ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

নাটোর সদরে নৌকা ডুবতে পারে গ্রুপিং-কোন্দলে!

রাইসুল ইসলাম, এডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৮ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৭
নাটোর সদরে নৌকা ডুবতে পারে গ্রুপিং-কোন্দলে! (বাঁ থেকে) শফিকুল ইসলাম শিমুল, আহাদ আলী সরকার ও শরিফুল ইসলাম রমজান

নাটোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে গ্রুপিংয়ের খেলা। ত্যাগী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন নেই।আছে গ্রুপের প্রতি স্বার্থের আনুগত্যের পুরস্কার।

নাটোর সদর ও নলডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে, স্থানীয় বাসিন্দা ও তৃণমূলের আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল এতথ্য।

নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক নেতা জানালেন, মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাটোরের রাজনীতিতে বেড়ে যায় গ্রুপিং ও কোন্দল।

আওয়ামী লীগের প্রত্যেক প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে ঘিরে শহরে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বলয়। তাদের মধ্যে রেষারেষিও তীব্র।

নাটোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল নাটোর সদর আসনের গ্রুপিং ও কোন্দলের নানা চিত্র।

২০০৯ সালে নাটোর-২ (নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা) আসনে এমপি হন আহাদ আলী সরকার। পান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। আহাদ আলী সরকার পোড়খাওয়া রাজনীতিক হলেও মন্ত্রী হওয়ার পর ব্যর্থ হন নিজের দুই পুত্র সোহেল সরকার ও বকুল সরকারের দৌরাত্ম্য সামাল দিতে। ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকেন তিনি।

আর এ সুযোগটি নেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল। বিএনপির আমলে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর পেশীশক্তির রাজনীতির জবাবে নাটোরের রাজনীতির টার্ফে উত্থান ঘটে এই যুবনেতার। অর্জন করেন বিপুল জনপ্রিয়তাও। এই জনপ্রিয়তায় ভর করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে নির্বাচিত হন উপজেলা চেয়ারম্যান।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি শিমুল। আরও বেশি ক্ষমতার নেশা পেয়ে বসে তাকে। তৈরি করেন নিজস্ব গ্রুপ। টক্কর দিতে থাকেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য এবং যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকারের সঙ্গে।

২০১৩ সালে নাটোরের প্রাণকেন্দ্র কানাইখালি মোড়ে নাসিমসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সদর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকারের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হন তিনি। এ ঘটনার পর রীতিমতো লাইমলাইটে চলে আসেন শিমুল। ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটে আহাদ আলী সরকারের। এক বছর পরই জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পান শিমুল। বঞ্চিত হন আহাদ আলী সরকার।

তাদের মধ্যে তিক্ততা আরও বাড়ে যখন গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নাটোর শহরের কুখ্যাত যুবলীগ ক্যাডার রেদওয়ান সাব্বিরের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায় আহাদ আলী সরকারের বাড়িতে। পেটানো হয় আহাদ আলী সরকারের মেয়ে ও জামাতাকে। সাব্বির এমপি শিমুলের ক্যাডার হিসেবেই শহরে পরিচিত।

নিজেরই বাসভবনে শিমুলের ক্যাডার বাহিনীর হামলার নিজের মেয়ে ও জামাইয়ের মার খাওয়া মেনে নিতে পারেননি আহাদ আলী সরকার। তাই যে কোনো মূল্যে আগামী নির্বাচনে শিমুলের মনোনয়নপ্রাপ্তি ও নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে কাজ করবেন তিনি, এমনটাই মনে করে জেলার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
আহাদ আলী সরকারের সঙ্গে পুরনো দ্বন্দ্ব তো ছিলই, এমপি হওয়ার পর থেকে নাটোর শহরসহ জেলার সব স্তরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শিমুলের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান, পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি বাছিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়ার সঙ্গে। এছাড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাজেদুর রহমান খানের সঙ্গেও সৃষ্টি হয় দূরত্ব। এই নেতাদের সবাই তার ঘোর বিরোধী।

এই নেতাদের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন জনের কাছে জানা গেল, শিমুলকে ঠেকাতে আগামী নির্বাচনে প্রয়োজনে একাট্টা হবেন তারা। কিছুতেই শিমুলকে মনোনয়ন কিংবা নির্বাচিত হতে দেবেন না। সেক্ষেত্রে শিমুলের বিরুদ্ধে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলিকে আগামী নির্বাচনে সমর্থন দিতে পারেন তারা।

জেলা যুবলীগের সভাপতি বাছিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়ার সঙ্গে এক সময় শিমুলের দহরম মহরম থাকলেও এহিয়াও এখন তার ঘোর বিরোধী। এহিয়া নিজেও মনোনয়ন চাইবেন। তবে শেষ পর্যন্ত নিজে না পেলেও শিমুলকে ঠেকাতে অন্য যে কাউকে মনোনয়নের ব্যাপারে সমর্থন দেবেন তিনি।

আর নাটোরের রাজনীতিতে এমপি শিমুলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সাবেক জেলা যুবলীগ সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ১ নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান। মনোনয়ন চাইবেন তিনিও। তবে নিজে মনোনয়ন না পেলেও শিমুল যেন নির্বাচিত না হতে পারেন, সেজন্য চেষ্টা করবেন সর্বশক্তি দিয়েই। আবার অন্যদিকে শিমুলও সেটাই করবেন।

ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেল, রমজান, আহাদ, এহিয়া কিংবা জলি এদের মধ্যে কেউ মনোনয়ন পেয়ে গেলে তার জয় ঠেকাতে সর্বশক্তি দিয়েই মাঠে নামবেন শিমুল। তবে এক্ষেত্রে এমপি শিমুল তার জনবল এবং পেশীশক্তি কতোটা কাজে লাগাতে পারবেন তা-ও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ অনেকের সঙ্গে তাকে লড়তে হবে একা।

নাটোর ঘুরে একটি ব্যাপার পরিষ্কার অনেকটাই। তা হলো শিমুলকে আগামী নির্বাচনে ঠেকাতে একাট্টা তার প্রতিপক্ষ বিভিন্ন গ্রুপ। যে কোনো মূল্যে তারা শিমুলকে মনোনয়ন-বঞ্চিত দেখতে চান।

আর মনোনয়ন পেলেও এতো এতো প্রভাবশালী রাজনীতিকের বিরোধিতার মুখে শিমুল আগামী নির্বাচন জয়ী হতে পারবেন কি না সে ব্যাপারে ভরসা দিতে পারলেন না খোদ শিমুল-সমর্থক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই। আবার মনোনয়ন না পেলে শিমুল নৌকা মার্কার পক্ষে কতটা কাজ করবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না ওই কর্মী।

সব মিলিয়ে এই গ্রুপিং ও কোন্দলের কারণেই নাটোর সদর আসনে এবার ডুবতে পারে নৌকা। সবকিছু দেখেশুনে এমনটাই আঁচ করছেন নাটোরের অনেকেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৭
আরআই/জেএম

** নাটোর সদরে নৌকা পেতে টক্কর সেয়ানে সেয়ানে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।