অবহেলিত পাকুন্দিয়া বাজারের দিকে তাকালে কথাটির সত্যতা মেলে। উপজেলা পরিষদ-থানা-কলেজের আশেপাশে একটি দুইটি পাকা দালানের পাশে সারি সারি টিনের তৈরি গ্রাম্য দোকান।
কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার বাস এখন প্রধানত যাতায়াত করে পাকুন্দিয়া-কাপাসিয়া-গাজীপুর হয়ে। আরেকটি পথ কটিয়াদী-ভৈরব-নরসিংদী-কাঁচপুর দিয়ে থাকলেও দূরত্ব কম বলে মানুষ এ পথেই বেশি আসা-যাওয়া করে। কিন্তু রাস্তার অবস্থা এতোই খারাপ যে ১০/১৫ মাইলের বেশি স্পিড তোলা যায় না। পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলতে গেলে রাস্তা ছেড়ে কাঁচা মাটিতে নামতে হয়। বিপজ্জনক চলাচলের জন্য পাকুন্দিয়ার রাস্তা যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নামান্তর। মঠখোলার দিকের রাস্তার হাল ভয়ঙ্কর। তবে কয়েকটি বাইপাস ও এপ্রোচ রোড তৈরি করে মির্জাপুর দিয়ে রাস্তার কিছু উন্নয়ন হলেও সামগ্রিকভাবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা পশ্চাৎপদ। ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দৃষ্টিগ্রাহ্য নজির নেই বললেই চলে।
‘বাংলাদেশের মধ্যে এমন খারাপ ও অবহেলিত রাস্তা আছে, এখানে না এলে কেউ বুঝবে না’, হতাশ গলায় বলল জনির বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারেক, ‘দেশের নানা স্থানে এতো উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু পাকুন্দিয়ার দিকে তাকানোর কেউ নেই। এমন অবহেলিত জনপদ আরেকটি খুঁজে পাওয়া ভার। ’
‘পাকুন্দিয়া আর কটিয়াদী মিলে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে আগত আয়কর উপদেষ্টা সোহরাবউদ্দিনের বাড়িও পাকুন্দিয়াতেই। কিন্তু তার সঙ্গে দলের সর্বস্তরের বিরোধ ও দূরত্ব প্রতিদিনই বাড়ছে। তিনি খুব একটা কাজ করতে পারছেন না’, জানালেন শিক্ষক একরামুল হক।
স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদা আওয়ামী লীগের সংসদীয় নেতা আসাদুজ্জামান খান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘকালের সাধারণ সম্পাদক একেএম শামসুল হক গোলাপ মিয়ার আসনটি দলের রাজনীতির প্রকৃত অনুসারীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি বহু দিন ধরেই তৃণমূল থেকে উত্থাপিত হচ্ছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করার জন্য বেশ কয়েক জন নতুন প্রার্থী মাঠে-ময়দানে আনাগোনা করছেন। যাদের মধ্যে সাবেক সচিব ও সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ অন্যতম।
‘নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগের বহু নেতা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিনিয়ত জনসংযোগ করছেন। জাতীয় পর্যায়ের কেউ কেউ নানা অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু কেউই সরাসরি নির্বাচনের কথা প্রকাশ করছেন না। সবাই কেন্দ্রের নমিনেশনের জন্য তলে তলে চেষ্টা করছেন।
যে নমিনেশন পাবে, দল তার জন্যই কাজ করবে’, জানালেন আওয়ামী লীগের সমর্থক আবদুল খালেক। উপজেলায় উন্নয়ন না হওয়ায় তার মনেও কষ্ট আছে। তবে দলের প্রার্থীর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা তিনি পোষণ করেন না।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র জানায়, সাবেক এমপি ডা. আবদুল মান্নানের পরিবারের কেউ মনোনয়ন প্রত্যাশা করলে হিসাব অন্য রকম হবে। তাছাড়া ঈদের পর পর জোরেসোরে নির্বাচনী দৌঁড় শুরু হলে শেষ পর্যন্ত কে টেকেন, সেটা এখনই আগাম বলা যাচ্ছে না। তবে যে কোনও পরিস্থিতিতে বর্তমান এমপির পক্ষে উপজেলা পর্যায় থেকে দলের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া সহজ হবে বলে অনেকেই মনে করছেন না।
পাকুন্দিয়ার পূর্ব-দক্ষিণ পাশেই কটিয়াদী। টেম্পু করে মঠখোলা-এগারসিন্দু ঘুরে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কটিয়াদী যাওয়া গেল। কিশোরগঞ্জ থেকে কটিয়াদী হয়ে বাজিতপুর-কুলিয়ারচর-ভৈরব-নরসিংদী হয়ে একটি বড় রাস্তা ঢাকার দিকে গেছে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রাক-বাস ইত্যাদি কটিয়াদী হয়েই ভৈরব পেরিয়ে ঢাকা, সিলেট বা চট্টগ্রামের দিকে যাতায়াত করে। সদ্য পৌরসভা হলেও কটিয়াদীর চেহারা জমজমাট একটি বড় আকারের গ্রাম্য বাজারের বেশি কিছু নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের নিরিখে পাকুন্দিয়ার মতোই একটি করুণ চিত্র এখানে দেখা যায়।
