লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান (শ্রীমঙ্গল) থেকে: ট্রেইল দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছিলাম। খাসিয়া পল্লী থেকে ৫শ গজ দূরে, হঠাৎ মটাশ শব্দে চোখ আটকে গেলো।
দেখলে মনে হবে, তারা সাদা চশমা পরে বেরিয়েছে। গোলাকার চোখ ও মুখের চারপাশে সাদা রঙের বলয় সুস্পষ্ট। প্রাপ্তবয়স্ক চশমা পরা হনুমানের মাথায় লম্বা চুলের টুপি মতো দেখা যায়। লেজ খুব লম্বা। দেহ মাঝারি আকারের এবং সরু। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্য ৫৫-৫৬ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।
চকচকে ধুসরাভ অথবা কালচে আবরণে আবৃত। বক্ষ ও পেট সাদাটে হয়। এরা নাকি স্বপরিবারে চলাফেলা করে। আবার কখনও কখনও জোড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। গাছের উঁচু ডালে লাফিয়ে বেড়াতে খুবই দক্ষ। খাদ্যের তালিকায় রয়েছে- ফুল, ফল, পাতা, অঙ্কুর ও কচি কাণ্ড।
হনুমানগুলো কয়েক মিনিট বাঁশের কোড়ল চিবানো শেষে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। এরপর একটি ছড়ার স্বচ্ছ পানি মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ফরেস্ট গার্ড জহিরুল ইসলাম দেখালেন বিশাল সাইজের আগর গাছ। প্রায় একশো ফুটের মতো উঁচু। এরকম একটি আগর গাছের দাম নাকি কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা হবে।
দাম শুনে চমকে গেলাম, প্রথমতো বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। এর কাঠ প্রসেস করে আগরবাতি প্রস্তুত করা হয়। আগর গাছের কাঠ পুড়িয়ে যে নিযার্স তৈরি করা হয় এর প্রতি কেজির দাম লাখ টাকার উপরে। অন্যদিকে, কাঠও কেজি দরে বিক্রি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। প্রতি কেজি আগর কাঠের নাম দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এ কাঠ দিয়ে আগরবাতি, আতর, সুগন্ধি তেল ছাড়াও উন্নতমানের পারফিউম তৈরি করা হয়। সব কাঠে আতর থাকে না। তবে পেরেক ঠুকে বিশেষ উপায়ে আতর তৈরির করা যায়। আতর থাকা একটি গাছ ২৫ লাখ পর্যন্ত বিক্রি হয়।
এরপর কথা ধরে জহিরুল ইসলাম বললেন, দেখেন এরকম অসংখ্য মূল্যবান গাছ রয়েছে এ বনে। কতোগুলো সেগুন গাছ রয়েছে যেগুলো ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী। এসব মূল্যবান সম্পদ রক্ষার জন্য জনবলের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এখনই নজর দেওয়া প্রয়োজন, না হলে এই মূল্যবান সম্পদ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে খাসিয়া পল্লীর আগে পড়বে একটি ফাঁকা স্থান। ছেলেরা যে এখানে ক্রিকেট চর্চা করে তা নজর দিয়ে বোঝা যাচ্ছে। মাঠের মাঝে ব্যাটিং পয়েন্টে ঘাস উঠে গিয়ে চান্দি ছেলা হয়েছে। জানা গেলো, খাসিয়া পল্লীর ছেলে-মেয়েরা এখানে মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলে।
মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে গেলেই টিলার উপর খাসিয়া পল্লী। এখানে ৩০টি পরিবারের বসতি রয়েছে। যারা বেশিরভাগই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। একটি চার্চ রয়েছে মন্ত্রীর বাড়ি লাগোয়া। এ মন্ত্রী সরকারের কোনো মন্ত্রী নয়। খাসিয়া পল্লীর মন্ত্রী, নাম পিলা।
