নগরীর কোতোয়ালি ও বন্দর থানার কিছু অংশ কেটে নিয়ে এ আসনটি গঠিত হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে।
গত দু’টি নির্বাচনে এ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আফছারুল আমিন, প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই মন্ত্রিত্ব পেয়ে যিনি চমক তৈরি করেছিলেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি দেড় বছর। ‘অল্পবয়সী’ এ আসনটির মাঠে-ঘাটেও জমেছে ভোটের আলোচনা। উঠে আসছে পানি, যানজট, মাদক আর ইভটিজিংয়ের মতো নাগরিক সমস্যার কথা। চুরি-ছিনতাইসহ অপরাধ কমে যাওয়ার কথাও অবশ্য উচ্চারিত হচ্ছে।
ঝাউতলায় পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পাশে শরবত বিক্রি করেন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা জামাল উদ্দিন।
সোমবার (১৭ জুলাই) সকালে সরেজমিনে তার দোকানের সামনে গেলে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘পানি নিয়ে দুই ধরনের সমস্যায় আছি। একটি হচ্ছে- খাবার পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছি না। ওয়াসার পানি তো বলতে গেলে সেভাবে আসেই না। তবে ডিপ টিউবওয়েলের লাইন থেকে পানি আসে। অন্য সমস্যাটি হচ্ছে- পানি জমে থাকা। নালাগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে না। ১০ মিনিট বৃষ্টি হলে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠে যায়’।
এন নাহার ইলেকট্রনিক্স শো’রুমের মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘একটি মার্কেটের সামনে ফুটপাত নেই। সব ফুটপাতের ওপর দোকান বসিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় গাড়ি রাখে। মানুষের হাঁটা-চলারও জায়গা নেই’।
আমিনুলের ব্যবসায়িক পার্টনার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নালার পানি রাস্তায় উঠে আসে। মসজিদে যেতে পারি না’।
ওয়ারলেস কলোনির বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী মো. ইসলাম বলেন, ‘বিএনপির আমলে পুরো এলাকায় ছিনতাই বেশি হতো, খুনোখুনিও হয়েছে। এখন অবশ্য ক্রাইম হয় না। এদিক দিয়ে ভালো আছি’।
একই এলাকার বাসিন্দা রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স চালক তোফায়েল আহমেদ (৬২) বলেন, ‘আমি ১৯৭৩ সালের ০৯ এপ্রিল চাকরি নিয়ে এখানে এসেছি। ২০ বছর আগেও ওয়ারলেস কলোনি, পাহাড়তলী রোড দিয়ে দুপুর ১২টার পর মানুষ যেতে পারতেন না। রাস্তায় একটি কুকুরও থাকতো না। সরকারি কোয়ার্টার ছাড়া কোথাও বিদ্যুৎ ছিল না। এখন অনেক ভালো আছি’।
নাসিরাবাদ সিঅ্যান্ডবি কলোনির বাসিন্দা নাসিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বাহাউদ্দিন লতিফীর মতে, একে খান রোড থেকে জাকির হোসেন রোড হয়ে জিইসি, দুই নম্বর গেট, ষোলশহর ও মুরাদপুর এলাকার ভয়াবহ যানজট ও জলাবদ্ধতা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভোটের মাঠে এসব নাগরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
‘এ আসনের পাহাড়তলী উঁচু পাহাড়ি আর শুলকবহর-নাসিরাবাদ ঢালু এলাকা। পাহাড় থেকে পানি ঢালুতে এসে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। নালাগুলোর এতো পানি টেনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই’- বলেন লতিফী।
জিইসি থেকে দুই নম্বর গেট পর্যন্ত মূল সড়কে ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। তবে এখনও পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি। নিচের সড়কটিরও সংস্কার করা হয়নি। ভাঙা-চোরা সড়কে দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে।
শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা চট্টগ্রাম কলেজের গণিতে সদ্য মাস্টার্স করা জহির রায়হান অভিযোগ করেন, ট্রাফিক বিভাগ কোনো কাজই করে না। মাগরিবের নামাজের পর শুধু জিইসি থেকে দুই নম্বর গেটেই যেতে লাগে দুই ঘন্টার বেশি। এলাকায় কমপক্ষে ৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
একই এলাকার ইয়াছিন ভূঁইয়া অভিযোগ করেন, সিঅ্যান্ডবি কলোনি, নাসিরাবাদ গার্লস কলেজের সামনে, আল ফালাহ্ গলিতে প্রকাশ্যে ইয়াবা বিক্রি হয়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ১৫-২০ জন মাদক মাদক ব্যবসায়ী আছেন। খুলশীর অনেক গেস্ট হাউজে ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে অসামাজিক কাজ হয়। কিন্তু পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই।
নাসিরাবাদ গার্লস হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক মনিকা দাশ বলেন, গলির মোড়ে মোড়ে বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। সিগারেট টানে আর বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল কথা বলে। স্কুলের ছাত্রী আর অভিভাবকরা সব সময় ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না।
আল ফালাহ্ গলিতে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরিরের কর্মকাণ্ড চলছে বলেও অভিযোগ করেন ইয়াছিন ভূঁইয়া ও জহির রায়হান।
লালখান বাজার বাঘঘোনা এলাকার বাসিন্দা ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা দিলীপ দাশ বাংলানিউজকে বলেন, ‘খাওয়ার পানি পাচ্ছি না। ওয়াসার পানি খুব সমস্যা করছে। ছিনতাই কমে গেছে। রাত ২টায়ও এখন রাস্তায় নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারি। তবে মাদকসেবী ছ্যাঁচড়া ছেলেরা রাজনৈতিক পরিচয়ে অলি-গলিতে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেরা নিজেরা মারামারি-গোলাগুলি করে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে এগুলো সহ্য করা কঠিন’।
তবে এসব নাগরিক সমস্যার সমাধানে সংসদ সদস্যের খুব বেশি ভূমিকা নেই বলে অভিমত দেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ফেরদৌস আহম্মদ।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ফেরদৌস বলেন, এমপি হচ্ছেন আইনসভার সদস্য। নাগরিক সমস্যার সমাধান তো তার দায়িত্ব নয়। এজন্য সরকারি সেবা সংস্থাগুলো আছে। তবে সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কথা সংসদে তুলতে পারতেন এমপি আফছারুল আমিন। কিন্তু তার এ ভূমিকা মানুষের কাছে দৃশ্যমান হয়নি।
নাগরিক সমস্যা ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ডা. আফছারুল আমিন নিজেও। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকার সংসদ সদস্য আমি। আমার এলাকার জনগণের সব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব মেয়র আর কাউন্সিলরের। কিন্তু জনগণকে তো এটি বোঝানো যাবে না। এমপিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করান তারা। মফস্বলের এমপি আর সিটি করপোরেশনের এমপির মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সেটি বুঝতে হবে’।
রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
আরডিজি/টিসি/এএসআর