বগালেকের সরকারি উচ্চতা ২ হাজার ৯ শত ফুট, যদিও আসল উচ্চতা জিপিএস যন্ত্র দ্বারা মেপে পাওয়া গেছে ১১৭৬ ফুট ± ৫০ফিট। এখানে পৌঁছানের পর গাইড সহ সবাইকে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক, তাই আমরাও ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করি।
ব্যাগ থেকে সাবান শ্যাম্পু নিয়ে দলবেঁধে বগালেকে নেমে যাই, কারণ গোসল করতেই হবে। বগালেকের পানির বৈশিষ্ট্য এমন- শরীরে যত ক্লান্তি, সব নিমিষেই শুষে নেয়। গোসল শেষ করতে করতেই শাহনেওয়াজ ও রেজওয়ান দুজনের পায়ের মাংসপেশীতে টান পড়ে। ওদের কাছে তেমন কোনো ওষুধ নাই। তাই ওদের আশ্বস্ত করি। বলি চল, ঘরে যাই আমার কাছে পর্যাপ্ত ব্যথানাশক ওষুধ আছে। গোসল শেষে আমরা ভাত খেতে বসি। ধোঁয়া উঠা গরম ভাত শরীরে নতুন ওম এনে দেয়। এখানে পাহাড়ি চালের ভাত অনেক বল। সাথে মিষ্টি কুমড়া ও ডাল, ডিমভাজি- সাক্ষাত অমৃত। খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা রং চা খাই ঘরের দোতালার বারান্দায় বসে। আমাদের চেয়ে সুখী মানুষ, আর কে আছে এখন?
রাত আটটা পর্যন্ত দলেদলে ট্যুরিস্ট দল আসতে থাকে। কেউবা আমাদের মত হেঁটে, কেউবা গাড়িতে ১১ মাইল পর্যন্ত, তারপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বগালেক এসেছে। মোরসালিন ও তার দলও এসেছে; ওরা কালকে যাবে কেওক্রাডাং পর্যন্ত। আমাদের আশে পাশের সব ঘরই ভাড়া হয়ে গেল, আটটা ত্রিশ মিনিটে সিয়াম দিদির ডাক- ‘আনোয়ার ভাই, আপনার দল সহ ভাত খেতে আসেন। ’ ভাত খাওয়ার পর আমরা রং চা খাই, আদা দেওয়া, ভালোই লাগে। রাতে নয়টার দিকে রেজওয়ান এসে জানালো ওর বাম হাঁটুতে খুব ব্যাথা। আমার ব্যাগে ব্যাথা নাশক ঔষুধ ছিল, সেখান থেকে ওকে রাতের এবং কালকে সকালের জন্য দুই ডোজ ওষুধ দিলাম। তারপর সবাই মিলে ঢালাও বিছানায় ঘুমাতে গেলাম। রাত কোনদিক দিয়ে গেল, কেউ বলতে পারি না।
আমি সবসময় ঘুম থেকে উঠি ভোর ছয়টায়। বগালেকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উঠে দেখি রেজওয়ান ও শাহনেওয়াজ তখনো ঘুমায়। ওদের ঘুম থেকে তুলে একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তার পর সকালের নাস্তা খেলাম, মেনু ছিল- খিচুড়ি, ডিমভাজা ও মিষ্টি কুমড়ার তরকারি। এরপর এক কাপ আদা চা খেয়ে আমরা রওনা হলাম সকাল সাতটা বিশ মিনিটে, লক্ষ্য যাদিপাই ঝর্না।
বগালেক থেকে চল্লিশ মিনিট জোর কদমে হাটলে বড় একটা ঝরনা পড়ে, যার স্থানীয় নাম চিংড়িঝিরি। এই ঝরনাটা অনেক সুন্দর, প্রায় চারটা ধাপে নেমে এসেছে তারপরে একে-বেকে চলে গেছে নিচের দিকে। ঝর্না দেখে রিজওয়ান পাগল, যত কাছে যাওয়া যায়, গিয়ে ছবি তুলবে। ওকে আমাদের গাইড লালের সাথে পাঠালাম আগে, পিছনে রওয়ানা হলাম আমি ও শাহনেওয়াজ। ১০ মিনিট ধরে আমরা সবাই এখানে ঘুরলাম, ভিজলাম আর অনেক ছবি তুললাম। এই ঝরনা থেকে নামতে আমাদের প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগল, তারপর আবার আমাদের হাঁটা শুরু হলো।
