ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

মিন্টু-শিমুল দ্বন্দ্বে এবারও অনিশ্চিত ধানের শীষ

রাইসুল ইসলাম, এডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪২ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
মিন্টু-শিমুল দ্বন্দ্বে এবারও অনিশ্চিত ধানের শীষ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী শিমুল বিশ্বাস ও পাবনা পৌরসভার মেয়র, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু

পাবনা: পাবনা শহরের গোপালপুর এলাকা। শহরের কেন্দ্রস্থল আব্দুল হামিদ রোডের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থান নিরিবিলি এই আবাসিক এলাকাটির। পাবনার বিখ্যাত বিশ্বাস পরিবারের অনেক সয়সম্পত্তি এ এলাকায়। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী, তিনিও এই বিশ্বাস পরিবারের সন্তান।

বিএনপিতে তুলনামূলক নবাগত হলেও গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন অফিসে বিশেষ ক্ষমতাশালী এই নেতা। তাকে কেন্দ্র করে পাবনার রাজনীতিতে চলছে মেরুকরণ।

তৈরি হয়েছে পক্ষ বিপক্ষের গ্রুপিং।

শিমুল বিশ্বাসের অনুসারীরা নিজেদের মূল বিএনপি দাবি করেন। গোপালপুরে শিমুল বিশ্বাসের পৈর্তৃক বাড়িতেই তাদের কার্যালয়।

আবার শিমুল বিরোধীরা নিজেদের বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী দাবি করে তৈরি করেছেন ‘বিএনপি রক্ষা কমিটি’। এই বিএনপি রক্ষা কমিটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দলের পুরনো কার্যালয়টি।

বিএনপি রক্ষা কমিটির কার্যক্রম চলছে মূলত পাবনা পৌরসভার তিন বারের নির্বাচিত জনপ্রিয় মেয়র কামরুল হাসান মিন্টুকে ঘিরে। মূলত এই শিমুল বিশ্বাস-কামরুল হাসান মিন্টুকে কেন্দ্র করে পাবনা বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে। পাবনা শহরের গোপালপুরে শিমুল বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থিত দলের জেলা কার্যালয়।
শিমুল বিশ্বাসের অনুসারীরা তো মিন্টু ও তার পক্ষের নেতাকর্মীদের বিএনপির কেউ বলে স্বীকারই করেন না। তাদের দাবি, দলবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে মিন্টুকে অনেক আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে।  

অপরদিকে নিজেদের বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী দাবি করে শিমুল বিশ্বাসের অনুসারীদের স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী এবং বিএনপিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দাবি করেছেন ‘বিএনপি রক্ষা কমিটি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া নিজের বহিষ্কারের কথা অস্বীকার করে পৌর মেয়র মিন্টুর দাবি, তিনি বহিষ্কারের কোনো চিঠিই পাননি।

সব মিলিয়ে পাবনা বিএনপিতে এখন হযবরল এক পরিস্থিতি। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে পাবনা সদর আসনে বিএনপির প্রার্থী কে হবেন তা নিয়েও কোন্দল চরমে। শিমুল বিশ্বাসের অনুসারীদের কথায়, পাবনা সদরে বিএনপির একক প্রার্থী শিমুল বিশ্বাস। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আবার বিএনপি রক্ষা কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা কোনো অবস্থাতেই বিএনপিতে বহিরাগত নেতা শিমুল বিশ্বাসকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নেবেন না। তাদের দাবি, শিমুল বিশ্বাস বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৯৯ সালে, অথচ পাবনায় বিএনপি গড়ে উঠেছে তাদের শ্রম ঘামেই। পাবনায় দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ মেয়র কামরুল হাসান মিন্টুই। কারণ পাবনায় মিন্টু জনপ্রিয়। পরপর তিনবার মেয়র পদে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিই তার প্রমাণ।

শহরের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও বোঝার চেষ্টা করলাম বিষয়টির গভীরতা। তাদের কথাতেই উঠে এলো আর একটি নাম, তিনি হলেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল।

আসলে পাবনা বিএনপির সমস্যা বুঝতে হলে ফিরতে হবে ১৯৯৩ সালে। সে সময়ের পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলার সর্বস্তরের মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পুরো আওয়ামী লীগের অর্ধেকই যোগ দেয় বিএনপিতে। বকুলের হাত ধরে পাবনায় রাতারাতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিএনপি। ২০০০ সালে এক রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বকুলের। জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী এই নেতার মৃত্যুর পর থেকেই মূলত ঝামেলা শুরু হয় পাবনার বিএনপির রাজনীতিতে। শিমুল বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থিত জেলা কার্যালয়ে শিমুল বিশ্বাস সমর্থিত নেতাকর্মীরা। মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু পাবনার রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। পরে কমিটি গঠন হলেও সেখান থেকে বাদ দেয়া হয় তাকে।  

