জাতীয় কোনো দৈনিকে সাহিত্যচর্চা, কিংবা সাহিত্যপাতা প্রকাশ করাটা অন্য কোনো ভাষার জন্য দরকারি কোনো বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশে, বাংলা ভাষার জন্য এটা সাপ্তাহিক বিষয়।
সাহিত্যের বিবর্তন এবং বিনির্মাণে ছোটকাগজগুলো একটি বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। বলা যায়, তিরিশের দশক থেকেই সাহিত্যপত্রগুলো মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশে সাহিত্যের বিশালতা বাড়িয়েছে নান্দনিকভাবে। দুই বাংলায় বিভিন্ন সময়ে সাহিত্যপত্রগুলো গড়ে তুলেছে আলোচক ও লেখকগোষ্ঠী। যেসব লেখক একসময় নিয়মিত ছোটকাগজে লিখেছেন, তারাই পরবর্তী সময়ে বাংলাভাষার প্রধান কবি-লেখকে ভূষিত হয়েছেন পাঠক-বিবেচনায়।
এরই সমান্তরাল দৃশ্য আমরা সমকালীন বিশ্বসাহিত্যেও দেখি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত, সমাদৃত ‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’ কিংবা ‘পোয়েট্রি’ ম্যাগাজিনে নতুন যে কবির অভিষেক হয়, তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। প্রকাশকরা তার পিছু ছুটেন। মাত্র এক দশকের মধ্যেই সে কবি কিংবা লেখক পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখকের মর্যাদায় ভূষিত হন। শ্রেষ্ঠ সম্পাদক দ্বারা স্বীকৃতিরও একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে বৈকি।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলা থেকে এ সময়ে বেশ কিছু ছোটকাগজ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ দিবসগুলোতে ‘সংকলন’ প্রকাশের উদ্যোগ ছিল অঞ্চলে অঞ্চলে। ক্রমশঃ সে প্রচেষ্টার সুবৃহৎ পরিধিই গড়ে ওঠে। ছোটকাগজ বা লিটলম্যাগ আন্দোলন নামে দুই বাংলার তরুণ, মননশীল, নবিশ সাহিত্যকর্মীরা একটি ঢেউ জাগাতে সমবেত হন। সেই সমবায়ী প্রচেষ্টার ফসলটি আজকের ছোটকাগজের সাহিত্যখামার।
সাহিত্য দিন বদলে, সমাজ বদলে বিশ্বাসী। সাহিত্যের সৃজনশীল গতিধারা দেখিয়ে দেয় প্রজন্মের বিশুদ্ধ পথ।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ছোটকাগজগুলোতে গুণগত, মানগত পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। চারশ’ পৃষ্ঠার একটি ‘আটলান্টা রিভিউ’ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রায় চারশত পৃষ্ঠার একটি ‘লোক’-এর মাঝে সমান সৃষ্টিছোঁয়া আমরা প্রত্যক্ষ করি। পরিবর্তনের নতুন সূর্যকে বরণের এই যে সমান প্রতিযোগিতা তা আমাদেরকে ভাষার দূরত্বের কথা, ভূখণ্ডের দূরত্বের কথা একেবারেই ভুলিয়ে দেয়। ভূমিবর্তী জীবন, প্রেম-বিরহ এবং মিলনের মোহনায় আমরা একাকার হয়ে যেতে পারি নিমিষে।
গেল দুই দশকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা থেকে যে সব প্রতিনিধিত্বশীল ছোটকাগজ বের হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলো কতটুকু সার্থক হতে পেরেছে, কতটুকু ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগেছে, সমকালের সাথে এগুলোর প্রজ্ঞা এবং প্রত্যয় কতটা ব্যাপৃত, তারই একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ। কয়েকটি উপসূচীতে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় প্রয়াসী হবো।
কষ্টের শস্যখামার, চর্যার খোলা জানালা :
