‘কিন্তু ওয়াগনারের রেকর্ড শোনা তো কোনো কাজেই আসেনি’, সে বললো। ‘আরে নাহ্, এক্কেবারেই কোনো কাজে আসেনি।
‘তোমাদের কোনো সমস্যা হয়েছিল?’
আমি আবারও আমার চোখ কচলালাম।
‘ওই এক ধরনের হয়েছিল আরকি! আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবো এমন কিছু নয় অবশ্য। কিন্তু এর পর থেকেই ব্যাপারগুলো বদলে যেতে থাকলো। এটি এক ধরনের সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠলো। যেমন ধরো- আমি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলাম এবং স্নাতক হলাম, আর এই আইন-ব্যবসার প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে শুরু করলাম এবং বার (ওকালতি) পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করে দিলাম এবং তোমার সঙ্গে দেখা হলো এবং বিয়ে করে ফেললাম। আমি কক্ষনো আর এমনটি করিনি। হামলা করিনি আর কোনো বেকারি। ’
‘এই তা হলে ব্যাপার?’
‘হ্যাঁ, এই হচ্ছে পুরো ব্যাপার। ’ আমি বিয়ারের শেষ ক্যানটাও সাবাড় করলাম। পুরো ছটি ক্যানই এখন শেষ হয়ে গেলো। ক্যানের মুখ টেনে খোলার ছয়টি আংটা এখন অ্যাশট্রেতে পড়ে রয়েছে মৎস্য কুমারীর আঁশের মতো।
অবশ্যই এটাও সত্য নয় যে, বেকারি হামলার ফলে কিছুই ঘটেনি। এমন অনেককিছুই রয়েছে যা আপনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবেন সহজেই, কিন্তু আমি তাকে সেসব বলতে চাচ্ছিলাম না।
‘তা, তোমার সেই বন্ধু, সে এখন কী করে?’
‘আমার কোনো ধারণা নেই। কিছু একটা ঘটেছিল, কিছুই-না ধরনের একটা কিছু এবং আমরা একসঙ্গে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি আর তাকে দেখিনি। আমি জানি না সে এখন কী করছে। ’
কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বললো না। সে হয়তো বুঝতে পারছিল আমি তাকে পুরো কাহিনিটি বলিনি। কিন্তু সে আমাকে এ ব্যাপারে চাপ দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলো না।
‘এখনও’, সে বলে উঠলো, ‘তা হলে তোমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার ওটাই কারণ? সরাসরি কারণটা তা হলে বেকারি হামলা!’
‘হয়তোবা। আমার অনুমান আমরা দু’জনে যতোটুকু বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা ছিলো তার চেয়েও সাংঘাতিক। এর পর থেকেই বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা রুটি এবং ওয়াগনারের ভেতরকার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমরা নিজেদের অবিরাম জিজ্ঞেস করছিলাম আমরা ঠিক কাজটি করেছি কিনা। আমরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। অবশ্যই, তুমি যদি ব্যাপারটাকে যুক্তিযুক্তভাবে দেখো তো বুঝতে পারবে আমরা ঠিক কাজটিই করেছিলাম। কেউ আঘাত পায়নি। প্রত্যেকেই যা যা চেয়েছিল তাই তাই পেয়েছিল। ওই বেকারি মালিক- আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারি না সে যা করেছিল তা সে কেন করেছিল- কিন্তু সে যা-ই হোক, সে তার ওয়াগনার-চাল দিয়ে সফল হয়েছিল। এবং আমরা মুখ পুরে রুটি খেতে সফল হয়েছিলাম।
‘কিন্তু এতোকিছুর পরেও আমাদের মনে হয়েছিল আমরা একটি সাংঘাতিক ভুল করে ফেলেছি। এবং যে করেই হোক, এই ভুলটা স্রেফ থেকে গিয়েছিল, সমাধানহীনভাবে, আর তা এক কালো ছায়া ফেলেছিল আমাদের জীবনে। এই জন্যই আমি ‘অভিশাপ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। এটা সত্য। এটি একটি অভিশাপের মতোই ছিলো। ’
‘তুমি কি মনে করো এখনও তোমার এই অভিশাপটা আছে?’
আমি অ্যাশট্রে থেকে বিয়ারের ক্যান টেনে খোলার ছয়টি আংটাই হাতে তুলে নিলাম এবং এগুলো দিয়ে ব্রেসলেটের আকারে একটি অ্যালুমিনিয়ামের আংটি তৈরি করলাম।
‘কে জানে? আমি জানি না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই দুনিয়াটা অভিশাপে ভরা। এটা বলা খুব শক্ত কোন অভিশাপটা কারও সবকিছু বরবাদ করে দেবে। ’
‘ওটা সত্য নয়। ’ সে ঠিক সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললো। ‘এ ব্যাপারে যদি ভেবে থাকো তো আমাকে বলতে পারো। আর যতোক্ষণ না তুমি নিজে এই অভিশাপকে ছিন্ন করছ ততোক্ষণ এটি তোমার সঙ্গে দাঁতব্যথার মতোই লেপ্টে থাকবে। মরণ পর্যন্ত এটি তোমাকে যন্ত্রণা দেবে। আর কেবল তোমাকে নয়, আমাকেও যন্ত্রণা দেবে। ’
‘তোমাকেও?’
