পিতার নামে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের সামনে পুত্র সৈয়দ আশরাফের প্রার্থিতার পক্ষে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘শুধু দলের মধ্যেই নয়, সাধারণ জনগণের মধ্যেও তাঁর স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, বক্তিত্ব সম্পন্ন ইমেজ অনেক বড় একটি বিষয়। তাছাড়া তিনি জাতীয় নেতা।
বর্তমান সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই যে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের শেষ কথা, তা প্রতিধ্বনিত হয় জেলা সদর ও হোসেনপুর নির্বাচনী এলাকার সর্বত্র। দলের গ্রুপিং, লবিং, কোন্দলের বাইরে তাঁর অবস্থান। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে তিনি সচেষ্ট। কয়েক যুগের ভারপ্রাপ্তদের নিয়ে পরিচালিত জেলা আওয়ামী লীগে তিনি নির্বিবাদে সকলকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছেন। দীর্ঘদিনের পুরাতন ও ত্যাগীদের স্থান দিয়েছেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে হাইব্রিড ও নবাগতদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপট থেকে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের রক্ষা করেছেন। বাজিতপুর আওয়ামী লীগের একটি বিরাট বড় সঙ্কট তিনি মোকাবেল করেছেন চমৎকার ভাবে। আওয়ামী লীগের কোনও পর্যায় থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনও প্রার্থীর কথা কখনোই উচ্চারিত হয় না।
‘সৈয়দ আশরাফ ছাড়া অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হলে এই আসনে আওয়ামী লীগ জামানত হারাবে’ বলে পরিষ্কার মন্তব্য করলেন নুরু মিয়া। শহরের গৌরাঙ্গ বাজার ব্রিজের পাশে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মাঠ পর্যায়ের কর্মী তিনি। জানতে চাইলাম, ‘কেন সৈয়দ আশরাফ বিকল্পহীন?’ ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল সাথে সাথেই। ‘তিনি নিজে কোনও অন্যায় করেন না, অন্যায় প্রশ্রয় দেন না। ভদ্রলোক তিনি। সন্ত্রাসকে রাজনীতি থেকে দূর করেছেন। তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সদর ও হোসেনপুরে তাঁর বিকল্প কেউ নেই। ’
নুরু মিয়া আরও জানান, ‘এ আসনে ডানপন্থি, ইসলামপন্থিদের কয়েকটি শক্ত ঘাঁটি আছে। আওয়ামী লীগের দুর্বল প্রার্থী পেলে তাকে ধরাশায়ী করা সম্ভব। একমাত্র সৈয়দ আশরাফ নির্বাচন করলেই দল ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটে লড়ে বিজয়ী হতে পারবে। ’
কথাটা সত্য। নেজামে ইসলাম পার্টির মওলানা আতাউর রহমান খানকে একবার মনোনয়ন দিয়ে বিএনপি এ আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছিল। সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জের রাজনীতিতে সরব হওয়ার পর থেকে আসনটি আর কেউ তার কাছ থেকে নিতে পারেন নি।
বিশেষ পরিস্থিতিতে সৈয়দ আশরাফের বিকল্প কে হতে পারেন? যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হোন বা তার আরেক শহর ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচন করেন, তখন পরিস্থিতি কেমন হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। সকলেই একটি কথা জানালেন, ‘তাহলে তাঁর ভাইকে মনোনয়ন দিতে হবে। ’ পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘কেন তা করতে হবে?’ এবার উত্তর বেশ দীর্ঘ। ‘কারণ কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে জাতীয় নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল একটি প্রতীক। তাঁকে বাদ দিয়ে এখানে আওয়ামী লীগের কাউকে বিজয়ী করা যাবে না। অন্য যে বা যারাই প্রার্থী হবেন, তারা চরম গ্রুপিং ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন। ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী চাইলে সৈয়দ আশরাফ বা তার ভাইকেই মনোনয়ন দিতে হবে। ’
দলের ভেতরের মতো প্রতিপক্ষের শিবিরের দুরবস্থাও সৈয়দ আশরাফের জন্য বেশ অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের একক ও অবিতর্কিত প্রার্থী হিসাবে তার বিপক্ষে বিএনপি বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের একক বা উচ্চ ইমেজ সম্পন্ন কোনও প্রার্থী নেই। এই আসনে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করতে চান কমপক্ষে দশ জন। এরা সকলেই স্থানীয় পর্যায়ের ছোট-বড় নেতা। সৈয়দ আশরাফকে টক্কর দেওয়ার মতো জাতীয় পরিচিতিযুক্ত কেউ নেই।
