ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণ কাহিনী

কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৭
কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১) কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা

স্কপিয়ে শহরের বাসস্ট্যান্ডে নেমে 'হোটেলে কোকা'র পানে ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই তুর্কি ট্যাক্সি ড্রাইভার শোনালো পিলে চমকে উঠবার মতো এক দুঃসংবাদ। মুখ দিয়ে ভকভকিয়ে সস্তা বিড়ির গন্ধ ছড়িয়ে সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে নিলো, আমেরিকানা? তা হ্যাঁ, বসবাস সূত্রে ওই মুল্লুকেই আমার বর্তমান আস্তানা হলেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা মানুষের কাছে নানা কারণে দেশটির নাম-ডাক খুব একটা সুবিধের নয়।

তাছাড়া অন্য আরেক গোত্রের মানুষ এই দেশের নামটি শুনলেই ঝমঝমিয়ে ডলার ছড়ানো মালদার পার্টির কথা মনের মধ্যে ভেবে বসেন। আমি তাই ওই দেশের সংশ্রব এড়িয়ে ঝটপট জবাব দেই, নারে ভাই, বাংলা মুল্লুকের লোক আমি, আর আমার এই বাদামি গাত্রবর্ণ দেখে তোমরা আমাকে 'আমেরিকানা' বলেই বা মনে হয় কীভাবে?

মহাবীর আলেকজান্ডার- ছবি: সংগৃহীতবেশ বিরক্তির স্বরে এরপর সে প্রশ্ন করে, এই পোড়ার দেশে কি করতে মহাশয়ের আগমন? নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই যে আমার আগমন সেটি এই কাঁচা-পাকা দাড়ি ওঠা রোগাপটকা ড্রাইভার সাহেবের কাছে পাড়তেই সে শোনায়, কিছুদিন আগে গাড়ি চালানো সেরে বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে বসে টেলিভিশনের সংবাদ শুনছে, এমন সময় নাকি সংবাদে ভেসে ওঠে, স্কপিয়ে শহরে তিন পর্যটককে মাফিয়ারা গলা কেটে খুন করেছে।

এই গলা কাটার কথাটি শোনাবার সময় তার ডান হাতটি স্টিয়ারিং থেকে উঠিয়ে নিজের গলায় পোঁচ দেওয়ার মতো করে দেখিয়ে সে মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ করে, যাতে তার অভিনয়ের মাধ্যমে আসল ঘটনা বুঝতে আমার তেমন অসুবিধে না হয়। আমাকে বেচারা পরামর্শ দেয়, যত তাড়াতাড়ি পারো এখান থেকে ব্যাগপত্তর গুটিয়ে ওখ্রিদের দিকে চলে যাও। ওদিকে হ্রদের শান্ত জল আছে, পরিবেশও বড্ড নিরিবিলি, এই শহরে এমনিতেও দেখবার বা করবার মতো কিছু পাবে না।

নতুন এক দেশে নেমে পয়লা পয়লাই এমন অলক্ষুণে কথা শুনলে কার না ভয় লাগে? আমি হোটেলে গিয়ে তাই কাচুমাচু হয়ে প্রথমেই রিসিপশনের দশাসই মাসলম্যান টাইপের ছেলেটিকে খুলে বললাম এই শঙ্কার কথা। আমার কথা শুনে ছেলেটি তো হেসেই খুন। আমাকে সে বলে, তোমাকে ওই ড্রাইভার নিশ্চয়ই গুল মেরেছে। তা তোমার কাছ থেকে ভাড়া কত নিল বলতো। আমি দুশো দিনারের কথা বলতেই সে বলে ওঠে, ঠিক যা ভেবেছিলাম, ব্যাটা এক আস্ত বিটকেল। স্টেশন থেকে এখানের ভাড়া বড়জোর একশ দিনার। আর তোমার কাছ থেকে কিনা আদায় করেছে দুশো, তবেই বোঝ। আর নিরাপত্তার কথা বলছো?

আমাদের এখানে তুমি রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত বাইরে হাঁটাহাঁটি করলেও কেও তোমায় কিচ্ছুটি বলবে না। বিশ্বাস না হলে আজ রাতেই দেখো এ শহর কত রাত অবধি গমগমে থাকে। ছেলেটির কথায় মনের আশঙ্কার মেঘ কিছুটা হলেও যেন কমলো।