ছোটকাগজ প্রকাশে প্রথম যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় তা হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কট। যথেষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন, পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিক্রির অভাবে প্রকাশনা দু’একটির পরই মুখ থুবড়ে পড়ে। লেখা সংগ্রহ, চিন্তনশীল সংযোজন এবং সম্পাদনার কাজে সম্পাদককে যেখানে বেশি সময় দেবার কথা, সেখানে সম্পাদককে প্রকাশের খরচ নিয়েই অধিক ভাবতে হয়। নিয়মিত কিংবা যথাসময়ে বের না হওয়ার কৈফিয়ত হিসেবে সম্পাদকীয় জবানিতে আমরা সে বিষয়টি প্রায়ই লক্ষ্য করি। চৌদ্দ কোটি মানুষের বাংলাদেশে জাতীয় দৈনিকগুলো দেড় লক্ষ সংখ্যার ‘সর্বাধিক প্রচারিত’ শ্লোগান নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে প্রায় প্রতি মাসেই। সেই দেশে ছোটকাগজ বের হয় পাঁচশ থেকে এক হাজার। আর এভাবেই বেঁচে থাকে এবং বেঁচে আছে মুক্তচিন্তার সাহিত্য প্লাটফর্ম বলে পরিচিত ছোটকাগজগুলো।
জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলো বিশদ আকারে যা করেনি, ছোটকাগজগুলো তা করে দেখিয়ে দিয়েছে গভীর পরিমণ্ডলে বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য চর্চা কতো উজ্জ্বলভাবে সম্ভব। একজন মননশীল সম্পাদক ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’য় বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বৃহৎ আকারের ইস্যু করে নতুন সিঁড়ি নির্মাণ করে গেছেন। প্রয়াত এই সম্পাদক, গবেষকের চিন্তাকর্মগুলো যে কোনো নবীন ধ্যানী গবেষকের কাজে আসতে পারে। একই ধারায় তরুণ সাহিত্যসেবী, কবি শিহাব শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘বৈঠা’র জ্যোৎস্না সংখ্যাটিও সমাদৃত হয়েছে বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে।
ছোটকাগজের উদ্যোগে সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ক্রোড়পত্র বের করার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই উদ্যোগকে আরো বলিষ্ঠ করে ব্যক্তিত্বভিত্তিক পুরো সংখ্যাও করার প্রয়াস চালিয়েছে বেশ কিছু ছোটকাগজ। লেখক, গবেষক আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত ‘তৃণমূল’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা (৪র্থ সংখ্যা, জানুয়ারি ১৯৯৮) একটি সফল উদাহরণ।
অনিকেত শামীম সম্পাদিত ‘লোক’ ছোটকাগজটি এক্ষেত্রে আরো বেশি প্রত্যয়ী হয়েছে। লোক এ পর্যন্ত আহমদ ছফা, উৎপল কুমার বসুকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। ‘লোক’ বিনয় মজুমদার সংখ্যা করে অমিতসাহসের পরিচয় দিয়েছে। কাজল বন্দোপাধ্যায় ও জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ সম্পাদিত ‘রোদ্দুর’ (১০ম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০২) সংখ্যার “ক্রোড়পত্র : আর্নেষ্টো চে’ গুয়েভারা” এই প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীকে জানিয়ে দিয়েছে বিপ্লবী ও কবি চে’ গুয়েভারের কথা। সাহিত্যের এই যে পরিচর্যা তা একটি বহমান ধারা। চক্রাকারে কালের সাহিত্যপ্রেমীরা সে আবর্তেই ঘূর্ণায়িত হন। ছোটকাগজগলো সে ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রেখে অগ্রসর হয়।
‘লোক’ এ ক্ষেত্রে নতুন একটি সংযোজন করেছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘পাণ্ডুলিপি পাঠ’। একটি প্রকাশিতব্য সৃজনশীল গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির নির্বাচিত অংশ প্রকাশ এবং তার উপর আলোচনার আয়োজন করে, প্রকাশ করে প্রশংসনীয় গতিধারা সৃষ্টি করেছে।
