ছুটি:
আমার একটু ছুটি দরকার। সম্ভবত এক বছর কিংবা তারও কিছুটা বেশি সময়।
চাকরি:
রিজাইন লেটারটা লেখাই আছে।
প্রতিদিনের মতন আজও ভাবছি ছেড়ে দেবো চাকরিটা। হয় না। সাহসে কুলায় না। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের সাহস কম হয়।
মাস শেষে নিশ্চিত আসবে এটা জেনে অল্প কয়টা টাকার ফাঁদে আটকে পড়ে থাকে তারা। আমারও একই অবস্থা। ছুটতে পারছি না। একা হতে পারছি না। একা হওয়ার জন্য যখনই আকুলি করে মন তখনই দুখী মায়ের মুখ সামনে চলে আসে। মনে পড়ে ক্লান্ত বাবার কথা। অযথা স্বপ্ন দেখা বোকা প্রেমিকার ভালোবাসায় থমকে যেতে হয়। বাধা পড়ে গেছি। আছি।
আমি তো একটা ঘর চেয়েছিলাম। কোনো একটা চুপচাপ, সহজেই ঠাঁই পাওয়া যায় এমন একটি নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো ছোট্ট কাঠের বাড়ি। বাড়ির চারপাশ ঘিরে গাছের দেয়াল। পাতার ফাঁক গলে সাত সকালে তেরছাভাবে আসা রোদ। বাড়ি সামনে বুনো ঘাস, নীলচে ফুল। একটা পোষা ফিঙে পাখি। এইতো। সকালে উঠে এক কাপ রং চা। চিনি ছাড়া। গাঢ় লিকার। সাথে মিষ্টি হাওয়া বিস্কুট। সকালের নাস্তা।
খুব বেশি খিদে পেলে দু’টো চাল বসানো উনুনে। পাতিলেই সেদ্ধ হওয়ার জন্য দিয়ে দেওয়া আলু। একটু কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, তেল দিয়ে সেদ্ধ আলু চটকে ভর্তা বানানো আর সাথে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত ব্যস!
এরপর ছিপ নিয়ে বসে যাওয়া নদীর পাড়ে। সারাদিনে দু-একটা মাছ। টাকি হলেই চলবে। ঝোল ঝোল করে আলু, পেপে বা লাউয়ের সাথে রান্না। তারপর কাজ নেই। সারাদিন বই পড়বো। দুপুরের খাবারই রাতে বাসি হলে গরম করে খাওয়া হবে। খাওয়ার জন্য এতো কষ্ট করা যাবে না।
বই পড়া হবে। রোমাঞ্চকর সব বই। গোয়েন্দা বই থেকে কাঠখোট্টা প্রবন্ধের বই কিছুই বাদ যাবে না। মাঝে মাঝে একটা দু’টো অযথা কবিতা লেখার চেষ্টা। বেলের শরবত, ডাবের পানিতে নেশা গাড় হবে। ঘরের জানালা দিয়ে একটানা তাকিয়ে থাকবো অন্ধকারের শূন্যতায়। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকবে। জোনাক পোকা আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে নষ্টামি করবে। কোনো কোনো দিন মাথায় পাগলামি উঠলে নিজের একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে নেমে পড়বো নদীতে। মধ্যিখানের গাঙে পৌঁছে নৌকা শুনবে স্রোতের কথা। তারপর ঘুম। শান্তির ঘুম।
কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বড় হওয়ার ইচ্ছে নেই। তাড়া নেই। পিছুটান নেই। নিজের জীবন। নিজের জন্যই যাপন করা।
এইতো এমনই। খুব বেশি কিছু নয়। নদীর পাশে বাস করে নিজেই একদিন নদী হতে চাওয়া।
পারি না। যেমন তেমনই টেনে নেই জীবন। রিজাইন লেটারটা পড়ে থাকে ড্রাফট বক্সে। পাগলামি দেখে হাসে কলিগ অপু ভাই। বলে, ‘খোঁজ নিয়ে দেখো আমাদের সবারই ড্রাফট বক্সে একটা করে রিজাইন লেটার আছে। আছে হাবিজাবি ইচ্ছা-অনিচ্ছা। সেসব কখনও সত্যি হয় না। অতোটা সাহস করে ওঠার যোগ্যতা আমাদের নেই। মানুষ একা হতে পারে না। একা হওয়া সহজ নয়’। কথাগুলো সত্যি। তবুও মানতে ইচ্ছে করে না।
অন্য দশটা দিনের মতন অফিস শেষ হওয়ার আগে, নিচে নেমে বাসে ওঠার আগে অপু ভাইকে বলি নিজের অক্ষমতার কথা। ইচ্ছের কথা। বলি, নদী হতে চাই। কথা শুনে সে হাসে। বলে, নদী চিনলে না। নদী তো সব সহ্য করে। কচুরিপানার যন্ত্রণা, মাছের ওলটপালট, নৌকার মোচড়, চরের লুটপাট সব নীরবে সয়। অভিযোগ নেই। ক্লান্ত হয় না। নদী সে তো ভালো নেই। সে যে মানুষই। নিজের জীবন যাপন করা হয় না কখনও। করে যায় অন্যের জন্য।
আমি হতাশ হই। নদীর জন্য মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয় নিজের জন্য, মানুষের জন্য। অতঃপর অফিস শেষে বাড়ির পথ ধরি। অপু ভাইয়ের সাথে। প্রতিবেশীও তিনি। আমার চড়–ই পাখির মতন মনমরা মুখ দেখে বলে, ‘ক্লান্ত জানি কিন্তু পালানো যায় না যে। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ অপেক্ষা করে আছে। তাদের রেখে পালানোটা অপরাধ’।
শুনি। কিছু বলি না। মেইলটা ড্রাফট বক্সে থাকুক। কিছু কিছু কথা কোনোদিন বলা হয় না। করা যায় না কিছু কিছু কাজ কোনোদিনই।
তবুও নিজের জন্য অপরাধ করতে ইচ্ছে করে। অপরাধী হতে ইচ্ছে করে।
নিস্পাপ শিশু তো হতে চাইনি। একটু আধটু পাপ না করলে সে জীবন তো জীবনই না।
এরপর রাত হয়। সবার অগোচরে এতোকিছুর পরেও আজ সদর দরজা খুলি। যেতে হবে। ঘুম ঘুম প্রিয় মানুষ। আমার ইচ্ছেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে কিন্তু ‘ছি। ছি। ছি...’। শুনতে পাই। কে বলে? মা? বাবা? প্রেমিকা? অফিস? সমাজ?
না। আর পারি না। এসব শুনে যেতে। যাওয়া যায়?
তবে আমি আর জীবনে বিশ্বাস করি না। কিংবা এটা জীবনই নয়। এর নাম অন্য কিছু। ফাঁদ কি?
** যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
** যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
** আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
** টান । আকাশ মামুন
**এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৭
এসএনএস