নানা রকম চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আমরা যখন যাত্রী ছাউনিতে পৌঁছালাম তখন সকাল সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। ‘যাত্রী ছাউনি’ ব্যাপারটা হলো একটা টিনের ঘর, যা রুমা বাজার গাইড সমিতি বানিয়েছে, ট্যুরিস্টদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
এখানে বসার পর রিজওয়ান বললো, ওর হাঁটুর ব্যাথাটা আবার হচ্ছে। আমার জেরার মুখে রিজওয়ান স্বীকার করলো- সকালের ব্যথানাশক ওষুধটাও খেতে ওর মনে ছিল না। আমার ব্যাগে প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স থেকে আবার ওকে ব্যথানাশক ঔষুধ দিলাম। কিছুক্ষণ পর ও নিজেই জানাল, ‘ব্যথা আর নাই ভাইয়া। ’ আমরা সকাল দশটায় পৌঁছালাম দার্জিলিং পাড়ায়। এখানে বেশ কয়েকটা চা দোকান আছে, যে কোনটায় চা খাওয়া যায়, কিন্তু যেহেতু মাত্র একটা দোকান খোলা সেহেতু সেখানেই আমরা চা খেলাম। দার্জিলিং পাড়া একটা বমপাড়া, এখানকার বেশির ভাগ লোকই জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে, ছেলে ও মেয়ে সবাই সমান পরিশ্রমী ও যথেষ্ট বিনয়ী। এখান থেকে কেওক্রাডাং পাহাড় মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। চায়ের দোকানে ১০ মিনিট বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম।
দার্জিলিং পাড়া থেকে পথ কিছুটা খাড়া, তাই আমরা আস্তে আস্তে এগোলাম। রাস্তাটা এখানে অনেক চওড়া, আদা তোলার মওসুমে এই রাস্তা দিয়ে চান্দের গাড়ি যায় পার্সিং পাড়া পর্যন্ত। হাঁটতে হাঁটতে আমরা কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি পৌছে থামলাম। আমার ব্যাগ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিল, সেটা বের করে আমরা বাঁশের লাঠিতে বেঁধে চূড়ায় উঠে ছবি তুল্লাম। হাত ঘড়িতে তখন তখন সময় বেলা দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। দশ মিনিট বিশ্রাম নিলাম এখানে।
কেওক্রাডং শব্দটার মানে হলো পাহাড়ের রাজা। এর ভৌগলিক অবস্থান: 215700 উত্তর ও 92 30 53 পশ্চিম। এখানে লাগানো সরকারি প্রস্তর ফলকে লেখা আছে এর উচ্চতা (১২৩০ মিটার) ৩১৭২ ফুট। জারমিন জিপিএস দ্বারা মেপে প্রকৃতপক্ষে উচ্চতা পাওয়া গেছে-২৮৯৭ ফিট ৫০ ফিট (৮৮৩ মিটার)।