ছোটকাগজের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে-নিরীক্ষাধর্মী রচনা প্রকাশ করা। যাবতীয় ভাংচুরকে সাক্ষী রেখে নতুন সিঁড়ি নির্মাণ করে যাওয়া। নতুন পতাকা উত্তোলন করা। মহাকালের বিচারে তা সময় সাপেক্ষ যদিও, তবুও বলা যায় ছোটকাগজ যে মুক্তবাতায়ন খুলে ধরেছে তা যতোই উন্মুক্ত হবে, ততোই জাগ্রত হবে বিবেকী সাহিত্যের চারণভূমি।
উত্তরাধুনিকতা, মৌলাধুনিকতা, শূন্যাধুনিকতা :
বাংলা সাহিত্য আধুনিকতার স্তর পেরিয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে চলমান সাহিত্য বিশ্বের যে গতিপ্রকৃতির বলয়, তা বিচার বিবেচনা করে উত্তরাধুনিক সাহিত্যমণ্ডলে প্রবেশের একটি গভীর আগ্রহ আমরা গোটা বিশ্বে লক্ষ্য করছি। দুই বাংলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। উত্তরাধুনিকতা, লিটল ম্যাগাজিনেরই স্ট্যান্ড-এ তত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই। সাহিত্য কিংবা গবেষণার একটি স্তরকে একটি নাম দেয়া যেতেই পারে। মার্কিনী সাহিত্য আন্দোলনে ‘বিট জেনারেশন’ কিংবা ‘হাউল জেনারেশন’-কে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। এমন উদাহরণ বাংলা সাহিত্যেও আছে। ‘মৌলাধুনিকতা’ নামে লোকজ, আধ্যাত্মিক চেতনা ধারায় সাহিত্যকে প্রমোট করার একটি প্রচেষ্টাও আমরা গেল দুই দশকে লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে-কোলকাতায়। এখন যারা প্রযুক্তির আলোর সাথে ঝলসে উঠে এসএমএস কবিতা কিংবা এক্সপি কবিতা লিখছেন বা লিখতে চাইছেন তাদেরও নিজস্ব যুক্তি আছে। অথচ বাংলার লোকগীতিগুলোও তো সমৃদ্ধ কবিতা।
কবিতার চিত্রকল্পে আমরা একটি দৃশ্য নেপথ্যে লক্ষ্য করি। কিন্তু যদি কোনো আলোকচিত্রকে পাশাপাশি রেখে কবিতা লেখা হয় তবে জীবন্ত সে ছবিটি কেমন প্রাণ পাবে? হ্যাঁ, কিছু কবি তেমনটিই করেছেন। আন্তর্জালে (ইন্টারনেটে) আজকাল আমরা বেশ কিছু ছোটকাগজ সংস্করণে ‘দৃশ্য কবিতা’ দেখি। গ্রাফিক্সে আঁকা কিংবা ক্যামেরায় ধারণ করা চমৎকার ছবির সাথে মনকাড়া পঙ্ক্তিমালা। পাঠক হারিয়ে যেতে পারেন নিজ মনের অজান্তেই গহীন অজানায়। এই নিরীক্ষা-পরিচিন্তন ভাবনার উজ্জ্বল দিশা হয়ে একজন পাঠককে খোরাক দিচ্ছে।
শূন্য দশকের কবিরা তাদের পর্যবেক্ষণের নাম দিয়েছেন শূন্যাধুনিকতা। তারা বলছেন, আমরা শূন্য থেকে শুরু করতে চাই। একটি নিজস্ব স্তম্ভ রচনায় ব্রতী এসব সাহিত্যকর্মী কী পারছেন, কী পারছেন না, সে বিবেচনায় না গিয়েও মন্তব্য করা যায়। আর তা হচ্ছে সৃজনের কাঠামো-অবকাঠামো সবসময়ই একই সূত্রে গাঁথা। চিরন্তন ধ্রুবগুলো আদিকাল থেকে যেমন প্রতিফলিত, এর প্রতিছায়ায় দাঁড়িয়েই রচিত হচ্ছে সব সৃষ্টিকর্ম। শুধুমাত্র বলার কৌশলে, বর্ণনার মুন্সিয়ানায় ভিন্নতা মাত্র। সৃষ্টির শুরুর দিন থেকেই একই কক্ষপথে চলছে সব জীব এবং জড়ের পথচলা। শুধুমাত্র সমন্বয়ই ধরে রেখেছে স্তরের রঙ-রূপ-বর্ণ। অতএব যারা শূন্য থেকে শুরু করতে চান তাদেরকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় কি! যা চলছে, তা চলবে। কর্মী রেখে যাবে তার কর্মখণ্ড।
