মুম্বাই থেকে: শাহরুখ খানের শহর মুম্বাই, সালমান খানের শহর মু্ম্বাই, শচিন টেন্ডুলকারের শহর মুম্বাই, দুনিয়া কাঁপানো বলিউডের শহর মুম্বাই। গত ২৯ মার্চ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালের সংবাদ সংগ্রহের লক্ষ্যে মুম্বাই শহরে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিল কখন যাব বলিউড সুপারস্টারদের ডেরায়! অবশেষে সেই ইচ্ছা পূর্ণ হলো।
০৩ এপ্রিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে বিশ্বকাপ ফাইনাল, তাই রাতেই কলকাতায় ফেরার তাড়া থাকায় দেখা হয়নি শচিনের বাড়ি ও বলিউড।
যা হোক কাজটি অবশ্য আগেই করতে পারতাম। কিন্তু মুম্বাই আসার পর এখানকার হোটেল কর্তৃপক্ষের বাজে আচরণের প্রভাব ও সেমিফাইনালের ব্যস্ততার কারণে সেটা গত দুইদিনে আর হয়ে উঠেনি। তাই শুক্রবার (০১ এপ্রিল) সকালেই মনস্থির করলাম শাহরুখ ও সালমানদের ডেরা দেখতে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ।
আগের দিন সেমিফাইনালের ব্যস্ততায় ক্লান্তি থাকলেও বেরিয়ে পড়লাম আমি, আমার সহকর্মী শোয়েব মিথুন, গাজী টিভি’র ভারপ্রাপ্ত ক্রীড়া সম্পাদক তাইব অনন্ত ও চ্যানেল আই’র ক্রীড়া প্রতিবেদক আরিফ চৌধুরী।
শাহরুখ-সালমানরা যেখানে বাস করেন জায়গাটির নাম বান্দ্রা। আমাদের হোটেল থেকে দেড় ঘণ্টার ড্রাইভ। দুপুর ১টায় মুম্বাই মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে ট্যাক্সি ছুটিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে যেতে যেতে চোখে পড়ছিল মুম্বাইয়ের আধুনিক, অভিজাত ও রুচিসম্মত সব রাস্তা ও ভবনগুলো। সত্যিই, কী যে আধুনিক চিন্তাধারায় প্রতিটি রাস্তা ও ভবন গড়ে তোলা হয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। অবশ্য এমন আধুনিক না হবার কোনো কারণও নেই। কেননা ভারত বর্ষের অর্থের চাকা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন সেই মুকেশ আম্বানি, রতন টাটা আর গোরি গাঁও অর্থাৎ বলিউড ফিল্ম সিটির অবস্থান এই মুম্বাইয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বান্দ্রায়। তাই বান্দ্রাতো বটেই, মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে সেখানে যাবার পথের রাস্তা ও স্থাপত্যের আভিজাত্য আমাদের বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছে। শুধু রাস্তা বা ভবনই নয়, মুম্বাইয়ের কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া আরব সাগরের নীল পানি ও নির্মল বাতাস আমাদের সেমিফাইনালের ক্লান্তি কিছুটা হলেও মুছে দিয়েছে।
এভাবেই বান্দ্রার পথে যেতে আধুনিক মুম্বাই ও আরব সাগর দেখতে দেখতে এক সময় চোখে পড়ে সাগরের মধ্যে তৈরি সুরম্য একটি মসজিদ। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে মসজিদটির সৌন্দর্য আমাদের এতটাই বিমোহিত করলো যে, গাড়ি না থামিয়ে, ছবি না তুললে যেন আমাদের এই যাত্রাটিই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। ট্যাক্সি থেকে নেমে ছবি তুলে স্থানীয় একজনকে মসজিদের নাম জিজ্ঞেস করাতে তিনি উত্তর দিলেন, ‘এটা হাজিআলী মসজিদ’। মসজিদ দেখে যতটা না অভিভূত হয়েছিলাম, তার চেয়েও অভিভূত হয়েছি মসজিদে যাবার পথের নির্দেশনা শুনে।
