রেলগাড়ি, সাপ-লুডু, বল ছুড়ে ছুড়ে বর্ণ, ফুল-ফল-গাছ-প্রাণী চেনানোর মজাদার খেলার সুযোগও ছিল। সিসিমপুরের কর্মীরা শেখাতেন নানা স্বাস্থ্যবিধি, দিতেন উপহার আর শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন।
তবে এবার সবকিছুই এতো ছোট্ট হয়ে গেছে যে, হালুম, টুকটুকি আর ইকড়িদের আসবার নির্দিষ্ট সময়ের ফাঁকে ২৫/৩০ জন শিশুর দৌড়ানো-লাফানো ছাড়া আর তেমন কোনো আনন্দের সুযোগ থাকছে না। তাও সংকীর্ণ পরিসরের কারণে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজরদারি করতে হয়- ‘পাছে না পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়’। বার বার চেচিয়ে সতর্ক করতে হয় যার যার আদরের সন্তানকে। আবার কিছুক্ষণ পর পর নতুনদের সুযোগ করে দিতে বাধ্য হয়েই মঞ্চে থাকা ছোটদের নামিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, আর অনেকেই না নামার জেদ ধরছে, অনেকে নেমে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে।
অভিভাবক আর শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়ে যাচ্ছেন নির্দিষ্ট সময় পর পর ইকড়িরা যখন মঞ্চে এসে পারফরম করছে। আগেরবার সব ছোটরাই সুযোগ পেয়েছে ওদের দেখবার আর এবার চারপাশে লাগোয়া স্টল আটকে দাঁড়িয়ে বা বড়দের কোলে-ঘাড়ে চড়েও সম্ভব হচ্ছে না।
বইমেলার শেষ সময়ে শনিবারের (২৫ ফেব্রুয়ারি) ‘শিশু প্রহরে’ এবারে প্রথম বইমেলায় এসেছিল সাত বছরের অবন্তিকা। গাদাগাদি আর ভিড়ে দূরে দাঁড়িয়ে বারবার উঁচু হয়েও ইকড়িদের প্রদর্শনী দেখতেই পায়নি সে আর তার অনেক বন্ধুরা। অথচ সকাল থেকে তিনদফা মঞ্চে উঠেছিল ওরা। আর গতবারের মেলায় সব ধরনের মজাই করতে পেরেছিল এসব ছোট্টমণিরা। শেষমেষ বার বার মঞ্চে উঠে কিছুক্ষণ করে লাফালাফি-দৌড়ে সিসিমপুর মঞ্চ ছাড়তে হয়েছে।
এ বিড়ম্বনার কারণ জানা গেলো, শিশু চত্বরটির পরিসর কমে যাওয়া। তাই সন্ধ্যার পরে বইমেলা ছেড়ে যাওয়ার সময় অবন্তিকার আক্ষেপ, ‘ইস, শিশু চত্বরটা যদি আরও বড় করা যেতো!’
মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রোজাও শিশু চত্বরে এসে বেশি ভিড়ের কারণে বই বাছতে-কিনতে পারছিল না। এ বছরের মেলায় প্রথম এসেছে টুকটাক লেখালেখি করা মেয়েটিও। তার পছন্দ, ছড়া, গল্প, ডিটেকটিভ বই। সঙ্গে আসা বাবা সাইফুল আলম ও মা জেসমিন আরাও শিশু চত্বরের কম পরিসর নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, বইমেলা তো কেবল বইয়ের মাধ্যমে ছোটদের জগৎ চেনানোর, শেখানোর উপলক্ষই নয়, নাগরিক ‘বন্দিজীবন’ থেকে খানিকটা ‘মুক্তি’ দেওয়ারও। আনন্দে-উচ্ছ্বাসে-উৎসবে বই কেনার সুযোগ করে দেওয়ার দাবিও জানান তারা।
গত তিন বছর ধরে বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত পরিসরে বইমেলা সম্প্রসারণের পাশাপাশি শিশু চত্বরও বসছে সেখানে। তবে এবার শিশু চত্বরের জায়গা কমানো এবং চত্বর লাগোয়া বিশাল জায়গাজুড়ে ডিএমপি’র পুলিশ কন্ট্রোলরুম ও সেটিকে ঘিরে রাখতে গিয়ে বাঁশ-দড়িতে ঢেকে রাখা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করছেন অনেকে।
ফুলকি বইকেন্দ্রের প্রকাশক শিশু সাহিত্যিক-সংগঠক মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেড়যুগ আগে আমাদের দাবি-শিশুবন্ধনের কারণে বাংলা একাডেমি বইমেলায় শিশু চত্বর করেছিল। তবে বাংলা একাডেমির স্বল্প পরিসরের বইমেলার ভিড়-ঠেলাঠেলিতে আর কম জায়গার শিশু চত্বরের বিড়ম্বনা ছিল অনেক। মাঝে মাঝে ছোটদের হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও শোনা যেতো তথ্যকেন্দ্রের মাইকে’।
‘গতবার এ অংশে শিশু চত্বর এনে শিশুবান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টির ধারা শুরু হয়েছিল, যা আমাদের ছাড়াও শিশু ও তাদের অভিভাবকদের অনেক বেশি আশাবাদী করে তুলেছিল। কিন্তু এ বছর সে পরিবেশ নেই। তাহলে শিশুরা মনের আনন্দে-হেসে-খেলে বই দেখে দেখে, কিনে কিনে, পড়ে পড়ে সঠিকভাবে বড় হবে কিভাবে?’
অন্যবারের চেয়ে বিক্রিও কমে গেছে বলে আক্ষেপ করেছেন শিশু চত্বরের বেশিরভাগ শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান-স্টলের প্রকাশক-কর্মীরাই। ছোটদের মেলার জুয়েল আহসান ‘মোটামুটি’ বলে বেচা-কেনার দুর্দশা তুলে ধরলেও গতবার বেশি ছিল বলে জানান তিনিও।
সিসিমপুরের মূল প্রতিষ্ঠান সিসেমি ওয়াকর্শপ, বাংলাদেশের গবেষক রাইসুল ইসলাম সৈকত বলেন, ‘আমরা টিভি প্রোগ্রামের ধারণা থেকে বের হয়ে শিশুদের সব কাজে সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছি সিসিমপুরকে। পাঁচ বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আরো বেশি শিক্ষামূলক করতে এবং শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আমরা। এজন্য এবার বড় জায়গা পেলে আরও ভালো হতো’।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএসআর