২২ জুলাই, রোববার নিউইর্য়ক থেকে হুমায়ূনের মরদেহ ঢাকার আসার কথা থাকলেও আসতে পারেনি। সে বিলম্বও রহস্যময় এবং প্রশ্নবিদ্ধ! এদিকে প্রিয় লেখকের জন্যে লাখো মানুষের উন্মুখ অপেক্ষা।
সহস্র মানুষ চোখ মেলে দেখছিলো, হাজার মাইল পেরিয়ে আটলান্টিকের ওপার থেকে আসছেন তিনি। হিমশীতল মৃত্যুর মায়াবী-রহস্য চাদরে আবৃত হয়ে। তবুও তিনি আসবেনই। প্রিয় দেশ ও প্রিয়তম মানুষের কাছে। ২৩ জুলাই, সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বদেশের সবুজে-শ্যামলে-স্মৃতিতে-সত্তায় ফিরে আসছেন তিনি। অনিন্দ্য সুন্দর সকালে অশ্রু ও পুষ্পের মেলবন্ধনে নিজস্ব মৃত্তিকা ও শেকড়ে প্রত্যাবর্তন করছেন অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে প্রিয় হারানোর বেদনায় মানুষ অপেক্ষা করছে হুমায়ূনের ‘ঘরে ফেরা’র জন্য; নায়কের বীরোচিত প্রত্যাবর্তনের জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিলো সমগ্র বাংলাদেশ। অপেক্ষায় রাজধানী ঢাকা। শহীদ মিনার। মাতা, পুত্র, কন্যা, পরিজন। কোটি কোটি দর্শক, পাঠক। অখণ্ড জনতা। অপেক্ষায় বেদনাহত শেষ ঠিকানা নুহাশ পল্লী। দখিনা হাওয়া।
কেন্দুয়ার কুতুবপুর, সোহাগী রেল স্টেশন। অচিনপুর। সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট। অসংখ্য হলদে জামার হিমু। শুভ্র। ভাসমান মেঘ ও বর্ষণের স্মৃতি। সবাই অপেক্ষমাণ। বাংলাদেশের মানুষ এমন বুকভরা অপেক্ষা করতে পারে শুধুমাত্র তার জন্যই। অপেক্ষা করেছিল দিল্লি। সাড়ে ছয় শ‘ বছর আগে। রাজ্যহারা মুঘল সম্রাট নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ূনের জন্য। বাংলাদেশ আজ অপেক্ষা করছে আরেক হুমায়ূনের। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একচ্ছত্র সম্রাট হুমায়ূন আহমেদ।
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বরপুত্র এই রাজন্য কোনো দেশ বা জনপদ দখল করেননি। জয় করেছেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয় এবং বাংলা ভাষার অসীমান্তিক ভূগোল।
বাংলা কথাসাহিত্য, সংস্কৃতির জগত, প্রকাশনা শিল্প, পাঠক মনন জেগে ওঠেছিল তার অলৌকিক স্পর্শে। জাগরণের একটি উতুঙ্গ ঢেউ নেচে ওঠেছিল তাকে ঘিরে। পাঠ-বিপ্লবের ঘোরতর আন্দোলনে কেঁপে ওঠেছিল বইপাড়া, ছাপানো অক্ষর, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, স্বর আর ব্যঞ্জন বর্ণসমূহ। পূর্ব বা পশ্চিম নয়, তার হাত ধরে আমরা গভীর অভিনিবেশে আমাদেরই পাঠ ও অধ্যয়ন করেছিলাম। আমাদের পারিপার্শ্ব, জীবন-যাপন, মানব-মন, মনস্তত্ত্ব, আনন্দ-বেদনা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাগুলো হৃাদিক স্বরে কথা বলেছিল তারই জাদুকরি কলমে। স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের সাহিত্য রুচি, চিন্তা ও ভাবনার জগতের বন্ধন মুক্তি ঘটেছিল তারই হাতে। অনেক দিন পর বাংলাদেশ শনাক্ত করতে পেরেছিল যে, প্রকৃত অর্থে এদেশের সাহিত্য কেমন হতে হবে; কেমন হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: সাহিত্যের অমর প্রতিভা
সাহিত্যের একদম নতুন ও অগ্রসর ঘরানার জন্মদাতা তিনি। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একটি সার্বভৌম যুগ; একটি উন্মুক্ত কাল তিনি রচনা করে দিয়েছেন আমাদের জন্য; বাংলাদেশের জন্য; আন্তর্জাতিক বাঙালির জন্য।
ব্যক্তি-মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যু যদি মূল্যায়নের জন্যে একটি বিরতি হয়, তাহলে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে হুমায়ূন বীক্ষণ। শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেম ও ভালোবাসার নৈবেদ্যের পুষ্পাঞ্জলি, অশ্রুবিন্দু ও মানবিক আবেগ ছিন্ন করে তিনি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার তুল্যমূল্যে প্রতিস্থাপিত হবেন; তিনি সগৌরবে ঠাঁই করে নেবেন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-নান্দনিকতার ইতিহাসের হিমালয়-শীর্ষে। যুক্তি ও বিশ্লেষণের কষ্টি পাথরে ঠাঁই করে নেবেন।
তার জাগতিক মৃত্যুর পর একটি হুমায়ূন যুগের অবসানে আমাদের সামনে সূচিত করেছে আরেকটি নবতর হুমায়ূন যুগ। যেখানে কাল-কালান্তরে, যুগ-যুগান্তরে, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে তিনি ক্রমে ক্রমে অপরিহার্য হয়ে উঠবেন আমাদের মননে, পঠনে, পাঠনে, চিন্তনে ও বিশ্বাসে।
হুমায়ূন আহমেদের জৈবিক মৃত্যু হয়েছে বটে। কিন্তু দূরদেশ থেকে যে হুমায়ূন মায়ের কোলে, মাটির গভীরে, পাঠকের হৃদয়ে ফিরে আসছেন; আসছেন সুদূর আমেরিকা থেকে; তার মৃত্যু নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতি যতদিন পৃথিবী নামের এই ঠিকানায় বেঁচে থাকবে; ঠিক ততদিনই জীবন্ত থাকবেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
মৃতদেহ-ভরা কফিন-ঘরের জীবন সত্তার হুমায়ূন-বরণের অপেক্ষায় ছিল সারা বাংলাদেশ। লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ হয়েছিল হুমায়ূনময়; নায়কের বীরোচিত প্রত্যাবর্তনের শিহরণে উদ্বেলিত।
পরের কিস্তি: পুষ্প ও অশ্রুসিক্ত বিদায় অভিষেক
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি, লেখক ও অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
এমএ/