আক্ষরিক অর্থেই এটি হাট। কোথাও কোনো স্থায়ী ঘর নেই।
খোয়াই বনের মধ্যে বসা হাটটিতে মেলার মতো আমেজ। কিন্তু মেলার সঙ্গেও পুরোপুরি মেলে না। গ্রাম্য মেলাতেও অস্থায়ী ঘর থাকে। ঘর না থাকলেও হয়তো রোদ থেকে রক্ষা পেতে উপরে ডেকোরেটরের সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে কোনো দোকানের উপর ছাউনি নেই। কারণ, স্থায়ীভাবে এখানে কিছু স্থাপন করার নিয়ম নেই। তপ্ত রোদের মধ্যেই চলছে বেচা-কেনা। বনের মধ্যে হাট হওয়ায় আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস গাছ কোথাও কোথাও ছায়া দিচ্ছে। অল্প সংখ্যক দোকানি ট্রাফিক পুলিশের মতো ছাতা গেড়ে বসেছেন।
হাটটি পুরোপুরি ফড়িয়া (মধ্যসসত্বভোগী) মুক্ত। বিক্রেতারা সবাই প্রান্তিক উৎপাদক। পার্শ্ববর্তী কোপাই, বোলপুর, গোয়ালপাড়া, সিলিকেতুন, পাটুলডাঙা, চুরুল, প্রান্তিক ও ভুবনডাঙা গ্রামের নারী-পুরুষরা তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন দ্রবাদি নিয়ে হাজির হয়েছেন হাটে।
সওদার মধ্যে কাপড় ও সাজগোজের জিনিসের আধিক্য বেশি। তবে নান্দনিক শো-পিস, খেলনা, মনোহরি সামগ্রী ও তৈজসপত্রও রয়েছে। তবে প্রচলিত বাজারের চেয়ে ভিন্ন ঢংয়ের। এখানে অনেক কিছুই পাওয়া যায় যা আর কোথায় চোখে পড়বে না।
হাটে ক্রেতা রয়েছে তবে গিজগিজ নেই। অধিকাংশই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। সূর্য যতো পশ্চিমে ঢলে পড়ে ততোই জমে ওঠে হাট। ঢোকার সময়ই কানে ভেসে আসছিল ঢোল আর মাদলের শব্দ। হাটের একপাশে সাঁওতাল দল মাদলের তালে তালে নাচে মগ্ন। গোল হয়ে নাচ চলছে। মাঝখানে গামছা পাতা, নাচ দেখে যার ভালো লাগছে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন।
পাশাপাশি তিনটি দল অবিরাম নেচে চলেলে। প্রত্যেকটি দলে তিনজন করে ছেলে যারা যন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন, আর নাচিয়ে মেয়ে রয়েছে দশজন করে। টিমগুলো বয়স ভেদে ভাগ করা। মাঝের টিমটি মাঝয়সী যাদের প্রত্যেকের বয়স চল্লিশের ওপরে। মেয়েদের মাথায় উপর দু’টি করে কাঁসার ঘটি বসানো।
যেভাবে মাথায় মাটির হাঁড়ি নিয়ে দৌড় খেলা হয়, সেভাবে একটি ঘটির উপর আরেকটি বসানো। উপরের ঘটিতে ফুল ও সতেজ পাতা দেওয়া। দেখে মনে হবে, নাচিয়েদের মাথা ফুঁড়ে ফুল গজিয়েছে। এভাবে ঘটি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকের পক্ষে কঠিন। কিন্তু তারা এগুলো মাথায় করেই বিরামহীনভাবে নেচে চললেন।
পাশের টিমটি অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েদের দিয়ে গড়া। টিম লিডার প্রতিমা মার্ডি পড়েন আলমধা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে। আরতি চড়ে, দরপছিনা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। এই টিমের সবচেয়ে লম্বা প্রতিমা সবার সমানে, তারপরের মেয়েটি তার চেয়ে ছোট। সবচেয়ে ছোট মল্লিকা চড়ে বনোপগ্রাম গান্ধী বিদ্যাপীঠে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। তাদের সবার পরনে হলুদ শাড়ি।