তারুণ্যের আধিক্য এবং সম্ভাবনার উজ্জ্বলতা নিয়ে গেল এক দশকে বেশ কিছু ছোটকাগজ বেরিয়েছে। নবীনত্ব দেখাবার প্রত্যয়ে তারা সবাই বলেছেন, আমরা প্রচলিত প্রথা ভেঙে দিতে চাই। রাতুল আহমেদ সম্পাদিত ‘লাস্টবেঞ্চ ১১৫’ তেমনি একটি ম্যাগ। কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নতুনদের সাহসের পরিধি বাড়িয়েছে। শূন্য থেকে শুরুর বেশ কিছু কাব্য দলিল-দস্তাবেজ হাজির করতে চেয়েছেন আমজাদ সুজন ও তানজিম ইসলাম তাদের সম্পাদিত ‘উল্লেখ’ ছোটকাগজে। জয় হোক শূন্যাধুনিকতার।
বলয়ের নিগূঢ় বৃত্তান্ত, পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ান :
ছোটকাগজগুলো গড়ে তুলেছে নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী। এমন অনেক কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক আছেন যারা শুধুমাত্র ছোটকাগজেই লিখে থাকেন। সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলে কোনো তত্ত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিনা-বিতর্ক হতে পারে তা নিয়েও। কিন্তু সাহিত্য তো হবে বিস্তৃত-বিশাল। এর নিজস্ব কোনো গণ্ডি নেই। বলয় নেই। তার পরও যারা ‘জাতীয় দৈনিকে লিখবো না’-বলে ঘোষণা দেন, তাদের মতামতকে আমি ‘স্বাধীনতা’ বলেই ধরে নেই। লেখকের লেখার ক্ষেত্র হচ্ছে মাটির ক্যানভাস। আর মাটি তো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। মৃত্তিকার মালিক সবাই। সবাই তার সন্তান।
উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে। একজন সফল প্রবন্ধকার মঈন চৌধুরী, একজন মেধাবী গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজ কিংবা একজন কৃতি কবি মোস্তাক আহমাদ দীনকে এক্ষেত্রে সূর্যছায়ায় অবলোকন করি। ছোটকাগজের ঘনিষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত মোস্তাক আহমাদ দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ প্রকাশিত হবার পর ব্যাপক আলোচনায় স্থান পায়। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদকমণ্ডলীর বিচারে ২০০১-এ প্রকাশিত ‘আলোচিত বিশ’ গ্রন্থের তালিকায় স্থান পায়। প্রকারান্তরে এদের মাধ্যমে ছোটকাগজের পরিমণ্ডল আরো ব্যাপকভাবে সম্মান কুড়ায়। ছোটকাগজের সাহিত্যসংসার ঘনকুয়াশা ভেঙে এভাবেই কাছে এসেছে আমাদের। আমরা সে ভালোবাসায় সিক্ত হতে হতে অবগাহন করেছি পঙ্ক্তির মর্মমূলে, গল্পের জীবনচিত্রে।
নির্মাণের নিগূঢ়তাকে সঞ্চয় করে একজন কবি যখন বদলে দিতে চান ‘কবিতার ভাষা’ - তখন আমরা ফিরে না তাকিয়ে পারি না। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হোক, আর প্রসব বেদনা থেকেই হোক যখন কোনো কুঁড়ির উন্মেষ ঘটে, আমরা তাকেই বলি অঙ্কুরোদগম। সব বীজই মহিরুহের জনক হতে পারে না। সব নদীও হতে পারে না ধাত্রীজননী।
বিভিন্ন ছোটকাগজের ‘সাহিত্য বৈঠক’ আলোচনায় আমরা জানতে পারি কবিতার বাঁকবদল প্রচেষ্টা এবং কবিদের কাব্যভাবনার কথা। না, আমি গোষ্ঠীচর্চার লেবেল লাগাতে চাই না। তবুও বলতে হয়, প্রায় প্রতিটি প্রতিনিধিত্বশীল লিটলম্যাগই নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার প্রাচীন এবং প্রতিষ্ঠিত লিটলম্যাগ জিজ্ঞাসা, কৃত্তিবাস, চতুরঙ্গ, অনুষ্টুপ, এবং মুশায়েরা, কৌরব থেকে শুরু করে কবিতা ক্যাম্পাস, অযান্ত্রিক, কবিকল্প, অঞ্জস প্রভৃতি ছোটকাগজেও আমরা তা লক্ষ্য করি।