টিলার উপর ওঠার জন্য মাটি কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে। মাটি যেনো বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে না পারে সেজন্য বাঁশ বসিয়ে সিঁড়ির মুখ আটকে দেওয়া হয়েছে। সবগুলো বাড়ি টিনসেডের একতলা। তবে রাজার বাড়িতে একটি টিন সেডের দ্বিতল ঘর রয়েছে। বাড়িগুলো খুবই পরিষ্কার-পরিছন্ন।
তবে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে সেমিপাকা। টিনের ছাউনি টিনের বেড়ার ঘরও রয়েছে কয়েকটি। ভোরবেলা তখন সবেমাত্র দু’-একজন মহিলা ঘুম থেকে জাগতে শুরু করেছেন। আর তিনজন শিশুকে দেখা গেলো চার্চের সামনে মাটিতে দাগ কেটে কড়ি খেলছে।
খাসিয়া পল্লী থেকে বের হয়ে বাংলোর পথে ২শ গজ এগিয়ে যেতেই কানে ভেসে এলো উল্লুকের বিকট আওয়াজ। একটি দুই-তিনবার আওয়াজ দিতেই আরও কয়েকটি সুর ধরলেন। তেজালো সেই সুর বহুদূর থেকে অনুধাবনযোগ্য।
আওয়াজ শুনতে পেলেও উৎস নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। প্রাণপণ চেষ্টা ছিলো এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। মিনিট দেড়েক হৈ চৈ এর পর থেমে গেলো আওয়াজ। কয়েক মিনিট নীরবতার পর যেই আবার আওয়াজ শুরু করেছে, তখনেই ট্রেন বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে এলে বন্ধ হয়ে গেলো তাদের গলার শব্দ।
বনে আসার আগে শুনেছিলাম নানা রকম জোকের ভয়। কেউ কেউ অবশ্য কিং কোবরার বিষয়েও ভয় দেখাচ্ছিলেন। একজনতো মনে করিয়ে দিলেন বছর খানেক আগে এখানে ৫৭টি মারাত্বক বিষধর সাপ ও কিং কোবরা ছেড়ে দেওয়ার কথা।
তবে সাপের বিষয়ে অনেকেই পাত্তা দিচ্ছিলেন না এই বলে যে, সাপ কখনও নিজে আক্রান্ত না হলে আঘাত করে না। তাই সাপ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তবে জোঁক নিয়ে আতঙ্ক থেকেই গেলো। জোকের মুখে লবণ লাগানোর আগে থেকেই অনেক প্রস্তুতিও ছিলো। এ জন্য কেনা হয় স্প্রে। কিন্তু বের হওয়ার সময় সবাই সে কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।
কাদা থাকতে পারে সে জন্য প্লাস্টিকের জুতো, কোনটারেই খুব প্রয়োজনীয়তা অনূভব করলাম না আমি। ট্রেইল মোটেও স্যাঁতসেঁতে নয়। মোটা বালির পথ, বৃষ্টি হলেও কাদা হওয়ার কোনই চান্স নেই। তবে গহীন বনে বালির উপর পঁচা পাতার আবরণ কিছুটা নোংরা পায়ে লাগতে পারে। মাঝে মাঝে অনেক ছড়া রয়েছে, তাকে হাটু পানি ডিঙ্গাতে হতে পারে। সে কারণে সুজ বা কেডস না পরার পরামর্শ দেন অনেকেই।
রাজধানী ঢাকা থেকে ২শ কিলোমিটার। আর শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে ১২শ হেক্টর জমি জুড়ে বিস্তৃত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এখানে আড়াই হাজারের অধিক প্রজাতির পাখি, দশ প্রজাতিক সরিসৃপ, মেছো বাঘ, ভাল্লুক, উল্লুক, অর্ধশত প্রজাতির জীবজন্তু রয়েছে। নিবিড় ঘন ও ছোট বড় দেশি বিদেশি নানান রকমের বৃক্ষে ভরপুর।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
এসআই/আরএ/এসএনএস
** ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১
**লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা
**হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!