‘বেশ, শোনো তা হলে, আমি এখন তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু, তাই নই কি? তুমি কেন ভাবছ আমরা দু’জনেই ক্ষুধার্ত? আমি আমার জীবনে আর একটিবারের জন্যও এমন ক্ষুধা অনুভব করিনি, যতোদিন না তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার কি মনে হয় না ব্যাপারটা অস্বাভাবিক? তোমার অভিশাপ আমার ওপরেও ভর করছে। ’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তারপর আমি আংটা দিয়ে বানানো আংটিটা ভেঙে ফেলে আবার অ্যাশট্রেতে সেগুলো রেখে দিলাম। আমি জানতাম না সে সঠিক কিনা, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম সে একটা কিছু বলতে যাচ্ছে।
![লাইন](http://103.16.74.202/media/imgAll/2016March/bg/line-link20160328180539.jpg)
ক্ষুধার অনুভূতিটা আবারো ফিরে এলো, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো তীব্রভাবে এবং এ থেকে আমার ভীষণ মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলো। পেটের প্রতিটি টনটনে ব্যথা এমনভাবে পৌঁছে যাচ্ছিল মগজের ভেতরে, যেনো আমার ভেতরটা সব ধরনের জটিল যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।
আরও একবার আমি আমার সাগরতলের আগ্নেয়গিরির দিকে তাকালাম। সেখানকার পানি আগের চেয়েও টলটলে, স্বচ্ছ- অনেক বেশি স্বচ্ছ। খুব কাছ থেকে না তাকালে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে এটি সেখানে রয়েছে। অনুভূতিটা এমন হয় যে নৌকোটি হাওয়ার মাঝ দিয়ে ভাসছে, একেবারেই কোনো অবলম্বন ছাড়া। আমি সাগরতলের প্রতিটি নুড়িই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাকে যা করতে হচ্ছিল তা হচ্ছে খুঁজে খুঁজে এগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়া।
![লাইন](http://103.16.74.202/media/imgAll/2016March/bg/line-link20160328180539.jpg)
‘আমরা সবে দু’ সপ্তাহ ধরে একসঙ্গে থাকছি’, সে বললো, ‘কিন্তু এর পুরোটা সময় ধরেই আমি এক ধরনের অদ্ভুত উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ’ সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো এবং হাত দু’টি টেবিলের উপর তুলে এনে এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের আঙুল জড়িয়ে ধরে রাখলো। ‘আমি অবশ্য এখনকার আগ পর্যন্ত জানতাম না যে এটা একটা অভিশাপ। এটাই সবকিছুর ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তুমি একটা অভিশাপের ভেতরে রয়েছ। ’
‘কোন ধরনের উপস্থিতি টের পাচ্ছো?’
‘যেমন ধরো সিলিং থেকে ঝুলে থাকা এই ধুলো জমে জমে ভারী হয়ে থাকা পর্দাটা, যেটি কয়েক বছরেও ধোঁয়া হয়নি। ’
‘হয়তো এটি কোনো অভিশাপ নয়। হয়তো স্রেফ এটিই আমি’, আমি বললাম এবং হাসলাম।
সে হাসলো না।
‘না, এটিই তুমি নও’, সে বললো।
‘ঠিক আছে, ধরলাম তুমিই ঠিক। ধরলাম এটি একটি অভিশাপ। তা আমি এ ব্যাপারে কী করতে পারি?’
‘অন্য একটি বেকারিতে হামলা চালাও। এখনই। এক্ষুনি। এটাই একমাত্র পথ। ’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। এখন। যেহেতু এখনও তুমি ক্ষুধার্ত আছো। যা তুমি শেষ না করে রেখে দিয়েছিলে তা এখন তোমাকে শেষ করতেই হবে। ’
‘কিন্তু এখন তো মাঝরাত! এখন কি কোনো বেকারি খোলা পাওয়া যাবে?’