বাংলাদেশ থেকে আবহমান, একবিংশ, লোক, নিসর্গ, শালুক, গন্ধম, শুদ্ধস্বর, গাণ্ডিব, লিরিক, উলুখাগড়া, নতুন দিগন্ত, জীবনানন্দ, কথা, ব্যাস, অমিত্রাক্ষর, অরুন্ধতী, সুনৃত, অর্কিড, জারুল, নন্দন, ক্যাথারসিস, কারুজ, দূর্বা, দুয়েন্দে, মান্দার, ঋতি, গ্রন্থি, হৃদি, বিকাশ, ঘাস, খোয়াব, ভাস্কর, নগর, একতারা প্রভৃতি ছোটকাগজ বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে নিয়মিত-অনিয়মিত। তৃতীয় বাংলা বলে খ্যাত যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে-শব্দপাঠ, কবিতা, স্রোতচিহ্ন, ভূমিজ, আদিকাকতাড়ুয়া, ধীস্বর ইত্যাদি। এসব কাগজে কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের যে সম্ভার, একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য তা অত্যাবশ্যক। বুননে-বপনে এসব সাহিত্য কাগজ কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করেই দিয়ে যাচ্ছে কালিক চেতনাচিত্র।
অতিকথন, পাণ্ডিত্যের বাহাদুরী, তত্ত্ববিতরণ :
ছোটকাগজগুলোর কোনো কোনো প্রবন্ধে আমরা তত্ত্ব বিতরণ এবং পাণ্ডিত্য দেখাবার নির্লজ্জ প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করি। মাঝে মাঝে লেখক বনাম লেখক, সম্পাদক বনাম সম্পাদকের কলমযুদ্ধও পরিলক্ষিত হয়। সাহিত্যে ‘প্রতিষ্ঠিত সত্য’-বিষয়টি হয়তো কেউ মানেন, কেউ মানেন না। যদি লেখার স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রাই দেয়া হয়, তারপরও আন্দাজ-অনুমান করে কোনো মন্তব্য করা অপরাধতুল্য। বাহাদুরী জাহির করার নামে কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিন এমন মন্তব্যধর্মী লেখারও পৃষ্ঠপোষকতা করে কিংবা করছে। লেখকও চালিয়ে দিচ্ছেন তার মনগড়া মতবাদ। সরকার আশরাফ সম্পাদিত নিসর্গ (বর্ষ ২০ সংখ্যা ০১)-তে প্রকাশিত, কামরুল হাসান লিখিত ‘অকবিতার প্রান্তরজোড়া শূন্য পদধ্বনি’ প্রবন্ধটি এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে লিখেছেন-
‘পুনরুক্তিমূলক বা ক্যাটালগিং কবিতার জন্ম হয়েছিল পাশ্চাত্যে। সেকালের ওয়াল্ট হুইটম্যান বা একালের এ্যালেন গিন্সবার্গের অনেক সার্থক কবিতা এ শৈলীতে নির্মিত। আমাদের সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সবচেয়ে দ্যুতিময় কবিতা ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ ক্যাটালগিং পদ্ধতির অসামান্য উদাহরণ। আরো উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন হে প্রিয়তমা’ (এ কবিতার মৌলিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ, এটি মূলতঃ অভিযোজন বা বিদেশী কবিতার ভাবানুবাদ। আমাদের বড় কবিরা এমনি প্রচুর ভাবানুবাদ করেছেন পাশ্চাত্য, বিশেষতঃ ইংরেজি কবিতার) বা রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতাদ্বয়ের কথা। এসকল কবিতায় সফল দ্যোতনা আনার জন্য পুনরুক্তির কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু বহুল ব্যবহারে এ জাতীয় কবিতা ক্লিশে হয়ে যায়, বিশেষতঃ দুর্বল কবিদের হাতে তা রীতিমত ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়। এ ধরনের লেখা রাবারের মতো ইলাস্টিক, ইচ্ছে মতো টেনে কেবলই লম্বা করা যায়। ’
আমার এ বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে, ‘তোমাকে অভিবাদন হে প্রিয়তমা’-নামে শহীদ কাদরীর কোনো কবিতা নেই। যা আছে, তা হচ্ছে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা। ’ তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও একই শিরোনামে। নিশ্চয়ই কামরুল হাসান না পড়েই নিজ পাণ্ডিত্য দেখাতে ব্রতী হয়েছেন। না হলে বিসমিল্লায় গলদ হবে কেন?