বিএনপির প্রার্থী প্রাবল্যের বেশ কিছু কারণও জানা গেল দলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। দলের সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা ও নেতৃত্বের শৃঙ্খলার অভাবে দলে ফ্রি-স্টাইল-নেতা তৈরি হচ্ছে। নেতা হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় তারা সংসদ নির্বাচনও করতে চাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিশোরগঞ্জ বিএনপিতে এমনই অরাজকতা চলছে। কিশোরগঞ্জে ভাসানী ন্যাপের ডা. ফজলুল করিম বিএনপির রাজনীতির সূচনা করলেও অচীরেই তিনি বিতাড়িত হন ডানপন্থি এমদাদুল হক মতি মিয়ার দ্বারা। পরে মওলানা আতাউর রহমান খানকে দলে আনা হলেও তিনি বেশিদিন টিকতে পারেন নি। অপদস্ত হয়ে অপমানে দল ও রাজনীতি ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, দলের স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ হয় নি। প্রায়-সকল বর্তমান নেতাই জেলার বাইরের বা জেলার বিভিন্ন উপজেলার লোক। দলে নেতৃত্ব ও ঐতিহ্যের কোনও ধারাবাহিকতা নেই। আজ একজনকে তো কাল আরেকজনকে দলের দায়িত্ব দিয়ে শত শত হাইব্রিড নেতা বানানো হয়েছে। এখন এদের কোন্দলে দল জর্জরিত।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ বিএনপির নেতৃত্ব সব সময়ই অস্থানীয় এবং অনুপস্থিতদের হাতে অর্পিত হয়েছে। হঠাৎ করে ড. ওসমান ফারুককে দলে টেনে তাকে জেলা সভাপতি করা হয়। তিনি ছিলেন করিমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ও ঢাকা প্রবাসী। এরপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ইটনার বাসিন্দা ও ঢাকাবাসী ফজলুর রহমানকে। বর্তমান সভাপতি শরীফুল আলম কুলিয়ারচর উপজেলার লোক এবং ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কালেভদ্রে এরা জেলা সদরে আসেন। ফলে জেলার রাজনীতির হাল ধরা এদের পক্ষে মোটেও সম্ভব হচ্ছে না।
বিএনপি ছাড়া জেলার সকল রাজনৈতিক দলের সভাপতি সার্বক্ষণিক সদরেই থাকেন ও স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এদের সঙ্গে পেরে ওঠা বাইরের কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এতো বড় একটি জেলায় স্থায়ী নেতৃত্বের অভাবে বিএনপিও নিজেকে বিস্তৃত করতে পারছে না। মন্তব্য করলেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক।
শীর্ষ পর্যায়ে একক নেতৃত্বের অবর্তমানে এখানে বিএনপির বহু গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ঢাকা থেকে আসা নেতারা এইসব গ্রুপের ওপর ভরসা করেই কাজ করেন। দামাদামি বাড়ানোর জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ নেতারা নিজেদেরকে নিজেরাই সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিয়ে মিছিল করেন, ব্যানার, ফেস্টুন টানিয়ে রাখেন। দলের প্রার্থী হয়ে কেউ এলে মাঠে ছড়িয়ে থাকা এসব নেতার মোকাবেলা করতে হিমসিম খান। প্রয়োজনে মনোনয়ন প্রত্যাশীগণই দলবদ্ধ হয়ে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনিয়তা জাহির করেন। এমন তথ্য জানিয়ে কিশোরগঞ্জ বিএনপির সৃষ্টিকালীন সময়ের একজন নেতা বাংলানিউজকে বলেন, কিশোরগঞ্জ বিএনপির অগোছালো অবস্থার জন্য কেন্দ্র দায়ী। তারা টাকা-পয়সা বা লবিং-এর কারণে নানা জনকে খোঁজ-খবর না নিয়েই বিভিন্ন পদে বসিয়ে দেয়। কিশোরগঞ্জে দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতির কোনও পরিকল্পনা কেন্দ্রের নেই। কেন্দ্র তাৎক্ষণিক ও ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রতিনিয়ত নেতা বদলিয়ে দলের বারোটা বাজিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির জন্য একজন যোগ্য নেতা খুবই দরকার বলে বিএনপির অনেক সমর্থক বাংলানিউজকে জানিয়েছে। ‘জেলায় আওয়ামী লীগের এতোজন হেভিওয়েট নেতার সামনে বিএনপির কাছে উপস্থাপন যোগ্য কোনও নেতাই নেই’, আফসোস করেন হুসেন আলি নামের একজন ত্যাগী সমর্থক। তিনি বলেন, ‘এক ওসমান ফারুক ছিলেন। তিনিও বিতর্কিত ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আক্রান্ত হয়ে রাজনীতি থেকে লাপাত্তা। মীর্জা আব্বাস বা আবদুস সালাম কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা দাবি করলেও এলাকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। কয়েকটি ক্ষুদ্র অনুসারী গ্রুপ নিয়ে তারা বরং স্থানীয় রাজনীতিতে কোন্দল উৎপন্ন করছেন। ’
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো ঠাণ্ডা মাথার বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের মোকাবেলায় কয়েকজন স্থানীয় পর্যায়ের মধ্যম সারির নেতা ছাড়া বিএনপির বিশেষ কারো নাম মাঠ-ময়দান থেকে জানা সম্ভব হয় নি। যে আট-দশ সংসদ নির্বাচনের জন্য মাঠে রয়েছেন, তাদের অনেকেরই রাজনৈতিক যোগ্যতা স্থানীয় এলাকা ভিত্তিক। নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে এদের সকলেরই কিছু না কিছু কর্মী-সমর্থক-ভোট আছে। সকলেই নিজ নিজ এলাকার ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার জন্যই ভোটের মাঠ-ময়দান গরম রেখেছেন। মনোনয়ন না পেলেও রাজনীতিতে একটি ভালো জায়গায় অবস্থান নেওয়ার জন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা বলে অনেকেই মনে করেন।
কিশোরগঞ্জ-১ আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে একক প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের তৎপরতার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাংগঠনিক নেতৃত্ব এবং ঐক্যও বিএনপির নেই। সামনের নির্বাচনের জন্য বিএনপির পক্ষে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের জন্য বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে। নইলে এ আসনে বিনা বাধায় সৈয়দ আশরাফই যে বিজয়ীর হাসি হাসবেন, তা সকলের কাছে প্রায়-নিশ্চিত।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৭
জেডএম/