এর দশ হাত দূরে আরেকটি খুদে টিম। তারা অবশ্য কেউই এখনও ঠিকমতো তাল, লয় ও নাচের মূদ্রা রপ্ত করতে পারেনি। প্রত্যেকের বয়স এগারোর নিচে। যন্ত্রীরাও তাদের সমবয়সী। তারাও মাদলের তালে তালে নাচ ও সাঁওতালি গান গেয়ে চললো, ‘অকয় লাগি মাঞ্জি থান...’।
সোনাঝুরি হাটের খানেক দূরে বেশি কিছু দোকান। মূল হাট থেকে দূরে হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘খোয়াই বনের অন্য হাট’। এখানেও দু’টি সাঁওতালী দল তাদের শৈল্পিক কসরত প্রদর্শনে ব্যস্ত।
উৎসুক ক্রেতা-দর্শনার্থীদের অনেকেই এসব টিমের সঙ্গে তাল মেলালেন। চেষ্টা করলেন তাদের পায়ের সঙ্গে পা মেলাতে। অনেকে দাঁড়ালেন স্রেফ সেলফি তোলার জন্য।
রবী ঠাকুরের বিশ্বভারতীর অদূরের এই হাটটি প্রতি শনিবার দুপুরের পর বসে, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। শনিবার বসে বলে হাটটির চলতি নাম, শনিবারের হাট। তবে সাঁওতালী নাচ চলে বিকেল পর্যন্ত। সামান্য বাড়তি আয়ের জন্য তাদের এই আয়োজন। তবে তারা যেনো নীতি ও সততার মূর্ত প্রতীক। কারও কাছে হাত পাতেন না। লোকজন স্বেচ্ছায় যা দেয় এতেই তারা সন্তুষ্ট।
টিমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মাদল বাজিয়ে ঝোটকা জানান, হাট শেষে একেকজন এক থেকে দেড়শো টাকা পান, এতেই তারা তৃপ্ত। দলের আয় সেই দলের সবার মধ্যে ভাগ করা হয়।
বাজের বিকিকিনিও দারুণ। দাঁড়িয়ে তাঁতের গামছা বিক্রি করছিলেন একজন। দাম জানতেই বিক্রেতা দাম হাঁকলেন ২৬০ টাকা। ২৬০ টাকা শুনে অবাক হতে হয়। ভেবেছিলাম, একটি গামছার দাম ২৬০ টাকা চেয়েছেন।
অবাক করে দিয়ে বিক্রেতা বললেন, এখানে চারটে গামছা রয়েছে, এর চেয়ে কম দামে কোথাও পাবে না।
এবার বিস্ময়ের সীমা থাকলো না। দুশো টাকায় রফা হলো চারটি গামছা। এই মানের একেকটি গামছা বাংলাদেশে দেড়শো টাকার কমে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।
এই হাট ও হাটের চারপাশের বন প্রায়ই ভারতীয় বাংলা সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা যায়। ভারতের জি বাংলা ও স্টার জলসার অনেক জনপ্রিয় সিরিয়াল এখানে চিত্রায়িত হয়েছে। জানা গেলো, স্টার জলসার ইস্টিকুটুম সিরিয়ালের জনপ্রিয় চরিত্র ‘বাহা’ পাশ্ববর্তী গ্রামেরই মেয়ে।
যাইহোক, ফেরার তাড়া উঁকি দেয়। ট্রেন ধরতে হবে, কাজেই মন না চাইলেও না ফিরে উপায় নেই। কিন্তু মন পড়ে থাকে লাল মাটির বুকে ছড়িয়ে থাকা সোনাঝুড়ির শনিবারের হাটে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৭
এসআই/এসএনএস/এএ