শুক্র-শনিবার ছুটির সঙ্গে পূজার বন্ধ যোগ হওয়ায় চিন্তাটা মাথায় আসে। তিনদিন বন্ধের মধ্যেই মেঘালয় ঘুরে আসা যায়।
মেঘালয়ের যাওয়ার কথা শুনে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবও আগ্রহ দেখালো। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জটিলতার কারণে রনি আর আমিই রওনা দিলাম মেঘালয়ের উদ্দেশে।
অফিস শেষ হতেই এক ছুটে রাজধানীর সায়েদাবাদ গিয়ে শ্যামলী পরিবহনের বাসে চেপে বসলাম। সিলেট পৌঁছাতে রাত একটা বেজে গেলো। রাতটা সিলেটে এক বন্ধুর বাসায় কাটিয়ে সকালে তামাবিলের উদ্দেশে যাত্রা করি।
তামাবিল সীমান্তে বাংলাদেশি ইমিগ্রেশন, পুলিশ আর কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ভারতীয় ডাউকি ইমিগ্রেশনে এসে দেখি মানুষের ভিড়।
পরে দুপুর ১২টায় সব আনুষ্ঠানিকতা চুকিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম শিলংয়ের উদ্দেশে।
তামাবিল থেকে শিলংয়ের দূরত্ব প্রায় ৮৩ কিলোমিটার, যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটে চললো ট্যাক্সি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাউকি বাজার পার হয়ে দূর থেকে জাফলং দেখতে-দেখতে পাহাড়ের ওপর উঠতে লাগলাম।
পাহাড়ের গায়ে বসানো রাস্তার চারদিকে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। মেঘের দল দেখে মনে হচ্ছে আমাদের শিলং যেতে দেবে না। হঠাৎ করেই রাস্তার ওপর নেমে আসে সব মেঘ।
এক জায়াগায় ট্যাক্সি থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা হলো মেঘেদের দুষ্টামি। ফের শুরু হলো যাত্রা। রাস্তার ধারে চোখে পড়লো অসংখ্য রূপালি জলপ্রপাত।
বিশাল-বিশাল পাহাড়ের বুক চিরে একে-বেকে চলেছে সব পাহাড়ি ঝরনা। মেঘ, পাহাড় ও ঝরনা দেখতে দেখতে পোঁছে গেলাম শিলং। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত শহরটি সত্যিই অনিন্দ্য সুন্দর।
পরেরদিন সকাল ৯টায় আগেরদিন রাতে ঠিক করে রাখা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। স্থানীয় লোকেরা একে বলে সোহা। তবে চেরাপুঞ্জির নামেই বেশি পরিচিত। একসময় এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতো বলে কথিত আছে।
অক্টোবর মাস হচ্ছে বর্ষার একেবারে শেষ সময়। গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো এখানে-সেখানে। আমাদের ট্যাক্সি চালক কলিন আমাদের গাইড।
হাসি-খুশি লোকটা সত্যিই চমৎকার। ইংরেজি, হিন্দি, খাসিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলাও জানেন তিনি।
আমরা প্রথমেই গেলাম সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখতে। পাহাড়ের গায়ে ছোট-ছোট সাতটি ঝরনা কী যে অপরূপ, না দেখলে বোঝানো যাবে না। পরে গেলাম চেরাপুঞ্জি ইকোপার্কে। সেখান থেকে সমতল যতটুকু দেখা যায় পুরোটায় বাংলাদেশ।
এরপর আমরা চলে গেলাম মউসমি গুহা দেখতে। ১৫০ মিটার দীর্ঘ গুহাটি সত্যিই আকর্ষণীয়। গুহার ভেতরে কোথাও উঁচু, কোথাও গুহার ছাদ মাত্র তিন ফুট উচ্চতায়।
ঘাম ঝড়িয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। ফের শুরু পাহাড়ি রাস্তায় পথচলা।
চেরাপুঞ্জির রাস্তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাস্তাগুলো পর্বতের একেবারে উপরের অংশে করা। ফলে আশেপাশের সব পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। আরও চোখে পড়লো রকমারি শৈলিতে তৈরি পাহাড়ি ঘর-বাড়ি।
ফেরার পথে দেখতে গেলাম এলিফ্যান্ট ফলস। তিন স্তরের এ ঝরনাটি মেঘালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। হাতি আকৃতির একটি বড় পাথর থাকার কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে এলিফ্যান্ট ফলস।
১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে পাথরটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ঝরনার সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিটি স্তরেই রয়েছে কংক্রিটের প্লাটফর্ম। পাহাড়ের গা বেয়ে নামা পানির ঢল ছাড়াও ঝরনার শব্দের মধ্যেও রয়েছে মাদকতা।
এলিফ্যান্ট ফলসের কাছেই শিলং পিক, রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু স্থান। প্রায় ৬২০০ ফিট উচ্চতায় উঠার পর আশেপাশের সব পাহাড়কেই ছোট মনে হচ্ছিলো।
মেঘের মধ্যে একটু একটু করে দেখা যাচ্ছিলো শিলং শহর। দিগন্তজুড়ে পাহাড় আর মেঘ। মনে হলো ইস আরও বেশি সময় নিয়ে যদি আসা যেতো। পরেরদিন সকাল ৮টায় রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে।
কীভাবে যাবেন
প্যাকেজ সিস্টেমে ঢাকা শ্যামলী পরিবহনের গাড়ি ছাড়ে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এবং ফিরে আসে সোমবার রাত ১০টায়। শিলং যেতে এটাই সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। যাতায়াত গাড়ি ভাড়া ৪ হাজার টাকা।
এছাড়া ভিসা ফি ৬০০ টাকা+সার্ভিস চার্জ ৫০০ টাকা। মোট ১ হাজার ১০০ টাকা শ্যামলী কাউন্টারে জমা দিয়ে ভারতের ১-৬ মাসের ভিসা নিতে পারেন।
এক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে ই-টোকেন নিতে হবে না। তবে ৫ কর্মদিবস সময় লাগবে ভিসা পেতে।
আপনার যদি ভিসা নেওয়া থাকে, তবে শুধু বাসের টিকিট কাটলেই হবে। মনে রাখবেন ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা দিতে হবে, সেটা রওয়ানা দেওয়ার আগে সোনালী ব্যাংকে দিলেই চলবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা যেতে পারে এই নম্বরে-০১৭৪৯৯৩৭৫৪৫ (শ্যামলী কমলাপুর আন্তর্জাতিক টার্মিনাল)
বিকল্প পদ্ধতি
আপনি যদি শ্যামলীর রুটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করেন অথবা আপনার সঙ্গে সময় না মিলে তাহলে নিজে নিজে ভিন্নভাবে যেতে পারেন।
সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে সিলেটে রাতের বাসে চলে যান। ভাড়া পড়বে নন-এসি ৪৭০ টাকা ও এসি ১২০০ টাকা।
সকালে সিলেট নেমে সিএনজি বা গাড়ি ভাড়া করে চলে যান তামাবিল। সীমান্ত পার হয়ে সরাসরি শিলংগামী ট্যাক্সি ভাড়া করুন।
বড় ট্যাক্সিতে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ রুপি লাগবে। ছোট ট্যাক্সি ক্যাবও নিতে পারেন যদি সফরসঙ্গীর সংখ্যা কম থাকে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুকের লেখক।
আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন পাঠকদের সঙ্গে। লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
লেখা পাঠানোর ই-মেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৬
টিআই/এমএ