী: সময়টা ২০১০ সাল। কেডস (জুতো) না থাকায় বিভাগীয় পর্যায়ে খেলা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সব অনিশ্চয়তা-সংগ্রামকে জয় করে এখন তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট বাংলাদেশ দলের তারকা অলরাউন্ডার, মো. সাইফউদ্দিন। এ তরুণ এখন তার আদর্শ ‘মাশরাফি’ হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর।
ফেনী শহরের শাহীন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক, জয়নাল হাজারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ফেনী সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে অধ্যয়নরত সাইফউদ্দিন। সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে তার সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলেন এ তরুণ তুর্কি।
সাইফউদ্দিনের ক্রিকেটের হাতেখড়ি স্থানীয় ফেনী ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট ক্লাবে। পরিবার থেকে মেলেনি সহযোগিতা, উল্টো সইতে হয়েছে বাধা। বাবা হারা বলে মা সাহস করেননি তার ছেলে খেলোয়াড় হোক। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক আর নেশায় সব বাধা জয় করে যখন ২০১০ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার মঞ্চে উঠে যান, তখন আর আগলে রাখতে পারেননি মা-ও। ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়ার গল্প বলেন সাইফ, ‘ক্রিকেট শৈশব থেকেই খেলি। ২০০৫ সালে আশরাফুল ভাই যখন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শতক করেন তখন সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে যায়। সেই থেকে ক্রিকেটের পেছনে ছুটে চলা। ’
তবে, মাশরাফির ব্যাটিং এবং বোলিং অ্যাকশনও তাকে টানতো। কিন্তু এই টান যে তাকে পেশাদারিত্বে টেনে নেবে হয়তো তা ভাবেননি। এখন সাইফ স্বপ্ন দেখেন মাশরাফির মতো একজন অলরাউন্ডার হয়ে ওঠার। ক্রিকেটে তার আনুষ্ঠানিক পথচলা ২০০৮ সালে। ফেনী ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট ক্লাবের মধ্যদিয়ে। এরপর ২০১০ সালে ফেনী জেলা দলের হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে (৫ ম্যাচে ২৭৮ রান) সর্বোচ্চ রান করে অনূর্ধ্ব-১৫ টিমে স্থান করে নেন। একই বছর অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে একটি সিরিজে দুর্দান্ত খেলে (৪৫০ রান, ২৪ উইকেট) জেতেন ম্যান অব দ্য সিরিজ পুরস্কার। ২০১১ সালে সুযোগ পান অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলার। তার দু’বছরের মাথায় ২০১৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে খেলার পর ডাক পড়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।
তারপর থেকে সাইফ তরুণ টাইগারদের নিয়মিত ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জায়গা পোক্ত করে নেন। এই দলের হয়ে ২০১৪ সালে সফর করেন ইংল্যান্ড। তার পরের বছর সফর করেন শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকা। চলতি বছর জিম্বাবুয়ে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে হোম সিরিজে ভালো করার পর সুযোগ হয় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে। মূলত ক্রিকেটপ্রেমীদের নজর কাড়েন বিশ্বকাপ খেলেই। এই আসরে বল হাতে ১৩ উইকেটের পাশাপাশি তুলে নেন ৭৫ রান। বিশেষত স্লগ ওভারে তার বোলিং নজর কাড়ে সবার। নজর কাড়ে ৭ নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংও। সাইফ পরিচিত হয়ে ওঠেন সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার হিসেবে।
তার বাবার নাম আবদুল মালেক। তিনি পুলিশের প্রয়াত হাবিলদার। সাইফ মনে করেন, বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে এতো সংগ্রাম করতে হতো না। তবু মা আগলে রেখে এগিয়ে দিয়েছেন এতোটা পথ। সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের শিবপুর বড়তলী গ্রামে সাইফের জন্ম। ফেনী ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট ক্লাবের হাত ধরে তার মাঠে-ময়দানে পরিচিতি।
সাইফের সংগ্রাম নিয়ে কথা হয় তার শৈশবের ক্রিকেট প্রশিক্ষক শরীফুল ইসলাম অপুর সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেটি আজকের অবস্থানে এসেছে। কখনো ব্যাট ছিল না, কখনো ছিল না জুতো। কিন্তু সে থেমে থাকেনি। কাছের মানুষের সহযোগিতায় সাইফ এগিয়ে গিয়েছে। ’
নিজের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে সাইফউদ্দিন তৃণমূল থকে খেলোয়াড় তুলে আনতে কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন। বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে লিগগুলো ঠিকমতো হলে গ্রাম থেকে আরও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসবে। ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সরকারের একার প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব নয়। ’
ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এ তরুণ তুর্কি বলেন, ‘সামনে এখন একটাই লক্ষ্য জাতীয় দলের হয়ে খেলা। যে মানুষগুলো আজ এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, তাদের কিছুই দিতে পারিনি। জাতীয় দলে যদি খেলতে পারি, তা হবে সে মানুষগুলোর জন্য উপহার। ’
সাইফের মা জোহরা বেগমও বুকভরা স্বপ্ন দেখছেন ছেলেকে নিয়ে, তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘আমার ছেলে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলবে, বিশ্বে নাম করবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬
এমআরপি