খোদ দলীয় নেতাকর্মীরাই বলছেন, আসনটি ধরে রাখতে হলে ভেবে-চিন্তে প্রার্থী দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। দলীয় কোন্দল নিরসন ও সঠিক প্রার্থী নির্বাচনে ব্যর্থ হলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান সংসদ সদস্য মাহাবুব আরা গিনি ও গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামসুল আলম হীরুর মধ্যেকার গ্রুপিংয়ে জর্জরিত সরকারি দল। দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস চরম পর্যায়ে পৌঁছায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের এক মঞ্চে দেখা যাচ্ছে না। ফলে নৌকার প্রার্থীর পেছনে একাট্টা হয়ে দল কাজ করবে- এমন আশা করাও খুবই কঠিন।
এবার গিনির পাশাপাশি মনোনয়নও চাইবেন হীরুও। যিনিই প্রার্থী হোন না কেন, যেই কোন্দল নিরসনই প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বলেও মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আবার বর্তমান এমপির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ অনেক নেতাকর্মীও প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, গিনিকে মনোনয়ন দিলে ভোট দেবেন, কিন্তু তার পক্ষে কাজ করতে পারবেন না। অনেকে আবার সরাসরি গিনির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলছেন, তাকে প্রার্থী করা হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। এ আসন ধরে রাখতে হলে নতুন প্রার্থী দিতে হবে।
আর জাতীয় পার্টির দাবি, তাদের বিশাল রিজার্ভ ভোট রয়েছে। কোমর বেঁধে নেমেছেন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী আব্দুর রশীদ সরকারও। অনেকদিন ধরেই মাঠে সরব তিনি। দলে কোনো কোন্দল বা গ্রুপিং নেই। ক্লিন ইমেজের রশীদ সরকার প্রার্থী হলে একাট্টা হয়ে মাঠে নামবেন নেতাকর্মীরা।
এদিকে মহাজোটের রাজনীতিতেও রয়েছে নানা হিসেব-নিকেশ। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোট হলে এ আসনে সমঝোতা নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে দল দু’টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আসনটি ছেড়ে দেয় জাতীয় পার্টি। এবার আর কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সম্ভাব্য প্রার্থী আব্দুর রশীদ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০০৮ সালের আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। এখন আওয়ামী লীগ তাদের স্বার্থেই জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করবে। আর জাতীয় পার্টি রংপুর বিভাগের ২২ আসনে (রংপুরের পীরগঞ্জ ছাড়া) কোনো ছাড় দেবে না। এ শর্ত মানলে তবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট হবে, না হলে হবে না। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন’।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামুল আলম হীরু দাবি করেন, ‘সদর আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে না। ২০০৮ সালে এ আসন আমাদের ছিলো, এবারও থাকবে- এমন আলোচনাই চলছে’।
গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো। যদি ভালো প্রার্থী দেওয়া যায়, তাহলে পাঁচটি আসনেই নৌকা জিতবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে প্রতিশ্রুত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড না হওয়া, এলাকায় অবস্থান না করা, আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে স্বজনদের নিয়ে ও নিজের মতো করে বলয় তৈরি এবং স্বজনদের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গিনির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
তাদের দাবি, গাইবান্ধায় না থেকে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করেন গিনি। সাধারণ ভোটাররা কাছে না পাওয়ায় তাদের সঙ্গেও অনেক ব্যবধান তৈরি হয়েছে বর্তমান এমপির। ফলে প্রচুর জনমর্থন থাকলেও পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয় আওয়ামী লীগ।
আর জেলার নেতাদের ক্ষোভ হচ্ছে, এমপি হওয়ার আগে গিনি কখনোই গাইবান্ধায় রাজনীতি করেননি, এখনো রাজনীতি বোঝেন না। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে হঠাৎ করেই তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোক ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেন, জুটে যান হাইব্রিডরাও। হঠাৎ গজিয়ে ওঠাদের বাধায় এমপির কাছেই ভিড়তে পারছেন না পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা। দল ক্ষমতায় থাকার সব সুবিধাও ভোগ করছেন এ নব্য আওয়ামী লীগাররাই।
এসব কারণে ক্ষুব্ধ ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার পেছন থেকে সরে গেছেন। দূরত্ব তৈরি হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও। এমনকি আপন ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুর রহমান টুটুলও তার পক্ষে নেই।
মাহাবুব আরা গিনি অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এবারও আমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত এমপি। যারা আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলেন, তারা মিথ্যা বলেন। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। আমি দলের লোকদের নিয়েই চলছি। কারো কারো অন্যায় আবদার পূরণ করিনি বলে ক্ষেপে গেছেন। আমি কি কাউকে অনিয়মে সহায়তা করতে পারি?’
নিজের উন্নয়নমূলক কাজের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমি যদি কাজ না করে থাকি, তাহলে ফান্ড আনল কে? লোকজন আমাকে এখনও ভালোবাসেন’।
অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গাইবান্ধায় ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছিলো দলটি। ঠিক তখনই ২০০১ সালে সরকার গঠন করলে হাইব্রিড নেতা হামিদুল হক ছানা চালকের আসনে চলে আসেন। তারেক জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট ছানা পুরো জেলা দাঁপিয়ে বেড়ান, করেন টেন্ন্ডারবাজি-দখলবাজি। তার নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরাও। ফলে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান প্রকৃত নেতাকর্মীরা। সেই থেকে আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি বিএনপি। এখন দলও তেমন পর্যায়ে নেই, শক্তিশালী প্রার্থীও নেই।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আনিসুজ্জামান বাবু ও জেলা জিয়া পরিষদের আহ্বায়ক খন্দকার আহাদ আহমেদ মনোনয়ন চাইতে পারেন বলেও জানান দলটির নেতাকর্মীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৭
এসআই/বিএস/এএসআর