আমার হোটেলটি স্কপিয়ে শহরের পুরনো বাজারের সংলগ্ন অঞ্চলে, ঠিক পেছনেই শুরু হয়েছে বাজারের সীমানা। আমি তাই খাবারের দোকানের হদিশ জিজ্ঞেস করলে সেই ছেলেটি বলে, দু’কদম হাঁটলেই গণ্ডায় গণ্ডায় খাবারের দোকান পাবে। সে কিন্তু মিথ্যে বলেনি। সত্যিই একেবারে হাতের নাগালের ভেতরেই বেশ কিছু বলকানি রেস্তোরাঁ। পথের পাশেই উনুন ধড়িয়ে ভাজা হচ্ছে গরমা-গরম চেভাপি আর শিক কাবাব। আমি এক প্লেট শিক কাবাবের অর্ডার দিয়ে বেয়ারার রেখে যাওয়া জলের গ্লাসে উড়ে এসে বসা একটি মাছিকে আলগোছে সরিয়ে দেই।
মায়ের সাথে তাঁর সন্তানের নানা মুহূর্ত- ছবি: সংগৃহীত
পাক্কা বিশ মিনিট পর যখন খাবার উপস্থিত হয়, তখন আমার আরেক দফা খাবার লগ্ন প্রায় সমাগত। বেয়ারার আনা শিক কাবাবের সঙ্গে এসেছে কিছু সেঁকা রুটি আর একটি থালায় পদ্মফুলের পাপড়ির মতো করে সাজিয়ে রাখা বলকানিয় শসার টুকরো, যার মাঝখানটায় হাসি মুখে চেয়ে আছে একটি নুন মাখানো জলপাই।

বিলম্ব হেতু উদ্ভূত বিরক্তি চেপে ধরে খাবারে মুখ বসাতেই মনে হয় এই দেরির ফুসরতে রাঁধুনি হয়তো আচ্ছাসে নুন ঢেলেছে এই মাংসে। ধুচ্ছাই বলে যে অন্য দোকানে যাবো, কিন্তু সেখানেও যদি আবার এমনই করে লম্বা সময় লাগে খাবার পেতে? এই পড়ন্তবেলায় অতটুকু ঝুঁকি হয়তো নেওয়া যায় না। তাই বেশ ক্লেশ নিয়েই ওই খাবারটুকু শেষ করতে হলো।

অবশ্যম্ভাবীভাবেই উদরপূর্তি হলেও মনপূর্তি হলো না। মনকে তাই রাতের খাবারের বেলায় ক্ষতিখানি পুষিয়ে নেওয়ার প্রবোধ দিয়ে বাজারের ভেতরে ইতঃস্তত কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। বাজারের ভেতরটি সুনসান নীরব, রোববার বিধায় অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপিতে তালা। শুধু দু’একটা মালিকবিহীন বেড়াল এদিক-ওদিকে খাবারের গন্ধ শুকে অভিসন্ধিমূলক চাহনি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাজারটি জনমানববিহীন হলেও মধ্যিখানের মসজিদটি প্রাণহীন নয়, সেখানে সামনের এক বাঁধানো প্রস্রবণের জল দিয়ে ওজু করে কিছু মুসুল্লি নামাজের জন্যে নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছেন।
মায়ের সাথে তাঁর সন্তানের নানা মুহূর্ত- ছবি: সংগৃহীত
আমি তাদের ফেলে হেঁটে যাই বাজারের শেষ মাথা অবধি, কিন্তু সেই নিস্তব্ধ বাজারে আর কোনো কোলাহলের সন্ধান পাই না। মনে মনে তাই ভাবি এবেলা না হয় হোটেলে ফিরে গিয়ে গভীর রাতে আশপাশে কিছুটা পাঁয়চারি করা যাবে, দেখা যাক হোটেলের সেই ছোকড়ার কথা মোতাবেক সত্যিই এ শহর কতটা নিরাপদ!

কোকা হোটেল থেকে এ শহরের প্রাণকেন্দ্রের চত্বরটি খুব বেশি দূরে নয়। হোটেলের পেছনেই বাজারের গলির মাঝ দিয়ে সেখানে পৌঁছুতে সময় লাগে মিনিট পাঁচেকের মতো। পরদিন সকালে প্রথমেই হেঁটে যাই সেখানে। ঘড়ির কাটায় সময় ন'টার মতো, কিন্তু এখনই রোদ বেশ তেতে উঠেছে।

ভারদার নদীর উপর নির্মিত এক প্রস্তর সেতু পেরিয়ে ওপারে যেতেই অভ্যর্থনা জানান মহাবীর আলেকজান্ডার। আর বাঁ ধারে অপূর্ব এক প্রস্রবণের মাঝে কষ্টি পাথরের ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তলা হয়েছে শিশুর সঙ্গে তার মায়ের জীবনকালের কয়েকটি ধাপ- যে ধাপে প্রথমে মা তাঁর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, স্তন পানে বড় করেন, নানা মুহূর্তে জড়িয়ে ধরেন পরম মমতায়।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।