ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

স্বপন-দুদু দ্বন্দ্বে জয়পুরহাটে মুমূর্ষু আওয়ামী লীগ

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
 স্বপন-দুদু দ্বন্দ্বে জয়পুরহাটে মুমূর্ষু আওয়ামী লীগ দুই নেতার দ্বন্দ্বে আ’লীগের ভূমিধ্বস বিপর্যয়ের আশঙ্কা। ছবি: বাংলানিউজ

জয়পুরহাট থেকে ফিরে: আত্মঘাতী গৃহবিবাদে ছন্নছাড়া জয়পুরহাট আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন মুমূর্ষুপ্রায়। ক্ষমতাসীন দলটি উত্তরাঞ্চলের এ জেলায় অন্তর্কোন্দল ছাড়াও নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করেও রুগ্ন হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের।

ফলে বিএনপির ঘাঁটি খ্যাত জয়পুরহাটের দু’টি আসনেই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিপর্যয়ের আশঙ্কা জেগেছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনে।
 
সরেজমিনে জানা গেছে, দ্বিধাবিভক্ত জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের একভাগের নেতৃত্বে আছেন রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।

অন্যদিকে আছেন জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল আলম দুদু ও সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী।
 
জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আছেন সহ সভাপতি রাজা চৌধুরী, অধ্যক্ষ খাজা শামসুল আলম, সানোয়ার হোসেন ও আব্দুল কাদের মণ্ডল,  সাংগঠনিক সম্পাদক জাহেদুল আলম বেনু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখর মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক শহীদ ইকবাল সদু, শ্রম সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, জয়পুরহাট পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন হিমু ও সাবেক পৌর মেয়র নন্দলাল পার্সি প্রমুখ।
 
নানা উপলক্ষে নেতাদের পোস্টারের লক্ষ্য, নির্বাচনী প্রচারণা।  ছবি: বাংলানিউজঅন্যদিকে স্বপনের পক্ষে আছেন জেলা কমিটির সহ সভাপতি নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল. গোলাম হাক্কানী, কোষাধ্যক্ষ বিপ্লব, জয়পুরহাট পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, পাঁচবিবি পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিব, কালাই পৌরসভার মেয়র জন, ক্ষেতলাল পৌরসভার মেয়র সিরাজুল ইসলাম বুলু, আক্কেলপুর পৌরসভার মেয়র গোলাম মাহফুজ চৌধুরী অবসর, কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিনহাজুর রহমান মিলন ছাড়াও ৩২ ইউপি চেয়ারম্যান।

৭১ সদস্যর জেলা কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই তাদের সঙ্গে আছে বলে দাবি উভয়পক্ষেরই।

স্থানীয়দের মতে, এমনিতেই জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো ছিলো না কোনো সময়ই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বা স্বাধীনতার পর থেকে দু’টি আসনে জিতেছে কেবল দু’বার করে। এর মধ্যে জয়পুরহাট -১ আসনে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আব্বাস আলী মণ্ডল। আর জয়পুরহাট-২ আসনে ১৯৭৩ সালে মতি চৌধুরী ও ১৯৮৬ সালে আব্দুর রাজ্জাক জয়ী হয়েছিলেন। গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামসুল আলম দুদু ও আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।

অভিযোগ রয়েছে, দল ক্ষমতায় থাকায় এলাকায় উন্নয়ন হলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এ দুই এমপির পরিবারের সদস্য এবং অনুসারীদের লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল, মাদক ব্যবসার মতো কর্মকাণ্ডে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্কের।
 
তৃণমূলের একাধিক নেতা জানান, দুই এমপিরই জন্মস্থান পাঁচবিবিতে। ফলে রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে অনেক আগ থেকেই স্বপন এবং দুদুর বিরোধ। এক সময় সাবেক পৌর মেয়র দুদুর সঙ্গে বিরোধে স্বপনের সঙ্গে জোট বেধেছিলেন সাবেক জেলা পরিষদের প্রশাসক ও বর্তমান জেলা সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী। কিন্তু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের চোরাবালিতে সেই জুটি হারাতে সময় লাগেনি। অনেকের মতে, এস এম সোলায়মান আলী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ নিশ্চিতের জন্যই পরে স্বপনকে ছেড়ে হাত মেলান দুদু’র সঙ্গে। দু’জনের এ মিলনও জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছে। যার ক্ষত দলটিকে টানতে হতে পারে দীর্ঘদিন।
 