জিপিএস মডেল ভেদে এবং পদ্ধতি ভেদে এই পাহাড়ের উচ্চতা বিভিন্ন রকম। এখানে একটি বিশ্রাম ঘর আছে। এই পাহাড়ের মালিকের নাম লালাবম, যিনি এখানে চমৎকার একটি রেস্টুরেন্ট ও কটেজ খুলেছেন, পর্যটকদের আবাসন চাহিদা ও খাদ্যে দ্রব্যের চাহিদার কথা চিন্তা করে। আমরা এখানে থেকে রওনা দিলাম সকাল সাড়ে দশটার সময়। দশ মিনিটেই আমরা পৌঁছে গেলাম পাসিং পাড়ায়। পাসিং পাড়া একটা নতুন পাড়া। এই পাড়াটা এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্রাম, যার উচ্চতা ২৯৮৭ ফিট। এর চাইতে উচুতে বাংলাদেশে আর মানুষ বসতি নেই। আগে সাইকত পাড়া ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মানুষ বসতি, কিন্তু পাসিং পাড়া হবার পর, এই সম্মান পাসিং পাড়ার দখলে। এই পাড়ার আরেকটা বৈশিষ্ট হলো এটি একটি মিশ্র পাড়া। এখানে আদিবাসীদের দুটি সম্প্রদায়- বম ও মুরং একসাথে বসবাস করে।
এখান থেকে আশে-পাশের দৃশ্য, অন্তত মনোরম। বিশেষ করে সূর্য উদয় ও অস্তের ছবি এখানে খুব সুন্দরভাবে তোলা যায়। পাসিং পাড়া ফেলে সামনে আগালেই হাতের বামে পড়বে কেনান আবাসিক স্কুল। আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক এই স্কুলটি, এক অনন্য বিদ্যাপীঠ। পড়া-শোনার পাশা-পাশি এখানে ছাত্রদের শেখানো হয় চাষাবাস, জুম পদ্ধতিতে। কোনান স্কুল ফেলে আমরা দ্রুত এগিয়ে চলি, উদ্দেশ্য যাদিপাই পাড়া। সামনে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে বামে আর অন্যটা ডানে, বামের রাস্তায় যাওয়া যায়, তাজিং ডং হয়ে থানচি, সেই পথের গল্প অন্য কোথাও বলবো। ডানের রাস্তা ধরে ত্রিশ মিনিট একটানা নামার পর, যাদিপাই পাড়া শুরু। যাদিপাই পাড়ার চার্চ ঘরটা, গ্রামের সবচেয়ে বড় বাড়ি ও সুন্দর সমতলে তৈরি। পটে আঁকা ছবির মতো এই গ্রাম ছেড়ে কিছুটা আগালেই আবার নামার ঢালু পথ। পাসিং পাড়ার পর থেকেই সারা রাস্তা শুধু নেমে যাওয়া। প্রায় এক হাজার ফিট খাড়া নেমে যাওয়ার পর এক বিশাল পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় আমরা পৌঁছালাম। এখানে পাহাড়িরা বাদাম ও আলু চাষ করে মৌসুমে। এখানে পায়ে হাটা পথে এগিয়ে চলা কিছু দূর, তারপর একটা বড় পাকুড় গাছের পাশ দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে যাদিপাই ঝর্নায়। এখানে থেমে আমরা ১০ মিনিট বিশ্রাম নেই। তারপর আবার আমাদের নামা শুরু হয়।
আমি এই নামার পথের ব্যাপারে পাঠকদের সাবধান করে দিতে চাই। এই জায়গায় মাটি অত্যন্ত ঝুরা মাটি এবং আলগা, যা পা দিতেই গুড়া হয়ে সরসরিয়ে নীচে নেমে যায়। তাই এই পথে খুব সাবধানে ভারসাম্য রেখে নামতে হবে। পথটা মাত্র ১০ মিনিটের, কিন্তু সারা যাত্রা পথের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ হলো এইটুকু। কাজেই দরকার হলে বসে বসে, আস্তে আস্তে নামা ভালো। রিজওয়ান আমার সাথে নামছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শাহনেওয়াজকে নিয়ে, ওর পা প্রায় নিচের দিকে ছিটকে যাচ্ছিল, কাজেই আমি ওকে বল্লাম, নেওয়াজ তুমি বসে বসে আসো। ঝর্নার শব্দে টের পাচ্ছিলাম আমরা যাদিপাই ঝর্নার প্রায় কাছে পৌঁছে গেছি।
