ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

তিনটি কবিতা ।। মাসুদ পথিক

কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪
তিনটি কবিতা ।। মাসুদ পথিক অলঙ্করণ: সব্যসাচী হাজরা

চাষিবক

বীজতলা হতে সামান্য দূরে
            ওই যে পাখির ঝাঁক
অবিরাম উড়ে উড়ে
কী গান গায় ওর অন্তঃপুরে
মননের সুর তুলে
চাষপ্রহর ঘুরে ঘুরে

এতো যে ওড়াউড়ি ভোর
তাড়াখাওয়া পাখির ঘোর
পাগল চাষার দেশে
বীজতলা হেসে ওঠে—
এই কাদাকাদা জমিনে
যৌন মৌসুম কাছে এসে
বলে, ‘কী গো কাদাবউ
        তুমি কি ঘুমের ঢেউ?

        বীজ বোনার বেলা যে যায়
        দূরমাঠে মরিচফুলের ছায়ায়
        কতো না নিভৃত জীবন হায়
        দেখো, উজ্জ্বলতা হারায়’

আজ উড়ে আসা পাখির
কোমল এই কিচিরমিচির
টেলিবক্সে করে ভিড়
আর গোলায় তুলে রাখা
শব্দ-ব্রহ্মে দু’চোখ ঢাকা
হাইব্রিড বীজ নিবিড়

ফলে ফেলে আসা মহাজনি সুতা
জড়িয়ে পেঁচিয়ে বহুজাতিকতা
লাঙল জোয়ালহীন চাষ-মহলে
থলথলে রঙিন পাজামার তলে
হারালো কৃষাণির তাঁতশাড়ি আশা
মাথার ওপর ভিনদেশি মেঘের বাসা

বীজতলায় ওড়াউড়ি দেখে
বৃদ্ধ চাষা স্মৃতিউড়ি মেখে
বীজের কষ্টে কেঁদে ওঠে
ছুঁড়ে দেয়া আগাছা অক্ষরে
নিড়ানি চালাবে কার তরে
ট্রাক্টরের শব্দে মাথা কোটে

খনার বচন বিফলে যায়
জঙ্গল-পাখি সুর হারায়
জীবন যুদ্ধে চাষা তাই
ভূমিহীন, অনাহারি গাথায়
যাপনে দিয়ে সময় বন্ধক
হলো, গুলিবিদ্ধ চাষিবক

পাড়ার চা-স্টলে টেলিবক্সে তাকালে
বিজ্ঞাপনকন্যা রোজ হেসে বলে,
‘এই নাও, নোতুন চাষার গান
ধরো, ধানের স্বপ্ন করেছি দান’...


ধানক্ষেতের আলে রবীন্দ্রসংগীত

অনেক ঘোরবাঁক ঘুরে শাহজাদপুরে
হঠাৎ ধানক্ষেতের আলে রবীন্দ্রসংগীতের সাথে দেখা
ওকে বললাম, কেমন আছ, কল্পবাসনা?

উত্তর দিলে চোখের ভাষায় ধানক্ষেতের কোমল ভঙ্গিমায়
অনেক কথা হলো ঘাম নিয়ে, কাম ধরে, গৃহস্থ প্রযোজনায়

আকাশে তাকালে, ছুটন্ত বালিহাঁসের অতীত নিয়ে উচ্ছ্বাস ঝরালে

রতি আক্রান্ত বৌদির প্রসঙ্গ এলে
ভাবি কিভাবে মানুষ লুকালে জঙ্গল নড়ে ওঠে
হারানো কয়েন জঙ্গলে খুঁজে পাওয়ার কী উপায়
বা ছায়া-নটের শুরু কোন প্রহরে এই নিরালা মাঠের কিনারে

অনুসৃত মেঘ ধরে যেতে যেতে আমি বেঁচে উঠি
আঙিনায় হাঁপিয়ে ওঠে আমার তৃষ্ণার্ত গরুগুলি
কল্পবাসনা, ক্ষুধার্ত রাখাল এইবেলা বাড়ি ফিরে যাবে
এইবার শেষ হোক তোমার শুদ্ধ শিল্প প্ররোচনা

এই চাষা আজীবন জেনো কাঁধে, উড়াই মৃত্যুরে
নাড়ার আগুন পোড়াই কাঁচাপিঠা সুপ্ত-কোজাগরে
চাষার ভেতরে তুমি কি কুড়াও দার্শনিক বিকারে
কী করবে বালিহাঁসের সংখ্যা গুণে গুণে মাঠের এই কিনারে