কারো কারো অভিযোগ, সোলায়মান ও দুদুর মিলনের মূলে রয়েছে স্বপনের স্বেচ্ছারিতা, লুটপাট, অনিয়ম আর বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত। একদিকে স্বপনের আপনজনেরা লুটপাটের মাধ্যমে পকেট ভরছেন, অন্যদিকে তার হাত ধরেই ০৫ জানুয়ারির আগের সহিংসতার আসামি ও জামায়াত-বিএনপির আগুন সন্ত্রাসীরা যোগ দিতে থাকেন আওয়ামী লীগে। এতে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন।

ফলে দুদু-সোলায়মান জুটি একযোগে মাঠে নামেন স্বপনের বিরোধিতায়। তারা ঢাকায় দলের হাইকমান্ডের কাছে স্বপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে তাকে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে পদ না দেওয়ার সুপারিশ করেন। এ ঝড় কাটিয়ে ওঠার পর সোলায়মানের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন স্বপন। সোলায়মান আলীর জেলা পরিষদের চেয়াম্যান পদের মনোনয়ন ঠেকাতে প্রকাশ্য হন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে পঁচাত্তর পরবর্তী জয়পুরহাট আওয়ামী লীগের সিম্বল হিসেবে পরিচিত আব্বাস আলী মণ্ডলের ছেলে আরিফুর রহমান রকেটকে চেয়াম্যান প্রার্থী করে দলের হাইকমান্ড।
 
তৃণমূলের একাধিক নেতার দাবি, জেলা নেতাদের এ গ্রুপিং দলকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে দলকে। স্বপন-দুদু’র দ্বন্দ্বে লাভবান হচ্ছেন এস এম সোলায়মান আলী। স্বপনের সঙ্গে মিলে তিনি এক সময় কিছু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীর সমন্বয়ে একটি গ্রুপ গড়ে তোলেন। এ গ্রুপের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, চোরাকারবারি, অবৈধ দখলদারি, সরকারি অফিস ও থানায় থানায় তদবির বাণিজ্য, সরকারি গাছ লুটের অভিযোগ সম্বলিত ছবিসহ খবর স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

অন্যদিকে স্বপনের ভাই চন্দনের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা এবং চোরাচালানির অভিযোগ থাকায় তারও ভার নিতে হচ্ছে দলকে।  
 
অন্যদিকে  স্বপন-সোলায়মানের হাত ধরেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। এ সময় বিএনপি-জামায়াতের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দলে দলে যোগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। যোগদানকারীদের মধ্যে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার দাগি আসামিরাও রয়েছেন। বিশেষ করে শ্রমিকদলের নেতা বেদারুল ইসলাম বেদিন, বিএনপির জাকির ও রাজি’র ঠাঁই হয় আওয়ামী লীগে।
 
প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের পোস্টার শোভা পাচ্ছে জেলার আনাচে-কানাচে।  ছবি: বাংলানিউজআবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বাংলানিউজকে বলেন, ‘কৌশলগত কারণে বিএনপি-জামায়াতের অনেককেই আওয়ামী লীগে নিয়েছি। কিন্তু কোনো দাগি আসামি ও সন্ত্রাসী আছে বলে আমার জানা নেই। যারা যোগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কোনো নেতা নেই। আগুন সন্ত্রাস তাদের ভালো লাগেনি বলেই তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এতে দোষের কিছু নেই’।
 
স্বপন বলেন, ‘বর্তমান জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই অনাস্থা দিয়েছেন। নিয়ম অনুসারে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের বরাবরে লিখিত আকারে এ অনাস্থা জানানো হয়েছে’।
 
জেলা সভাপতি শামসুল আলম দুদু বাংলানিউজকে বলেন, ‘বড় দলে এ ধরনের সমস্যা থাকতেই পারে। নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না’।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
আরএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।