চট্টগ্রাম থেকে : ভারতীয় সংস্কৃতি তথা বলিউডের গানের তালে নাচছে বাংলাদেশি তরুণ সমাজ। তথাকথিত আইটেম নাম্বারের নতুন নতুন সুরে বুঁদ তারা।
বাংলাদেশি গণমাধ্যম স্বাধীনতার পর থেকে এগুলোকে সমর্থন করে আসছে। আছে ভারতীয় চ্যানেলের থাবাও। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে গ্রাম-গঞ্জ ও শহরে চিত্রটা অভিন্ন। ঊর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো বলে গড়ে উঠেছিলো প্রতিরোধ, আদায় হয়েছিলো বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার ও স্বাধীনতা। এখন সেই স্বাধীনতা ও অধিকার আমরা হেলায় নষ্ট করছি। কীভাবে?
হিন্দি এখন কোনো চাপ নয়, কারণ নিত্যনতুন বাহারি গান, সিনেমা ও সিরিয়ালের মাধ্যমে হিন্দি ভাষা গ্রহণ করছে তরুণ প্রজন্ম। এটা যে বাংলা ভাষার জন্য হুমকি, সেটা কেউ মনেও করছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের নিজস্ব সংস্কৃতি কতোটা সুরক্ষিত? তাদেরকে হিন্দির সঙ্গে সইতে হচ্ছে বাংলা ভাষার চাপও!
এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায়। পড়াশোনা ও পারিবারিক সূত্রে এই নৃ-গোষ্ঠীর অনেক তরুণ-তরুণী থাকছেন চট্টগ্রাম শহরে। নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে কেমন আছেন তারা? বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) আড্ডা দিয়েছে বাংলানিউজ। তারাই তুলে ধরেছেন সংকটগুলো। অাছে প্রত্যাশার কথাও।
উমেসিং মারমা ঊর্মি পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় বর্ষে আছেন বাংলা নিয়ে। তিনি মনে করেন নিজেদের সংস্কৃতি থেকে অনেকখানি সরে এসেছে তরুণ সমাজ। এর কারণও সুষ্পষ্ট। তার মতে, তাদের ছোটবেলায় নিজস্ব উৎসবগুলোও যে ব্যাপক আকারে হতো, এখন সেগুলোও হয় না। জীবন-জীবিকা ও পড়াশোনার চাপে অনেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এ কারণেই তেমনটা চোখে পড়ে না। নিজেদের এলাকা ছাড়া এমনটা ভাবাও যায় না।
ঊর্মি বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলায় গান-নাচ প্রভৃতি কর্মকান্ড চলছে। কিন্তু স্বল্প পরিসরে। ধরা যাক, একজন আদিবাসী শিল্পীর অ্যালবাম বের হলো। সেটা কিন্তু প্রচারের আলোয় আসছে না। যতখানি সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে দমে যাচ্ছে একেকজন সংস্কৃতিকর্মী। ’
এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়ও বাতলেছেন ঊর্মি। তার মতে, সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালিরাই পারেন সহযোগিতার হাত বাড়াতে। তিনি বললেন, ‘টিভি খুললেই নানারকম রিয়েলিটি শো দেখা যায়। আমাদের নিয়ে এমন একটা আয়োজন হতে পারে না? এটা হলে অন্তত কিছুটা হলেও আমাদের প্রতিনিধি পাওয়া যাবে জাতীয় পর্যায়ে। আমরা আশা করি এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’
চবির আরেক শিক্ষার্থী অ্যাঞ্জেলা থিগিদী পড়েন প্রথম বর্ষে, ইংরেজি বিভাগে। তার বাড়ি ময়মনিংহের হালুয়াঘাট। তিনি গারো। মা-বাবার চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো নিজস্ব বর্ণমালাই নেই। আমরা যা কিছু লিখছি ইংরেজি অক্ষর দিয়ে। আর শুনে শুনে ভাষাটা টিকে আছে। এভাবে কতদিন? আমরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। কোনো বাঙালির সঙ্গে আমাদের কোনো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তাকে হারাতে হয়। কারণ তার পক্ষে আর নিজের ভাষা-কৃষ্টি নিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। ’