সেই ব্যক্তির ভাষ্যমতে ‘মেরিন ড্রাইভ রোড থেকে কেউ যদি এই মসজিদে যেতে চান, তাহলেও আপনাকে যেতে হবে ভাটার সময়। কেননা জোয়ারের সময় মসজিদের চারপাশসহ রাস্তাটি ডুবে থাকে। একমাত্র ভাটার সময়ই ওখানে যাওয়া যায়। ’ তার মুখ থেকে একথা শুনে মনে হচ্ছিল যেহেতু এখন ভাটি চলছে তাই ঘুরে আসি। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম থাকায় অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে ফিরে এসেছি।
যা হোক ‘হাজীআলী’র সৌন্দর্য দেখার পর আবার আমাদের ট্যাক্সি ছুটে চললো। সাগরের পাড় ধরে যেতে যেতে একটা সময় ট্যাক্সি উঠে পড়লো একটি ঝুলন্ত সেতুতে। সেতুটির কারুকার্য এতো সুন্দর ও উন্নত যে, নাম জানার আগ্রহ ধরে রাখতে পারলাম না। চালককে নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন ‘রাজীব গান্ধী’ সেতু। মুম্বাইয়ের এপার থেকে ওপারকে সংযোগ করতে আরব সাগরের উপর দিয়ে তৈরি করা সেতুর সৌন্দর্যে যে কেউই আরেকবারের জন্য হলেও এখানে আসতে চাইবেন।
রাজীব গান্ধী সেতু পার হওয়ার পর পরই একটি সবুজাভ প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং আরও আধুনিক-সুসজ্জিত বাড়ি ও স্থাপত্য আমাদের চোখের প্রশান্তি বাড়িয়ে দিল। গাড়ি যখন ওই সবুজ পথ ধরে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল ছোট ছোট পাহাড় কেটে এখানকার রাস্তা ও বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়ি, গাড়ি, অফিস, শপিংমলে লেগে আছে স্বচ্ছলতার ছাপ। বান্দ্রাবাসীর এমন স্বচ্ছলতা দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাদের গাড়িটি একটি বাড়ির সামনে এসে থামলো। দেখলাম কালোর মধ্যে সিলভার রঙের একটি বড় প্রবেশ দ্বার। তার পাশেই লেখা ‘মান্নাত’। বেশ শান্তভাবেই আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে দেখি কয়েকশ মানুষ। কেউ বসে আছেন, আবার কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। কেউবা সেই বাড়ির সামনে ছবি তুলছেন।
বুঝতে বাকি রইল না যে, এরা সবাই শাহরুখ ভক্ত। ওখানে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে তারা অপেক্ষা করছেন প্রিয় সুপারস্টারের জন্য। কখন আসবেন শাহরুখ আর কখন এক পলক দেখে তৃপ্ত হবেন।
শাহরুখের বাড়ির গেটে বসা একজন প্রহরী। তার বসার জায়গাটি বাইরে নয়, গেটের ভেতরে। তাই গেটের বাইরে থেকেই আমরা জিজ্ঞেস করলাম, শাহরুখ আছেন কী না। উত্তরে প্রহরী জানালেন, ‘স্যার নেই। আর থাকলেও লাভ হবে না। ওনার সাথে দেখা করতে হলে আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। ’
প্রহরীর কথা শেষে আমরা ‘ও আচ্ছা’ বলে গেটের একটু পাশে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে দেখলাম অসংখ্য পার্স্বেল আসছে। উৎসাহ ভরে প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী? উত্তরে প্রহরী জানালেন, ‘গিফট’। এক এক জন আসছেন আর ছোট জানালা দিয়ে প্রহরীর হাতে গিফটের পার্স্বেল রেখে যাচ্ছেন। এমন গিফটে-গিফটে তার সামনে একবারে স্তুপ হয়ে গেছে। তিনি গিফট গ্রহণ করছেন, আরেকজন এসে নিয়ে যাচ্ছেন। কিংখানের বাড়ির গেটে এমন পার্স্বেলের স্তুপ দেখে এবার একটু সরে এসে বাড়িটি দেখার চেষ্টা করলাম। বাইরে থেকে দেখে মনে হলো, প্রথম একটি ডুপ্লেক্স এবং তার পরে পাঁচ কী ছয় তলার একটি অ্যাপার্টমেন্ট। যেখানে থাকেন বলিউড বাদশাহ খ্যাত শাহরুখ খান।
