কাঠবিড়ালি হতো যদি সে! তাহলেও উঠে যেতে পারত গাছের ওই মগডালে। পারলে আর শুনতে হতো না ভাইদের ওই কটাক্ষÑ কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও? তারপর ওরা ওদের উচ্ছিষ্ট পেয়ারা একটা একটা করে ছুড়ে দিত বাড়ির উঠানে।
একটা মাত্র ঘর। এতো ছোট সেই ঘরে কোনোমতে দুটি বিছানা পাতা দুই চৌকিতে। এক চৌকিতে ঘুমায় বাবা-মা। অন্যটায় দুইভাই। সে ঘুমায় পাশের আর এক ছোট ঘরে দাদির বিছানায়। কিন্তু এখন এই সময় সে দাদির বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। দাদি নামাজ পড়ে। ভাইদের কোনোমতে বোঝানো যায় না। ওরা প্রশ্ন করে- কেন সে দাদির সঙ্গে ঘুমাবে না? ওরা দাদির সঙ্গে ঘুমাবে না, ওদের এক কথা, সাফ কথা। মেয়েটি বসে বসে কাঁদে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদে! এ কী অপমান! একটা ঘর, এ দুনিয়ায় কি তার একটা ঘর হবে না; যেখানে সে তার লজ্জা লুকাতে পারবে? মাও গালি দেয়! বলে, কাঁদিস কেন; কেঁদে কী হবে- ওদের আমি বুঝিয়ে পাঠাবো। মা তারপর ভাইদের বোঝায়- সাতদিন ওরা যেনো দাদির বিছানায় ঘুমায়; বোনের অসুখ! ভাইদেরই-বা কতো বয়স তারওপর ওরা ওদের নিজের চোখে দেখতে পায় নাÑ তাই আবার প্রশ্ন করে- কোথায় বোনের ওসুখ; কী অসুখ?
মেয়েটি সেই পেয়ারা গাছের কাছে এসে দাঁড়ায়। যেনো সরসর করে বৃষ্টির পানি সরতে থাকে উঠোন গড়িয়ে। মনে পড়েÑ সেইসব দিনরাত্রি। পেয়ারা গাছের বাকল এতো পুরু আর শক্তÑ ওগুলো একটু খুঁটে সরালে দেখা যায় ভেতরে পিঁপড়ের বাসা, পিঁপড়ের ঘর। মেয়েটি সেদিনের মতো আজও ভাবেÑ পিঁপড়েদেরও নিজের ঘর আছে শুধু আমার ঘর নেই কোনো, সেদিনও ছিলো না আজও নেই! ভেতর থেকে আবার ওই বাক্য ভেসে এলোÑ এলি, এলি? মেয়েটি এবারও উত্তর করল না। শুধু ওর হাতে ধরা প্রাণীদের ধরে রাখা যায় না! তারা ছুট লাগাতে চায়। তিড়িংবিড়িং লাফায়। বলে, মা ছাড়ো নানা ডাকে। মেয়েটি এবার ওদের হাত ছেড়ে দেয়। দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় ওরা। সেই ঘর; একটা খাট আর একটা চৌকির ঘর! মেয়েটি তবু নড়ে না। কালো কালো স্মৃতির পিঁপড়ে ওর চোখ দুটো কামড়ে কামড়ে খায়! কোন ভুত চেপেছিল ঘাড়ে? কে বলেছিল তাকে, মুক্তি দিতে, মুক্তি নিতে? “আর জায়গা হচ্ছে না- এবার তাহলে কী করা? কোনোমতে একটা বর জুটিয়ে ফেল তারপর বরের ঘরে উঠে যাওÑ বরের ঘরই-তো মেয়েদের আসল ঘর, না? এরপর ফাঁকা জায়গায় ওরা একটু দম নিক। একটু নড়েচড়ে ঘুমাক!” ওদের ঘর ফাঁকা ক’রে বরের ঘরকে নিজের ঘর ভেবে চলে গেলো সে! তারপর কী হলো? কী মনে হলো তার? বরের ঘর নিজের ঘর হলো? হয়েছিল কি কোনোদিনও কারও? এখন বাড়তি দুটি প্রাণী নিয়ে মুখ গুঁজবে কোথায় তুমি মেয়ে? উত্তর দাও না কেনÑ বলো, “হ্যাঁ এলাম, এলাম বাবা, তোমাদের ঘর ফাঁকা ক’রে দিয়ে গিয়েছিলাম, কী নিশ্চিত মুক্তি ভেবে চ’লে গিয়েছিলাম কিন্তু মুক্তি কই, মুক্তি-তো মিলল না! এখন কোথায় ঘুমাব বাবা, আমার যে ঘর নেই, এই এতো বড় দুনিয়ায় আমার কোনো ঘর নেই”!
