কাঙ্খিত উন্নয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মতবিরোধ স্পষ্ট হলেও খুব একটা ক্ষোভ নেই জনমনে। তবুও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে নিপাট ভদ্র ফখরুল সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
এবার তাকে পুনরায় ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে ছাড় না দিয়ে বাধা দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস ছাত্তার। তার ভাষ্যে- নৌকার দাবিতে জনতার এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত।
আসনটিতে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে ছাত্তারের ঝুলিতে। মনোনয়ন প্রশ্নে বর্তমান ও সাবেকের অবস্থান এখন অনেকটাই ‘মুখোমুখি’। পরিস্থিতিও বিস্ফোরণমুখ। অবশ্য এজন্য ছাত্তারকেই দোষারোপ করছেন ১৯৮৮ ও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিজয়ী সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।
২০১৪ সালের নির্বাচনে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী ট্রেনে যুক্ত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেন ইমাম।
বাংলানিউজকে তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সম্প্রতি বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে ছাত্তার। গত ৫ বছরে আমার উন্নয়নমূলক কাজের জন্যই তার ধারণা আমি জোটগতভাবে আবারও মনোনয়ন পাবো। ছাত্তার স্থানীয় আওয়ামী লীগের চার ভাগের একভাগ।
তার লোকজনের সন্ত্রাসী কাজের নিন্দা জানিয়ে স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলনও করেছে। আমি আমার দলীয় নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করে রেখেছি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এসব বিষয় দেখবে। ’
তবে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যের এমন অভিযোগকে মোটেও আমলে নিতে রাজি নন এই উপজেলাকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটিতে রূপ দেওয়ার আসল ‘কারিগর’ আব্দুস ছাত্তার। নিজেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের ‘মূল স্তম্ভ’ মনে করেন তিনি। একই রকম বিশ্বাস তার অনুসারী নেতাকর্মীদেরও।
ছাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভোট হলে ফখরুল ইমাম পাস করতে পারবেন না। ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধনও হয়েছে। গত ৫ বছরে তিনি ঈশ্বরগঞ্জে কোনো কাজ করেননি এবং চরমভাবে নৌকার ক্ষতি করেছেন। নৌকা অন্তঃপ্রাণ নেতাকর্মীরাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ’
ফখরুলের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার দোয়া ও সহযোগিতায় ঈশ্বরগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। ১৬ হাজার ভোট থেকে আমি নৌকার ভোট ১ লাখ ২৭ হাজারে উন্নীত করেছি। আমি ৯৬ ও ২০০৮ সালে যে উন্নয়ন করেছি এই রেকর্ড আর কেউ ভাঙতে পারেনি। আমি একদিনের নোটিশে মিটিং ডাকলেও হাজার হাজার লোক হয়, আমার প্রতি এটা গোটা ঈশ্বরগঞ্জবাসীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নৌকাকে জিতিয়ে আবারও তার সেই ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চায়। ’
অবশ্য গত ৫ বছরে উন্নয়ন হয়নি এমন দাবিতে আপত্তি তুলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বাংলানিউজকে বলেন, গত ৫ বছরে রাস্তাঘাট বাবদ উপজেলায় শত কোটি টাকার মতো কাজ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ কোটির কাজ শেষ হয়েছে। ৭০ কোটি টাকা পাইপলাইনে রয়েছে। স্কুল-কলেজের উন্নয়নে আরও প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো কাজ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটি ময়মনসিংহে একমাত্র। আমার অনুরোধের চিঠিতেই প্রধানমন্ত্রী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ সফরকালে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করে গেছেন। এতে হাজার হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আসনটিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় স্থানীয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান সুমন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৌমেন্দ্র কিশোর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা ও সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মু্ক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম, সাবেক ছাত্রনেতা ও জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য তারিকুল হাসান তারেক উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান সুমন আব্দুস ছাত্তারের ভাতিজা। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ উপজেলায় জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দলীয় মনোনয়ন পেলে তার জয় অবধারিত বলেও মনে করেন সমর্থকরা।
তবে তার বিরুদ্ধে দলের অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, তিনি সব সময়ই নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। পৌরসভা থেকে ইউপি নির্বাচনে এর প্রমাণও মিলেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বদরুল আলম প্রদীপ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুমন বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই বার বার নৌকার বিরোধিতা করেছেন। ’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সুমন বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার। দলের পক্ষেই সব সময় আমার অবস্থান। রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয়-প্রতিপন্ন করতেই এমন মনগড়া অভিযোগ করা হয়েছে।
জোট বা একক নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে জাতীয় পার্টি ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমন অবস্থার বিপরীতে কোমর সোজা করতে পারেনি বিএনপি। দলীয় রাজনীতিতে এখানে দু’টি পক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু, অন্যপক্ষে সাবেক সংসদ সদস্য শাহ নুরুল কবির শাহীন।
মনোনয়ন প্রশ্নে দু’জনের আড়ির পাশাপাশি তাদের অনুসারীদের মধ্যকার বিরোধও তুঙ্গে। তবে দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এক সময়ের বিমানবন্দরের কর্মচারী থেকে সংসদ সদস্য হয়ে দলের তৃণমূল ও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বেমালুম ভুলে যান শাহীন। ভাগিয়ে নেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালকের সুবিধাজনক পদও। ফলে ঢাকাকেই ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে বেছে নেন। এর পাশাপাশি দাম্ভিক আচরণ তার রাজনৈতিক জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে।
ওয়ান ইলেভেনের কঠিন প্রেক্ষাপটে মাঠ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ঢাকাতেই সময় দেন শাহীন। পরবর্তীতে নির্বাচনে পরাজিত হলে তার সক্রিয় কর্মকাণ্ডে ভাটার টান পড়ে। রাজনীতিতে তার এমন ‘ইউটার্ন’ এ দলের রাজনীতির হাল ধরেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী মাজেদ বাবু।
দলের ভেতরে তার ‘কর্মীবান্ধব’ আর বাইরে ‘জনদরদী’ মনোভাবের প্রশংসা রয়েছে। দলকে সংগঠিত করতেও ভূমিকা রেখেছেন। এখনও নিজেকে নেতার চেয়ে কর্মীই ভাবেন তিনি।
দলটির একাধিক নেতা বলেন, খালেদার রায়কে ঘিরে পুলিশের দায়ের করা বিস্ফোরক মামলায় এক নম্বর আসামি ছিলেন বাবু। দুই নম্বর আসামি ছিলেন শাহীন।
বাবুসহ বেশিরভাগ আসামি জামিনে থাকলেও শাহীন রহস্যজনক কারণে জামিন নেননি। ফলে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন তিনি। এই বিষয়টিতে দীর্ঘদিন পর শাহীন রাজনৈতিকভাবে ‘ফোকাস’ হয়েছেন বলে মনে করেন তার হতাশাগ্রস্ত কর্মী-সমর্থকরা।
এছাড়া এই আসনে ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান লিটন, তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আওরঙ্গজেব বেলাল দলীয় মনোনয়ন চেয়ে দীর্ঘদিন যাবত মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। রাজনীতিতেও তাদের শ্রম-ঘাম রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৮
এমএএএম/আরআর