শাহরুখের বাড়ির ঠিক বাইরেই বান্দ্রা সমুদ্র বিচ। আরব সাগরের পাড় থেকে শাহরুখের বাড়ি এতটাই কাছে যে, সাগরের প্রতিটি ঢেউই বলতে গেলে মান্নাতে এসে আছড়ে পড়ে। এভাবে প্রায় মিনিট ১৫ অবস্থানের পর আমরা রওনা হলাম সালমান খানের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সালমান খান এখানে শাহরুখের মতো প্রাসাদ গড়ে তুলেননি। অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। নাম গ্যালাক্সি। শাহরুখের মান্নাত থেকে ২ মিনিটের ড্রাইভ। সে অনুযায়ী আমরা সবাই সালমানের গ্যালাক্সির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ঠিক ২ মিনিট চলার পর হাজির হলাম সালমান খানের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। শাহরুখের মান্নাতের মতো সালমানের বাড়িটি সাগর পাড়ে হলেও অ্যাপার্টমেন্টটির সম্মুখভাগ মূল রাস্তা থেকে একটু ভেতরে হওয়ায় আমরা কেউই সেখানে না গিয়ে ফিরে এলাম।
তবে, শুধু শাহরুখের ‘মান্নাত’ এবং সালমানের গ্যালাক্সিই নয়। তার আগে আমরা গিয়েছি মুম্বাইয়ের ঐতিহ্যবাহী ‘তাজ হোটেল’ ও ‘গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়া’ দেখতে।
আরব সাগরের একেবারে উপকন্ঠে অবস্থিত তাজ হোটেলের সৌন্দর্য দেখে আমরা রীতিমতো অভিভূত। তাজ মহলের আদলে অভিজাত স্থাপত্য শৈলীর এই হোটেলটির নয়নাভীরাম দৃশ্য শুধু আমাদেরই নয় আকর্ষণ করে হাজারো পর্যটককেও। সঙ্গত কারণেই প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন এই ঐতিহ্যবাহী হোটেলের সৌন্দর্য একবার হলেও অবলোকন করতে। শুধু ঐতিহ্যের কারণেই নয়, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর এই হোটেলটিতে চালানো হয়েছিল সন্ত্রাসী হামলা। যা ভারতের আন্তর্জাতিক রাজনীতির পুরো প্রেক্ষাপটই বদলে দেয়। তাই হোটেলটি না দেখে কোনোভাবেই যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাজ হোটেলের ঠিক উল্টোদিকেই অবস্থিত গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়া। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানী ম্যারি এসেছিলেন তৎকালীন বোম্বে বা বর্তমান মুম্বাইয়ে। তাদের আগমনের স্মৃতি হিসেবে বছরটির ৩১ মার্চ ‘গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়া’ তৈরি করা হয়। এর মূল নকশার কাজটি করেছিলেন ব্রিটিশ স্থপতি জর্জ উইটেট। ১৯১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়ার কাজ শেষ হয় ১৯২৪ সালে। ভূমি থেকে প্রায় ৮৫ ফুট উঁচু ভারতের এই প্রবেশ দ্বারটিও প্রতিদিনই হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয়। তবে, মজার ব্যাপার হলো প্রতিষ্ঠার পর এই ‘গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়া’ও তিন তিনবার সস্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। এরমধ্যে দু’বারই হয়েছিল ২০০৩ সালে আর সবশেষটি ছিল ২০০৮ সালে তাজ হোটেল আক্রমণের সময়।
এসব বিবেচনায় তাজ হোটেলের পাশাপাশি ‘গেইটওয়ে অব ইন্ডিয়া’ আমাদের ডাকছিল সেই প্রথম থেকেই। আজ দেখলাম আর দেখা শেষে ফিরলাম মুগ্ধতা নিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৬
এমআর/