নিউইয়র্ক প্রবাসী শহীদ কাদরীর ভাষ্য মতে, এ কবিতাটি কোনো ভাবানুবাদ নয়। কবিতাটি মৌলিক। তাহলে প্রবন্ধকার কামরুল হাসানদের এমন চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা কেন? যা ইচ্ছা তা লেখার প্লাটফর্ম আছে-সে জন্যে?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ (সংখ্যা ২১, মে ২০০২)-তে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর ‘পুলিপোলাও’ শীর্ষক কবিতা ছাপা হয়েছে। মূলতঃ এটি একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। ৬৪টি কবিতার সমন্বয়। এই কবিতাগুলোর শেষে টিকাপর্বে পঙ্ক্তিগুলোর বিভিন্ন শানেনুযুল বর্ণিত হয়েছে। ৬৪টি কবিতা সম্পর্কে টিকার সংখ্যা হচ্ছে ৭৩টি। অর্থাৎ ৬৪টি কবিতা পাঠ শেষে পাঠককে আরো ৭৩টি গোলার্ধ ভেদ করতে হবে। এই যে প্রয়াস, তা কি একটু অতিকথন হয়ে যাচ্ছে না? এভাবেই বেড়ে উঠছে ছোটকাগজের সাহিত্য আয়োজন। কখনো পাঠককে মানতে বাধ্য করা হচ্ছে অতিনসিহত। এরকম উদাহরণ আরো অনেক পাওয়া যাবে। না, কোনো অভিযোগ নয়, বিকৃতির ব্যাসার্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এমন প্রাসঙ্গিক কথা আসবেই। না এসে উপায় যেমন থাকে না, তেমনি আলোচনাও থেকে যেতে পারে অসম্পূর্ণ।
কালের বারান্দায় শব্দের প্রতিচিহ্ন :
সময়ের ছোটকাগজগুলো কালের বারান্দায় শব্দের নিজস্ব যে প্রতিচিহ্ন রেখে যাচ্ছে, তা সিন্দুর বিন্দুর মতোই। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের তিন দশকে প্রকাশিত কাগজগুলো নিয়ে, তাদের কর্ম নিয়ে, সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা সব সময় প্রাসঙ্গিক। একান্ত পরিবর্তনে বিশ্বাসী লিটলম্যাগ কার্যত কী পারছে কী পারছে না তা নিয়ে বোদ্ধা পাঠকসমাজ নিরপেক্ষ, মুক্ত বিতর্কে অংশ নিলে কাগজ ও পাঠক উভয়ই উপকৃত হবেন। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, বহুমাত্রিক লেখক কবি হুমায়ুন আজাদের কথা।
নিউইয়র্কে এক সাহিত্য আড্ডায় তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষায় সংবাদ রিপোর্টিং-এ ‘অভিজ্ঞমহল মনে করেন’, ‘বিশ্লেষকরা মনে করেন’, ‘জানা গেছে’-এরকম বেশ কিছু ভিত্তিহীন খুঁটি লাগিয়ে মূলতঃ রিপোর্টার নিজেই তার মত পাঠকের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। সাহিত্যে তেমন অনুমান নির্ভর কোনো তথ্য এবং তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সাহিত্যাঙ্গনটি হচ্ছে মৌলিক বীজতলা। যারা প্রকৃত সাহিত্য চর্চা করতে চান কিংবা চাইবেন, তাদেরকে আলোকিত সত্যের অন্বেষী হতে হবে। ’
ড. হুমায়ুন আজাদের কথাগুলো কালে কালেই প্রযোজ্য থেকে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যারা নিজেদের লেখার স্থান আছে বলে যাচ্ছেতাই লিখে নিজের ভারিক্কি প্রকাশ করতে চান, সময় এবং প্রজন্ম একদিন তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবে। এটাই জাগতিক নিয়ম।