‘আমরা একটা খুঁজে বের করব। টোকিও একটি বড় নগরী। এখানে কমপক্ষে এমন একটি বেকারি তো নিশ্চয়ই খোলা পাওয়া যাবে যেটি সারারাত খোলা থাকে। ’
রাত আড়াইটায় আমরা আমার করোলা গাড়িটিতে গিয়ে উঠলাম এবং একটি বেকারির খোঁজে টোকিওর রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আমি স্টিয়ারিং সিটে বসলাম এবং সে নেভিগেটর সিটে বসলো। ক্ষুধার্ত ঈগল যেমন শিকার খুঁজে বেড়ায় ঠিক সেভাবেই আমরা দু’জনে একটি বেকারি খুঁজতে থাকলাম। পেছনের সিটে একটি লম্বা, মরা, শক্ত মাছের মতো পড়ে রয়েছে রেমিংটন অটোমেটিক শটগানটা। এটির কার্তুজগুলো আমার স্ত্রীর উইন্ডব্রেকার জ্যাকেটের পকেটে খচমচ করছিল। গাড়ির ড্যাশবক্সে আমাদের দু’টি স্কি করার কালো মুখোশ রয়েছে। কেন আমার স্ত্রীর একটি শটগান রয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। বা ধারণা নেই কেন তার স্কি করার মুখোশ রয়েছে সে ব্যাপারেও। আমাদের দু’জনের কেউ-ই কখনও স্কি করিনি। এ বিষয়ে সে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি এবং আমিও কখনও জিজ্ঞেস করতে যাইনি। বেশ বুঝতে পারছি- বড় অদ্ভুত এই বিবাহিত জীবনটা!
নিখুঁত সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে পথে পথে ঘুরেও কিন্তু আমরা সারারাত খোলা থাকা কোনো বেকারি খুঁজে পেলাম না। খালি রাস্তা ধরে আমি গাড়ি দাবড়ে চলে গেলাম ওয়োগি থেকে শিনজুকু, ওসুয়া ও আকাসাকা, আইয়ামা, হিরু, রোপ্পনগি, দাইকানইয়ামা ও শিবুয়াতে। গভীর রাতের টোকিওতে সব ধরনের মানুষ রয়েছে, রয়েছে সব ধরনের দোকান, কিন্তু কোনো বেকারি খোলা নেই।
দু’বার আমরা পুলিশের টহল-গাড়ির মুখোমুখি হয়েছিলাম। একবার যখন রাস্তার পাশ ঘেঁষে অস্পষ্ট কিছু দেখার চেষ্টা করছিলাম; আরেকবার টহলগাড়িটি ধীরে ধীরে আমাদের পেরিয়ে গিয়েছিল এবং খুব চুপিসারে আমাদের অতিক্রম করেছিল, শেষমেশ দূরে চলে গিয়েছিল। দু’বারই আমার বগলতল ভিজে উঠেছিল, কিন্তু আমার স্ত্রীর একাগ্রতা কখনও ক্ষুণ্ন হয়নি। সে ঠিকই সেই একইভাবে বেকারি খুঁজে যাচ্ছিল। যতোবারই সে তার শরীর নাড়াচাড়া করছিল ততোবারই তার পকেটে কার্তুজগুলো বালিশের ভেতরে বাজরার তুষের মতো ঝনঝনিয়ে শব্দ করছিল।
‘বেকারির কথা ভুলে যাওয়াই বরং ভালো’, আমি বললাম। এতো রাতে কোনো বেকারিই আর খোলা নেই। অবশ্যই পরিকল্পনা করে নামা উচিৎ ছিল এই ধরনের কোনো বিষয় বা...’
‘গাড়ি থামাও!’
আমি ধপ করে ব্রেক কষলাম।
‘এই সেই জায়গা’, বললো সে।
দোকানগুলোর টেনে নামিয়ে বন্ধ করে রাখা শাটারগুলো রাস্তার দু’পাশেই নিস্তব্ধ কালো দেয়াল তুলে রেখেছে। একটি নরসুন্দরের দোকানের সাইনবোর্ড এমনভাবে ঝুলে রয়েছে যে অন্ধকারে দেখে মনে হচ্ছে এটি কাচের কোনো প্যাঁচানো শীতল চোখ। শুধু শ-দু’য়েক গজ সামনে একটি ম্যাগডোনাল্ড হ্যামবার্গারের দোকানের আলো-ঝলমলে উজ্জ্বল সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কিচ্ছুটি নেই।
‘আমি তো কোনো বেকারি দেখতে পাচ্ছি না’, আমি বললাম।
কোনো কথা না বলে সে ড্যাশবোর্ড খুলে কাপড়ের টেপ-রোল টেনে বের করলো। এটি হাতে নিয়ে সে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আমিও আমার পাশ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। গাড়ির সামনে গিয়ে সে হাঁটু মুড়ে বসে সে টেপ-রোল থেকে বেশ খানিকটা টেনে ছিঁড়ে নিলো এবং তা দিয়ে লাইসেন্স প্লেটটা মুড়ে দিলো। এরপর সে গাড়ির পেছনে গেলো এবং সেখানেও একই কাজ করলো। তার কারবার-সারবার দেখে মনে হচ্ছিল এ ব্যাপারে চর্চা করে করে সে খুব দক্ষ। আমি রাস্তার প্রতিবন্ধকের উপর দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৭
এসএনএস
** দ্বিতীয় বেকারি হামলা | হারুকি মুরাকামি/পর্ব-১