‘এই বড় রাস্তাটি ছাড়া আর কোনও দৃশ্যমান উন্নয়ন এখানে হয় নি। শিক্ষা, শিল্প বা কোনও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানও এখানে গড়ে ওঠে নি। ’ বাজারের হোমিও চিকিৎসক খসরু মোহাম্মদ মুসার সঙ্গে আলাপ করে এমনটাই জানা গেল। ‘অথচ পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী ঘেঁষে বহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ চরে প্রচুর ফসল আর শাক-সবজি হয়। অত্যন্ত উর্বর এই অঞ্চলে এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রি হলে কৃষকরা ফসলের উচ্চমূল্য পেত এবং অনেক কর্মসংস্থান হতো। ’ উন্নয়ন না হওয়ায় মুসা সাহেবের কণ্ঠেও ক্ষোভ।
আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে রাজনীতির চেয়ে উন্নয়ন ইস্যুই যে ভোটের মাঠে তীব্র হয়ে আছে, সেটা স্পষ্টভাবেই টের পাওয়া গেল। ‘ঢাকার এতো পাশে থাকার পরেও উন্নয়ন-অগ্রগতির দিক থেকে আমরা কত পেছনে রয়েছি। ভালো ও যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় এখানে কিছুই হচ্ছে না’, বললেন ডাক্তারের চেম্বারে বসা স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল খালেক মিয়া। কথাটা যে মোটেও অমূলক নয়, চারদিকে তাকিয়ে টের পাওয়া যায়।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনের অন্তর্গত পাকুন্দিয়া-কটিয়াদীতে বিএনপিও ভোটের মাঠে চুপ নেই। দলের ব্যানারে ৫/৬ জন প্রার্থী সরবে কাজ করছেন। তবে, বেশ কয়েকটি সূত্রের মতে, সব প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে না। অনেকেই নিজের অবস্থান ও প্রচারের জন্য মাঠে নাড়াচাড়া করলেও দুইজন প্রার্থী বেশ সিরিয়াস ভাবে কাজ করছেন। তারা গ্রাম, পাড়ায় জনসংযোগ ও কমিটি গঠনের মতো সাংগঠনিক কাঠামো বাড়াচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
এদের একজন আশকাক আহমেদ জুন এবং অপর জন অর্থনীতিবিদ শহীদুজ্জামান কাঁকন। উভয়ের সঙ্গেই হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের নিবিড় যোগাযোগের কথা মাঠে-ময়দানের ব্যাপকভাবে প্রচারিত। কেন্দ্রিয় মনোনয়ন এদের একজনের দিকেই ঝুঁকবে বলে স্থানীয় লোকজন মনে করেন।
‘তবে বিএনপির মনোনয়নের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে, যদি দলের বিদ্রোহী নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান রঞ্জন আবার দলে যোগ দিয়ে মনোনয়ন দাবি করেন’, এমনটিই মনে করেন স্থানীয় সাংবাদিক সুখেন্দু রায়। ‘রঞ্জন সাহেব দলের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সব সময়ই সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। ভোটের মাঠে তিনি একজন শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই’, জানান তিনি।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনের কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলার নানা স্থানে ঘোরাফেরার কাজটি সিএনজি দিয়েই করতে হয়েছে। উন্নয়নের সমস্যা, বিশেষত রাস্তা-ঘাটের দুরবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদমুখর চালকরা। গাড়ি চালাতে চালাতে গজগজ করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্রও বিলম্ব করছেন না তারা। তাদের কথায় যাত্রীদের সায় না দেওয়ার কোনও কারণ দেখা গেল না। পথে পথে সহযাত্রীদের কণ্ঠের ক্ষোভ লক্ষ্য করে মনে হলো, সামনের নির্বাচনে রাজনীতির চেয়ে উন্নয়ন ইস্যু এখানে দিনে দিনে আরও প্রাধান্য পাবে। প্রার্থী বা রাজনীতি নয়, ভোটের ফলাফল নির্ধারণে ও ইলেকশন ইস্যুতে উন্নয়নের প্রসঙ্গ নিশ্চিতভাবেই বিরাট প্রভাব ফেলবে কিশোরগঞ্জ-২ নির্বাচনী আসনের পাকুন্দিয়া ও কটিয়াদী উপজেলায়।
** কিশোরগঞ্জ সদরে সৈয়দ আশরাফই শেষ কথা
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
জেডএম/