এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আসনটি নিজেদের কব্জায় নিতে তৎপর রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী।
তবে জেলা জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত জোট বহাল থাকলে রওশন এরশাদই মহাজোটের মনোনয়ন পাবেন।
তাদের ভাষ্যে- বৃহত্তর ময়মনসিংহের চার জেলার বাসিন্দাদের তিন দশকের প্রাণের ময়মনসিংহ বিভাগের দাবি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আদায় ও বাস্তবায়নের একক কৃতিত্বের জন্যই এই আসনের ভোটারদের ‘গুডবুকে’ রয়েছেন রওশন। ঐতিহাসিক এ ভূমিকার জন্যই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে তার নাম। তাছাড়া দলটির সাংগঠনিক ভিত্তিও এখন মজবুত।
এদিকে, কোন্দলে চিড়েচ্যাপ্টা বিএনপি এবার প্রার্থিতায় চমক সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। দলটির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কে হাইকমান্ডের ‘অনুকম্পা’ পাবেন এ নিয়েও রয়েছে জল্পনা।
জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ এই আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন।
জোটগতভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখান থেকে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। টেকনোক্র্যাট কোটায় পরবর্তীতে ধর্মমন্ত্রী করা হয় বর্ষিয়ান এই রাজনীতিককে।
ময়মনসিংহ মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি জাহাঙ্গীর আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, দেশের রাজনীতির ইতিহাসে গণতন্ত্র ও ধারাবাহিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় রওশন এরশাদের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি জোটগত বা এককভাবে নির্বাচন করলেও বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। নিজের জন্মস্থানের এলাকার বাসিন্দাদের তিনি কখনোই ছেড়ে যাবেন না।
বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে বলেন, আমি সদর আসন থেকেই নির্বাচন করবো। এ নিয়ে কোন বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সেবক হয়েই থাকবো।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবার আসনটিতে নিজেদের দলের প্রার্থী চান। এই আসনটিতে দলীয় প্রার্থীর কোনো অভাব নেই। আসনটিতে এবারে প্রার্থী হতে পারেন মন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান।
মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন জেলা আ’লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা, সহ-সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র টানা তিনবার নির্বাচিত সাবেক পরিচালক আমিনুল হক শামীম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম.এ. আজিজ, মন্ত্রীর ছেলে মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত।
দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলের বাবা ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকাকে জীবনের গোধূলি বেলায় আবারো মূল্যায়ন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের এই ঘনিষ্ঠ সহচরের সততার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং ভোটাভুটি হলে ভোটের মাঠে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আমিনুল হক শামীম। সংগ্রামী, স্বপ্নবাজ ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটি এফবিসিসিআই’র নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটে টানা তিনবার পরিচালক নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতিও।
জেলার সর্বস্তরের ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বড় ‘ভোট ব্যাংক’ রয়েছে তার অনুকূলে। এছাড়া ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও সাবেক পৌর মেয়র ছোট ভাই ইকরামুল হক টিটুর দলমত নির্বিশেষে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দলীয় মনোনয়ন পেলে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে তার জন্য সহায়ক হবে।
দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে জনসাধারণের মাঝেও তাকে নিয়ে কমতি নেই আগ্রহের। তাকে বিবেচনা করা হচ্ছে ভোটে জিতে আসার মতো প্রার্থী হিসেবে। এসব হিসাব-নিকাশ সব প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে রাখছে আমিনুল হক শামীমকেই।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, বয়সে ভারাক্রান্ত মন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান শেষ পর্যন্ত প্রার্থী না হলে তার জ্যেষ্ঠ ছেলে মোহিত উর রহমান শান্ত প্রার্থী হবেন। সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতার অতীতে আন্দোলন-সংগ্রামেও ভূমিকা ছিল। তরুণদের কাছেও তিনি জনপ্রিয়।
তবে চাঞ্চল্যকর আজাদ হত্যাকাণ্ডে হাইকোর্টের নির্দেশে তাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এতে ইমেজ সঙ্কটে পড়লেও বার বারই শান্ত ও তার বলয়ের নেতা-কর্মীরা দাবি করেছেন দলীয় বিরুদ্ধবাদীদের চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি।
এদিকে, এই আসনটিতে বিএনপির নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন এবার নিজের সাবেক আসন ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) এ ফিরে যেতে চান।
সেখানে তিনি আসা যাওয়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে করে ‘কপাল’ পুড়তে পারে তার সৎ ছোট ভাই ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ওরফে ক্লাসিক বাবলুর।
এমন অবস্থায় আসনটি পুনরুদ্ধারে এই আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দিতে চায় দলটির হাইকমান্ড। সেক্ষেত্রে আলোচিত হচ্ছে দলটির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের নাম। মৃদুভাষী, ভদ্র ও সজ্জন হিসেবে তিনি পরিচিত।
দীর্ঘদিন যাবত নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে জোটের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করতে তাকেই দরকার।
তবে ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দলের জন্য কাজ করছি। মনোনয়ন বিষয়ে হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এ আসনে দলটিতে প্রার্থী হতে চান দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রামে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ। খালেদার গ্রেফতার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণও করেন তিনি।
বিএনপির রাজনীতির জন্য ‘ত্যাগী ও পরীক্ষিত’ হিসেবে আকন্দ পরিবারের সুনাম রয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চান, বার বার মনোনয়ন বঞ্চিত মাঠের নিবেদিত প্রাণ এই নেতা এবার মূল্যায়িত হোক।
নব্বইয়ের দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাঠ কাঁপানো সাবেক এই ছাত্র নেতা বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র রাজনীতির লড়াই-সংগ্রামের পর প্রায় ৯ বছর মূল দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। কাজের মাধ্যমেই খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিশ্বস্ত সৈনিক হতে পেরেছি। মামলা, দমন-পীড়নের মুখেও একদিনের জন্যও মাঠ ছাড়িনি। আশাবাদী দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করে দেশনেত্রীকে উপহার দিতে পারবো।
দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও কোতোয়ালী বিএনপির সভাপতি কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ ওয়ালিদ। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ওয়ার্ড এমনকি গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে নাসিরাবাদ কলেজ ছাত্র সংসদের দুইবারের এই ভিপির।
প্রায় ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে দুইবার পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন।
দলীয় নেতা-কর্মীদের আপদে-বিপদে তিনি পাশে থাকেন। সাধ্যমতো সহায়তাও করেন। মনোনয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, গণমানুষের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা রয়েছে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও। আমাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচিত হতে পারবো। যদি আমাকে দেওয়া না হয় তবে দলের সঙ্কটে-দুঃসময়ে মাঠে থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত।
আসনটিতে দলীয় অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও পরবর্তীতে সংস্কারপন্থি দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী রানা, শহর বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ আমজাদ আলী।
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৮
এমএএএম/এমজেএফ