আবারও বলি, বছরের পর বছর দীর্ঘ প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে যারা বছরে একটি হলেও ছোটকাগজ প্রকাশ করেন, তারা সাহিত্যের জন্য মহত্ত্বম মানুষ। ছোট কাগজগুলো সর্বমহলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাভাষা ও সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ, উপকৃত হতে পরে।
যবনিকার আগে :
দুই বাংলায় এখন লিটল ম্যাগাজিন মেলা হচ্ছে নিয়মিত। লিটল ম্যাগাজিনের জনপ্রিয়তা, লেখক, পাঠক-পাঠিকা, পৃষ্ঠপোষক বাড়াতে এ উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসার দাবি রাখে। দুই বাংলা এবং প্রবাস থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগগুলো ফলক হিসেবে থাকবে সন্দেহ নেই। তবে কোনো কোনো লিটল ম্যাগ যখন- ‘অমুক দশকের এতোজন কবিই প্রকৃত কবি’ আর বাকিদের ‘গুডবাই’ জানিয়ে চিৎকার করে, তখন তাদের দীনতাই প্রকাশ পায়। সাহিত্যে এ মানসিকতা কতোটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্নটি ক্রমশঃ বাড়ছে।
কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিন মরমিচিন্তার লোককবিদের কিছু কিছু লেখা পুনঃমুদ্রণ করলেও এ নিয়ে বিশদ কাজ এখনও পর্যাপ্ত নয়। ছোট কাগজের পক্ষ থেকে ‘গীতিকবিতা সংখ্যা’, ‘ছড়া সংখ্যা’, ‘গান সংখ্যা’ প্রকাশ করার কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে। কিংবা ‘নাটক সংখ্যা’ প্রকাশের উদ্যোগও বিবেচনার দাবি রাখে। নিরঙ্কুশ সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ছোট কাগজ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। যারা সাহিত্যপ্রেমী এবং বিত্তবান, তাদের উদারচিত্ত ছোট কাগজের প্রতি হোক অবারিত।
আমরা দেখছি কর্পোরেট বেনিয়ারা এখন সাহিত্যমাঠেরও দখল চাইছে। রাষ্ট্র যখন
একজন প্রকৃত কবির মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন ব্যবসায়ী- মুনাফাখোররাই
লক্ষ টাকা তুলে দিচ্ছে একজন লেখকের হাতে। আর এভাবেই বাউল শাহ আবদুল
করিমের গান হয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের রিংটোন।
কিংবা `কোনো সাহিত্যকাগজ ও কোনো ব্যাংকের` জয়েন্ট ভেঞ্চারে যখন সাহিত্য
পুরস্কার ঘোষিত হচ্ছে, তখনও আমরা দর্শক হওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারছি না।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকার জন্য দরকারি, সরকারি এডভার্টাইজগুলো কেন পাবে না? সাহিত্যের বিকাশ ও লালনের জন্য সরকারি হস্ত কেন উদার হবে না? সমাজ গঠনে সাহিত্যের বিকল্প নেই। আর এর জন্য দরকার এই প্রজন্মের মননে অবারিত আলোর উন্মেষ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ২৪ নভেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, [email protected]