এবার ভেতর থেকে ভেসে এলো, কী করিস বাইরে দাঁড়িয়ে, ভেতরে আয়। মেয়েটির চোখ চিকচিক করে! বাবার অসুখ। কয়েকদিন আগেই শুনেছিল সে কথা। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকল সে। ওই দুই প্রাণী তাদের নানার মাথার কাছে বসে গেছে। কেউ হয়তো বাবাকে দেখতে এসে আঙুর দিয়ে গেছে এক ঠোঙা। ওরা তাতে এরই মধ্যে ভাগ বসিয়েছে। মেয়েটি তেড়ে এলোÑ নানার অসুখ, নানা খাবে, রেখে দাও। হাত থেকে ঠোঙাটা কেড়ে নিলো। বাচ্চা দুটি হাউকাউ করে উঠল। ওদের নানা বলল, থাক, ওরকম করিস না, খাক না। মেয়েটি এবার ওর বাবার কাছে গিয়ে বসল। মাথার ওপর মশারি ঝুলছিল। কোনোমতে সেটা গুটিয়ে রাখা হয়েছে! সারাদিন ওভাবেই ঝোলে খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে। রাতে টেনে বিছানার দুই পাশে গুঁজে দেওয়া হয়। সকাল হ’লে আবার চারকোণা স্ট্যান্ডে ঝোলা মশারির ছড়ান পেটের উপর তুলে দেওয়া হয়! মাথার খুব কাছে ঝুলছিল সেটা। টেনেটুনে মাথা থেকে কিছুদূর সরিয়ে রাখল মেয়েটি। বাবার মুখে কেমন কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে। মেয়েটি অনেকদিন বাদে বাবাকে ভালো ক’রে দেখল। কেমন ভেঙেচুরে যাওয়া মুখ! কী বোকা সে! বাবাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল! ঝুঁকে বাবার বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদল। ওই দুই প্রাণী তা দেখে বলল, কেন কাঁদছ মা, তুমি কেন কাঁদছ মা, মা তুমি কাঁদবে না! মেয়েটি এবার হাসলÑ এক টুকরো অশ্রুহাসি! বাবাও এবার সান্ত¦নার হাসি হেসে বলল, বলেছিলাম মা- দেখ, ভেবে সিদ্ধান্ত নাও, অতো তাড়াহুড়ো ক’রে বিয়ে করতে তোমাকে কতো নিষেধ করেছিলাম! মেয়েটি কোনো উত্তর করল না। অস্ফুট এক বাক্য বয়ে গেলো ওই ছোট্ট ঘরের বাতাসেÑ মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম বাবা তোমাদের!
২.
মা ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরল। হোমিওপ্যাথি অষুধ এনেছে। সেই সাদা সাদা কতক বড়ি। মেয়েটি ছোট থাকতে বাবার সঙ্গে হোমিও ডাক্তারের ঘরে গিয়ে শখ ক’রে সেই সাদা বড়ি ডাক্তার কাকুর কাছে চেয়ে নিয়ে খেত। ডাক্তারটা ছিলো বাবার চেয়ে বয়সে কিছু বড়। ভুড়ভুড় ক’রে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ত। সারা ঘর সিগারেটের গন্ধে ভরে থাকত এমন কী তিনি যে শিশিতে অষুধ দিতেন সেটাও সিগারেটের গন্ধে মেখে যেত!
