জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ইনসার আলীর এ অভিব্যক্তি যেন বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দাশিয়ারছড়াবাসীর আশা-আকাঙ্খারই প্রতীক।
শেষ বিকেলের ছায়ায় দাশিয়ারছড়ায় মুদি দোকানের সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন ১০ থেকে ১২ জন।
শরীরে চামড়ার ভাজ ও চুল-দাড়ির শুভ্রতায় ঘেরা ইনসার আলীর পরনে লুঙ্গি ও সাদা গেঞ্জি। কাঁধে গামছা ফেলে বসে আছেন বাঁশের মাচায়। এ জীবনে ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে একবার মাত্র ভোট দিতে পেরেছিলেন তিনি। এর পরের পাঁচ দশক চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, অথচ ভোট দিতে পারেননি।
সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একবার যেন ভোট দিতে পারেন, সে আশায় তাই বুক বেঁধে আছেন বাংলাদেশের নতুন নাগরিক ইনসার আলী।
কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়া এখন ফুলবাড়ী উপজেলার ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের অংশ। সুদীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনা-অবহেলাকে ছাপিয়ে এই জনপদে চলছে উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ।
কুড়িগ্রাম থেকে সড়কপথে দাশিয়ারছড়ায় যাতায়াত ব্যবস্থাও খুবই উন্নত। দুই ধারে সারিবদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছের সারির মাঝ দিয়ে চলে গেছে কালো পিচঢালা পথ।
দাশিয়ারছড়ায় প্রবেশেই দেখা মেলে, মাটির রাস্তাকে রূপ দেওয়া হচ্ছে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) বা ইট বিছানো সড়কে। চলছে সব রাস্তারই উন্নয়ন, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত ঘরে ঘরে সুখের ছোয়া, যা জানান দিচ্ছে রাস্তার ধারে ধারে বসানো খুঁটিতে বসানো বিদ্যুতের তার। সকল ক্ষেত্রেই উন্নয়নের রঙে রঙিন হয়ে উঠছে দাশিয়ারছড়া।
তবে সুদীর্ঘ সময় ধরে স্থবির হয়ে থাকা ছিটমহল বিলুপ্তিতে এখানকার মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি- একটি দেশের নাগরিক পরিচয়।
তাদেরই একজন জামান উদ্দিন (২৮)। ছিটমহল বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় নিজের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তাইতো জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই তার। বর্তমান সরকারের কাছে চির কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন নতুন জীবন লাভের গর্বে বলীয়ান জামান।
তিনি বলেন, ‘এলা আমি ছিনু বেদামি, বাংলাদেশের লয়, ভারতেরও লয়। আইডি পাইছি, নিজের পরিচয় পাইছি। আর মিথ্যা ঠিকানায় চলতে হইবে না। শেক হাসিনা রাস্তা, বিদ্যুৎ সব দিইছে। হারা শেকের বেটিরে ভোট দেবো’।
বিলুপ্ত ছিটমহলে ভোটের কথা জিজ্ঞাসা করলেই সবার মুখে শোনা যাচ্ছে শেখ হাসিনার অকৃত্রিম প্রশংসা। দাশিয়ারছড়ার লোকসংখ্যা ৭ হাজার ১৩১ জন। তবে ভোটার অনেক কম। সবেমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র শুরু করেছেন তারা। ফলে ফুলবাড়ী সদর ইউপির গত নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছেন মাত্র ৭৮৫ জন। ১৭০টি বাদে সব ভোটই পড়েছে নৌকার বাক্সে।
দাশিয়ারছড়ার প্রতিটি পরিবার এখন ব্যবহার করছে স্যানিটারি ল্যাট্রিনসহ নলকূপ, দলে দলে শিশুরা ছুটছে স্কুলে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসানের দুই বছর পার না হতেই আমূল পরিবর্তন এক সময়কার নিজ ভূমে পরবাসী মানুষগুলোর জীবনে। এসব কারণেই অধিকাংশ ভোটারের আস্থার প্রতীক নৌকা।
উন্নয়নে সমৃদ্ধ কফিল উদ্দিনের (৬৯) জীবনও। পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে তার। চার বিঘা জমিতে কৃষিকাজ করেন, বাকি এক বিঘা জমিতে সুপারির বাগান। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। অভাব ছিলো শুধু আত্মপরিচয়ের।
কফিল উদ্দিন বলেন, ‘এমপি ভোট অ্যালাও (একবার) দেয়নি। সামনে প্রথম দেবো। এখানে নৌকার পজিশন একবাক্কে ভালো, খুবই ভালো। এতো বৎসর কাটি গেছে, কেউ আমাকে ঠিকানাডা দিতে পারেনি। আমরা যে বাংলাদেশের নাগরিক অ্যাতোটুকু দিতে পারেনি। কিন্তু শেকের বেটি হাসিনা আসিয়া সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে দিইছে। এই জন্য এমপি হোক, চেয়ারম্যান হোক, সব ভোট এক বাইক্কে শেকের বেটিকে দেবো’।
দাশিয়ারছড়া পড়েছে কুড়িগ্রাম-২ আসনের মধ্যে। ফুলবাড়ী ছাড়াও কুড়িগ্রাম সদর ও রাজারহাট উপজেলা পড়েছে এ আসনে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৭
এমআইএস/এএসআর