আমার হাত ঘড়িতে যখন দুপুর ১২.৪০ মিনিট আমরা তখন পৌঁছে গেছি যাদিপাই ঝর্নায়, রিজওয়ান ঝর্না দেখে মুগ্ধ, তখন সবে বর্ষার শেষ। কাজেই ঝর্নার পানি স্রোতের তোড় খারাপ না, রিজওয়ান, শাহনেওয়াজ ও আমি, আমরা সবাই এখানে গোসল করে গ্রুপ ও সিঙ্গেল ছবি তুলে নিলাম। প্রায় ৮০ ফুট উচু হতে গুম গুম শব্দে অজস্র সাদা ফেনার স্রোতধারা পাহাড়ের তলদেশে শীতলতা নিয়ে আছড়ে পড়ছে আমাদের সামনে। পানিটা এখানে এত পরিষ্কার ও ঠান্ডা নিমিষেই চাঙ্গা করে দেয়, দেহ মন। দুপুর তিনটার আগে এই ঝর্নায় আসলে পানিতে দুইটা রংধনু সবসময় দেখা যায়। কারণটা হলো- উপর থেকে তীব্র বেগে পড়ে পানির কনাগুলো বাষ্পের মত সাদা ধোঁয়াশা তৈরি করে। এই ধোঁয়াশায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হযে জন্ম নেয়, রংধনু। এইখানে এই অসমাপ্ত, অবিরাম স্রোতধারার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়,
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।
ফেরার পথে উঠে আসতে হবে এতক্ষণ যে রাস্তা দিয়ে আমরা নেমেছি, সেই রাস্তা দিয়ে। কাজেই দেরি না করে দুপুর একটার দিকে আমরা রওনা দেই, উদ্দেশ্য-বগালেক। দশ মিনিট পরে আমরা সমতল উপত্যকাতে পৌঁছাই। এখান থেকে যাদিপাই ঝরনা দেখা যায় না, শব্দও শুনা যায় না। রিজওয়ান বললো, ‘কে বিশ্বাস করবে এত সুন্দর ও এতো বড় ঝর্না এই পাহাড়ের ফাঁকে লুকানো আছে?’ আমি ওর কথা শুনে মনে মনে হাসলাম, আরো কত সুন্দর ঝর্না আছে আমাদের এই বাংলাদেশে, তা যদি ওরা জানত।
আমরা দেরি না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলি। দুপুর ২টা বেজে ৪০ মিনিটে আমরা পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত অবস্থায় পাসিংপাড়া পৌঁছাই। যাবার সময় আমার পরিচিত এক আদিবাসির বাড়িতে ভাত রান্নার কথা বলে গিয়েছিলাম। সেখানেই আমরা খাওয়া, দাওয়া করি। তেমন আহমরি কোনো আয়োজন না, পাহাড়ি চালের ভাত, ডাল আর মিষ্টি কুমড়ার তরকারি। তাও আমরা গোগ্রাসে গলাধকরণ করি। রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজ দুজনই একমত হয় যে, এতো মজার রান্না তারা জীবনে কখনো খায়নি। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা রং চা খাই, একটু বিশ্রাম নেই, এদিক-ওদিক ছবি তুলি। আমার হাত ঘড়িতে যখন ঠিক ৩টা বাজে আমরা ফিরতি পথে রওয়ান দেই। পেট ভরা থাকায় পা দ্রুত চলতে থাকে আমাদের, খুব দ্রুতই আমরা পৌঁছে যাই কেওক্রাডং-এর চূড়ায়। একই দিনে দুইবার কেওক্রাডং উঠলাম আমরা। এখান থেকে দার্জিলিং পাড়া নেমে আসতে আমাদের সময় লাগে ঠিক ২০ মিনিট। নেমে এসে আবার চা বিরতি। চা, বিস্কুট খেয়ে আমরা আবার হাঁটা দেই দুপুর সাড়ে তিনটার সময়।
যাদিপাই ঝর্না দেখে রিজওয়ান বিমোহিত। আমাকে বলে আমি বর্ষাকালে আসতে চাই যাদিপাই ঝর্নায়, আমি বলি পাগল নাকি? জবাবে ও বলে, একবার দেখবই আনোয়ার ভাই, এবং ওর পাল্লায় পড়ে সে পাগলামির কাজও আমাকে করতে হয়েছে। সে গল্প বলবো অন্য কোনো সময়। শাহনেওয়াজ বলে, মাধবকুণ্ড তেমন বড় ঝর্না না, যাদিপাই ঝর্নার সামনে। যাদিপাই ঝর্না হলো, যাদিপাই ঝর্নার মতো। কারো সাথে এর তুলনা হবে না। এমন জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে করতে ৩ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই বগালেক।
আমার হাত ঘড়িতে তখন বাজে ৬.৪০ মিনিট। পাড়ায় ঢুকে প্রথমে আমরা আমাদের ঘরে যাই। গোসলের কাপড়-চোপড় ও গামছা, শ্যম্পু ও সাবান নিয়ে আমরা টুপ করে নেমে যাই বগালেকে। সারা শরীর বগালেকের পানিতে ডুবায়ে আমরা ৩ পর্বতারোহী, আমাদের সারাদিনের কার্য-কলাপ নিয়ে পর্যালোচনা করি। আমিতো জানি পথটা কেমন, তাই আগ্রহ নিয়ে আমি রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজের কথা শুনি। দুজনেই যার পর নাই খুশি, বলে আপনার সঙ্গে ভাগ্যিস রাস্তায় দেখা হয়েছিল। ওদের বন্ধু মুরসালিন ও তার দল ফেরত এসেছে কেওকাড়াডং হতেই। ওরা যাদিপাই ঝর্নাতে যায় নাই। অথচ আমরা প্রথম বারেই যাদিপাই ঝর্না দেখে আসলাম, এই আনন্দে তাদের মুখের হাসি আকর্ন বিস্তৃত। আমি ওদের বুঝাই, ব্যাপারটা এমন না। এই খেলায়, যার নাম পর্বতারোহন, এতো কোন হারজিত নাই। যারা পারে তাদের পুরস্কার এটাই যে, তারা প্রকৃতির অপরূপ কিছু সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পায়। এখানে কে পারলো, আর কে পারলোনা তা বড় ব্যাপার না, তুমি কি পারলা, কি করলা, সেটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
পাহাড়ের পাশে বগালেকে আমরা গলা পর্যন্ত পানিতে গা ডুবায়ে বসে থাকি। লেকের পানিতে শরীরের সব ক্লান্তি ধুয়ে যায়। ডাক্তার ভাষায় একে বলে ওয়াটার থেরাপি। কিছু রোগীকে ভাল হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় পানিতে বসে থাকতে হয়, এটাই একমাত্র চিকিৎসা। আমার ধারণা বগালেগের পানিতে এমন কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আছে, যা আপনার ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর করে দিবে। আরও একটা মজার ব্যাপার হলো, বগালেকের পানিতে বহু ছোট ছোট মাছ আছে, যাদের কাজ হলো আপনি পানিতে নামলেই আপনার শরীর থেকে এরা মরা চামড়া খেয়ে যাবে। আপনার মনে হবে যেন আপনাকে চিমটি দিচ্ছে।
আমি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম মালয়েশিয়ায়, সেখানে দেখলাম এক কফির দোকান, নাম ডক্টর ফিসি। এই দোকানে আপনি কফি ছাড়া আর একটা সেবা পাবেন। জুতা-মুজা খুলে আপনার দু পা কফি খেতে খেতে ডুবিয়ে রাখুন সামনে রাখা ছোট্ট অ্যাকুরিয়ামে। এই অ্যাকুরিয়ামে অনেক ছোট মাছ সাগ্রহে অপেক্ষা করছে, তাদের লক্ষ্য আপনার পায়ের তলদেশের ও গোড়ালির মরা