যখন মেঘেরা পেয়ে বসেছে তোমার রঙিলা বজরা
আসন পেতে বজরার চাতালে, দেখো
সৌন্দর্য ও বিষাদ ফিরছে পুনরায় গৃহে
দিনান্তের হারিকিরি ওড়ে মেঘের প্রতিভাষে
একটি দিকহারা হরিয়াল এসে বসে বজরার ছাদে
পাৎলুন গোটাও বাসনা, কলা উপচে পড়ছে তোমার কল্পআসরে

কবিতার খাতায় বুনে রাখো তিলঘুঘুদের নামজারি
তীরহারা পরিযায়ীর গন্তব্যে পৌঁছতে না পারার কাহিনী
ঘনশীতের দেশে তার আর ফেরা হবে না
সুফিপাখিদের ফুরিয়ে আসে জীবন, চৈতন্যের গ্রন্থনা
ওদের হাড়ে বাড়ন্ত ভবিষ্যতের খনিজপ্রণালি

এপার-ওপার করে চাষার সোনার তরী

দূরে, আমার সাঁওতাল মেঘেরা হেসে কুটিকুটি

দেখো আলপুরে ভাটিয়ালি ভরে আমার কৌম-মিতালি
কণ্ঠে ধরে রবীন্দ্রসংগীতহীন এক র-ভঙ্গিমা
অনুস্বরে কেবলি চাপা পড়ে তোমার তাড়াহীন গরিমা

লুম্পেন স্বভাবের ঘোড়াগুলি আবার
কল্পবাসনার ঘরে, দেয়ালের ফ্রেম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে দিকে দিকে
যখন ইতিহাসে পাতানো প্রেমের লিরিক হয়
নেড়িকুকুরের ঘেউ কোমল সুরে সুরে

জানি আজও হাওয়াবাতাসে ছড়াও কতো যে ছলনানির্ভর সেই সুর
আলপথে প্রতিবার মুখোমুখি এই চাষা ও কল্পবাসনার ঘোর
 
কাস্তের ডগায় বিঁধিয়ে চলি আহত কিছু আঁভাগার্দ রচনা


বরার ধানক্ষেত ও বোয়াল মাছের রাত

কোঁচ তাক করে দাদা ছুটছে বরার ক্ষেতে
গভীর রাত, টুপটাপ শব্দ জলের, লাডি-পুঁটি লাফিয়ে ওঠে
                              পলকে হারায়, অতলে
বোয়াল মাছের দাপর শুনি, দূর-আতালে
ধানের বুক নড়ে-চড়ে, বিলের চাতালে
হ্যাজাকের আলো যায় সরে সরে, মিটিমিট জ্বলে
শিকারী চোখের মণিতে আলোর ঝিলিক, ফলে

ফলে আশা করি এইবার হবে বিদ্ধ, পলাতক মাধুরী-কাতল
ভরে যাবে নাও, মাছের রোশনাই জড়াবে গাঁয়ের লোক
                 বোয়াল হারায় কালাকাল আঙিনার বুক

সেই সব গল্প, মেঘ জড়িয়ে গেলো
অনেক সময় পর, লালসা পানে চলো, চলো
বোয়ালের পেটির পাশে কোকাকোলাদুপুর ঋদ্ধ হয়ে এলো
রন্ধনকালীন ঘ্রাণে গ্লাসের জলে দোলে কার ছায়া, অপূর্ব অতীত!

চলো আবার ধরি তার হাত, সুবর্ণ ইতিহাসের অভিঘাত
শিকারী দাদুর রাত, ছোটবোনের কোমল আঘাত
ভালো হয়, রণকৌশল ভুলে
ভালো হয়, ময়নাবিল শুকানোর কালে
যদি ভাষা বদল করি প্রফেশনে, মান ও মননে—

অতঃপর যখন বিকেল, চলে সূর্যাস্ত ছাড়া মেঘপলাতকা
ওকে রেখেছি দেয়ালে দেয়াল বাঁধা, হৃদয়পটে আঁকা
আর দেখি মনোলোভা, প্যাকেটে প্যাকেট মায়াটুকু রাখা

প্রতিটি সূর্যাস্ত যায় বোয়াল মাছের পেটে—
দেয়ালটি শিকারি দাদুর ছবি পাশে নিয়ে থাকে
আজ বোয়ালের পেটে, আমি কী উপায়ে থাকি
আমার পেটে বোয়াল; বোয়ালের পেটে আমি
নাগরিক আমার আমির এই মাখামাখি

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।