স্থানীয়রা আরও জানালেন, ১৯৯৯ সালে বিএনপিতে যোগ দেন বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা এবং উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের বাম ছাত্র রাজনীতির অন্যতম মুখ শিমুল বিশ্বাস। ক্রমেই হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়া তথা জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত। বর্তমানে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী হিসেবে গুলশান চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে তার অসীম প্রভাব। দলের কেন্দ্রে ক্ষমতা সুসংহত করার পাশাপাশি নিজ জেলা পাবনার রাজনীতিতেও অবস্থান তৈরি করেছেন তিনি। আর এ ব্যাপারে তার অ্যাডভান্টেজ পাবনা শহরে বিশ্বাস পরিবারের অবস্থান।

বিএনপির চেয়ারপার্সনের একান্ত এই বিশ্বাসভাজন এই নেতাকে কেন্দ্র করে তাই পাবনা বিএনপিতে গড়ে উঠেছে একটি বলয়। সভাপতি মেজর অব. কে এস মাহমুদ এবং হাবিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্র অনুমোদিত পাবনার বর্তমান জেলা কমিটিও শিমুল বিশ্বাসের পক্ষে।

তবে বিএনপির এই গ্রুপিং ও বিভেদের প্রভাব অতীতের মতই আগামী নির্বাচনেও পড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিএনপি সমর্থকরা।

শহরের রাধানগর এলাকায় কথা হলো স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বিএনপির সমর্থক। তিনি জানালেন, পাবনায় বিএনপির জনপ্রিয়তা ব্যাপক। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হচ্ছে না মূলত গ্রুপিংয়ের কারণে। এ অবস্থা বজায় থাকলে আগামী নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।

এদিকে বিএনপির এই গ্রুপিংয়ে আখেরে লাভ জামায়াতের বলে মনে করছেন স্থানীয় অনেকেই। কারণ এই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের পক্ষে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জামায়াতের আব্দুস সো্বহান। তবে যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে তিনি নির্বাচনে লড়ার ব্যাপারে অযোগ্য হলেও এই আসনে ফের মনোনয়ন চাইবে জামায়াত। সেক্ষেত্রে দলের জেলা সেক্রেটারি অধ্যক্ষ ইকবাল এবং সাবেক জেলা আমীর আব্দুর রহিমের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। শিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি এবং বর্তমানে পাবনা জামায়াতের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আলাপের সময় আভাস পাওয়া গেল এমনটাই। তিনি জানালেন, পাবনায় জামায়াতের ভোটব্যাংক থাকার পাশাপাশি এখানে দলের সংগঠনও মজবুত। জোটগত না হলেও একাই এ আসনে নির্বাচন করার ক্ষমতা রাখে জামায়াত। তাই বিএনপির সঙ্গে জোটগত নির্বাচন হলে এই আসনে মনোনয়ন চাইবেন জামায়াতের প্রার্থী। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

সব মিলিয়ে বিএনপির গ্রুপিং ‍ও কোন্দলের কারণে পাবনা সদর আসনে আগামী নির্বাচনেও অনিশ্চিত ধানের শীষের ভবিষ্যত।

** রাজনীতি জটিল পাবনায়
** পাবনায় ইমেজ ভালো প্রিন্সের, কোন্দল নেই মনোনয়নে
** সিংড়ায় লড়াই আ'লীগের উন্নয়ন বনাম ধানের শীষের জনপ্রিয়তার
** মার্কা পেতে কোন্দল নেই সিংড়া বিএনপিতে
** সিংড়ায় পলকই নৌকার মাঝি, কোন্দল নেই মনোনয়নে
** সিংড়ায় পলককে ঘিরে রাখে জনতা
** ‘সব ঠিক থাকলে’ নাটোরে ধানের শীর্ষ নৌকা তুমুল লড়াই
** পরিবারতন্ত্রেই অটল নাটোর বিএনপির একনায়ক দুলু
** নাটোর সদরে নৌকা ডুবতে পারে গ্রুপিং-কোন্দলে
** নাটোর সদরে নৌকা পেতে টক্কর সেয়ানে সেয়ানে
** ছোট শহরের বড় পলিটিকস নাটোরে
** সহিংস রাজনীতির পুনরাবৃত্তি চায় না বনলতা সেনের নাটোর
** চামড়া কিনছে না ট্যানারি, হাহাকার নাটোরের চামড়ার হাটে

** নাটোরে লিচুর রাজা চায়না থ্রি, কম যায় না মোজাফফরও
** আহ বৃষ্টি!, কি যে স্বস্তি!

** মায়ের কোলে ফিরলো হারিয়ে যাওয়া শিশু
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।