অ্যাঞ্জেলা জানান, এই আড্ডায় উপস্থিত চারজনই মারমা। এখানে তিনিই একমাত্র গারো। একই চিত্রের মুখোমুখি হতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি মনে করেন, ওদের চেয়েও বেশি চাপে আছে তার ভাষা ও সংস্কৃতি।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্মরাজ তন্চংগ্যা। তিনি নাট্যকলা নিয়ে পড়ছেন দ্বিতীয় বিভাগে। তার কথায়, ‘আমার ব্যাচে সবাই বাঙালি। আমি একমাত্র আদিবাসী। দেখা গেলো আমার বাসা থেকে কেউ ফোনে কল করলেন। আমি হয়তো তন্চংগ্যা ভাষায় কথা বলছি। ওরা তখন হাসাহাসি করে। বিষয়টাকে তারা সহজভাবে নেয় না। এটা এক ধরনের তাচ্ছিল্য। এমন হয় যে, পরেরবার হয়তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলি। কারণ আমি হাসির পাত্র হতে চাই না। এই ঘটনাটার মাধ্যমেই অনেক কিছু আঁচ করা যায়। ’
ধর্মরাজের অভিমত- সংস্কৃতির বিকাশ এভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক কিছু নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করার ইচ্ছে থাকলেও শেষমেষ দমে যেতে হয়। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। সেটা রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। তিনি মনে করেন, এই নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে নেতা তৈরি হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু একজন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি উঠে আসছেন না।
মংক্য থোয়াই মারমাও চবির ছাত্র। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়ছেন দ্বিতীয় বিভাগে। তিনি বলেন, ‘চর্চা করার মধ্য দিয়েই সংস্কৃতি রক্ষা করা হয়। কেউ যখন তার ভাষায় কথা বলবে না তখন এমনিতেই সেটা বিলীন হয়ে যাবে। সংস্কৃতি রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার ভাষা। কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, একটি বড় দৈনিক পত্রিকায় আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করছে না। এটা হয়তো চাপ থেকেই লেখা হচ্ছে না। হয়তো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লিখলেই তারা স্বস্তি বা নিরাপদ বোধ করছেন। ’
মিথিলা মারমা বিবিএর ছাত্রী। তিনি পড়ছেন চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মতে, ভাষার জায়গাটাতেই তারা কোনঠাসা হয়ে আছেন। এ ক্ষেত্রে গান বা নৃত্যে এগোবেন কী করে! ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে যেমন বাংলা শিখেছেন, একইভাবে শিখেছেন মারমা ভাষাও। খুব বেশি দরকার না হলে তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করেন না। বাংলাতেই চলে কাজ।
মিথিলা বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা শহরে। এই সব আদিবাসীর বিভিন্ন ভাষার গান আছে। সেগুলো শোনা হয় না। কারণ টিভি খুললেই আমি হিন্দি বা বাংলা ভাষার গান বা মিউজিক ভিডিও দেখছি। মিডিয়ার কল্যাণে আমি এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের নিয়ে টিভিতেও কোনো অনুষ্ঠান হয় না। আমাদের বিভিন্ন উৎসব ঘিরেও কোনো আয়োজন থাকে না টিভিতে। আমার মনে হয়, আমাদের প্রতি আপনাদের আগ্রহও কমছে। ’
মং সিং উ মারমা বান্দরবান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন। তৃতীয় বর্ষে আছেন তিনি। মং মনে করেন, আলোচনায় সবকিছুই উঠে এসেছে। নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি তাদেরকেই আরেকটু যত্নশীল হতে হবে। তার ভাষ্য, ‘কারও পক্ষেই আত্মপরিচয় ভুলে থাকা সম্ভব নয়। সংস্কৃতি নিয়েই ভবিষ্যতের পথে হাঁটবো আমরা। ’
** বাংলানিউজের জন্য আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে গানের ভিডিও :
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এসও/জেএইচ
** সুখবর দিলেন চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা
** নাম নয়, বদলে যাবে চেহারা
** চট্টগ্রামে চলে না আঞ্চলিক ও আধুনিক গান
** চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্র আশা জাগানিয়া
** শেফালী ঘোষের ভিটেমাটি ঘুরে
** চট্টগ্রামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরও দুটি প্রেক্ষাগৃহ
** বন্দরনগরীতে এখনও মুনমুন