চামড়া খেয়ে পরিষ্কার করা। প্রতি আধা ঘণ্টার এই সেবার জন্য দিতে হয় আমাদের দেশের টাকায় প্রায় ছয়শ’ টাকা, আর বগালেকে এসে এই সেবা পাবে একদম ফ্রিতে। গোসল শেষ করে ঘরে ফিরতেই সিয়াম দিদির ডাক, ‘আনোয়ার ভাই আপনার দল নিয়ে ভাত খেতে আসেন’ আমার রেডি হয়ে ভাত খেতে আসি। পাহাড়ি চালের ধোঁয়া উঠা ভাত, ডাল, ডিম ও চাল কুমড়ার তরকারি আমরা বুঙুক্ষের মতো গলাধকরণ করি। ‘যেই আমি কিনা গুলশান-১ হতে গুলশান-২-এ যাই রিক্সায়, সেই আমি আজ হেঁটেছি প্রায় ১০-১১ ঘণ্টা’। রিজওয়ান চোখ বড় বড় করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে। ওর বলার ভঙ্গিতে আমরা সবাই হেসে উঠি। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা খোলা আকাশের নিচে বসে চা খাই, এখানে আকাশের তারাগুলি অনেক সজীব, সুতীব্র ও জ্বলজ্বলে।
আমাদের গাইড লালকে আগে থেকে বলা ছিল ও কাঠ এনে আগুন ধরায়। আমরা বারবিকিউ করব একটা মুরগি। সিয়াম দিদি সারা সন্ধ্যা মসলা মেখে মুরগীর মাংসগুলোকে ভিজিয়ে রেখেছিল। আমরা কয়লা তৈরি করে, নেট বসিয়ে তার উপর মসলাসিক্ত মাংসগুলোকে বিছিয়ে দেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশে-বাতাসে ভাজা মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর বারবিকিউ এর মাংস খেয়ে, কোক খেয়ে আমরা আমাদের ঘরে ঘুমাতে যাই।
পরদিন ভোরে উঠে রেজওয়ান ও শাহনেওয়াজকে নিয়ে সকাল ৮টার সময় আমি রওনা দেই ১১ মাইল, কারণ গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি যে, সেখানে একটি চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে অছে। ওই চান্দের গাড়ি নিয়ে এক ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাই রুমা বাজার। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মামুনের হোটেলে শেষ করে আমরা রওয়ান দেই বান্দরবান। আবার চড়াই-উৎরাইয়ের ৫২ কি.মি. পথ অতিক্রম করে আমরা যখন বান্দরবান নামি তখন হাত ঘড়িতে বাজে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। রাত নয়টার ঢাকায় যাবার টিকিট করে আমরা ভাত খেতে যাই ‘কিং অফ বান্দরবান হোটেলে। ’
খাওয়া শেষে আমরা বার্মিজ বাজার ঘুরি, বাসার জন্য আমি কিনি আচার, আর রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজ ওদের বাসার জন্য লুঙ্গি ও আচার কিনে। বাসে বসে আমরা আমাদের মোবাইল নম্বর সেফ করে নেই। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত শরীর ও চাঙ্গা মন নিয়ে আমরা ঢাকায় নামি। আবার দেখা হবে নতুন কোনো অভিযানে- এই কামনায় পা বাড়াই আপন ঠিকানার দিকে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-[email protected] এই ঠিকানায়।
** বগালেকে সিয়াম দিদির কটেজে...
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৫