মাকে মেয়েটি ধমকালÑ ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে পারলে না, এইসব ওষুধে আজো ভরসা করো? মা থতথত হয়ে উত্তর দিতে যাচ্ছিল; বাবা বলল, “তোর মাকে বকিস না, ভরসা তোর বাবার। আর কী এমন হয়েছে আমার এই ওষুধেই ছাড়বে”। ভেতরটা হু হু করল। চুপ চুপ করে কাঁদল মেয়েটি। হাতের ছোট ব্যাগটা না খুলেই দেখলÑ ওখানে এমন টাকা নেই যা দিয়ে বাবাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে! অনেকদিনের জমানো টাকা কিছু নিয়ে সে পথে বের হয়েছিল। পথে ট্রেনের টিকিট, স্টেশন থেকে এ বাড়ির পথটুকুর জন্য রিক্সাভাড়া, ওই দুই প্রাণীর চকলেট-চিপসে এর অর্ধেক বেশি গেছে।
বাবা বলল, উঠে যাব দেখ, এই কালকেই উঠে যাব। তুই এসেছিস, আমার দুই সঙ্গী এসেছে- তোদের জন্যই আবার উঠে যাব, মরব না। মা দূরে দাঁড়িয়ে বাবার মুখে মরার কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
প্রায় সারারাত জেগে ওই দুই প্রাণী এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ছোটাছুটি করল। বাড়িঘর আগের মতোই আছে; কিছুই বদলায়নি। মেয়েটি কী মুক্তি দিতে চেয়েছিল তার বাবাকে সেই জানে! আজ তবে কেন ফিরে এলো- মুক্তি ছিনিয়ে নিতে? ঘরের সংখ্যা বাড়েনি। শুধু মরে গেছে মেয়েটির দাদি। ভাইরা এখন দাদির ঘরে থাকে। দুই ঘরের মাঝে একটা টিনের পার্টিশন। এর মাঝেই একটা ছোট দরজা দুই ঘরে যাওয়া-আসা করার। প্রাণী দুটি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যায় আর বলে, মা আমরা কোন ঘরে ঘুমাব? বাবা-মায়ের ঘরের মেঝেতে ওদের জন্য বিছানা করা হলো। এক প্রাণী কিছুতেই নিচে ঘুমাবে না। মেয়েটি মুখে ফেনা তুলে প্রাণীটাকে নানা কিছু বলে, চিৎকার-চেঁচামেচি ক’রে কেঁদে-কেটে মাঝরাত অস্থির ক’রে তুলল। বাচ্চাটা ভয়ে কাঁদছিল। অসুস্থ নানা ডাকলÑ আসো নানা তুমি আমাদের সঙ্গে ঘুমাও। মেয়েটি ধমকালো- চুপ করো বাবা, সবকটা বেয়াদব, যখন যা বলবে মেনে নিলে আরও মাথায় চড়বে। মা তবু নেমে এসে মেয়েকে বকে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে উপরে গেলো। তারপর ওকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলল, তোমার বড়মামার বিয়ে; এই কয়দিন পরেই আমরা একটা ঘর বানাব। বাচ্চাটা বলল, আমার জন্য একটা বানাব। নানি সান্ত¦না দিলো- আচ্ছা বানাব। বাচ্চাটা আবার বলল, তাহলে সবার জন্য একটা ক’রে ঘর বানাব আমরা। নানা বাচ্চাটার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ঠিক আছে সবার জন্য একটা ক’রে ঘর বানাব আমরা। বাচ্চাটা এবার প্রশ্ন করে, কী দিয়ে ঘর বানাব নানু, মাটি দিয়ে? ওর নানু বুঝি কাঁদতে কাঁদতে হাসে, হ্যাঁ সোনা, মাটি দিয়েই-তো সবাই ঘর বানায়!
৩.বাচ্চা দু’টো মেঝের বিছানাতে কখনও ঘুমা নি। ওরা যে খুব বড় দালান বাড়ির বাসিন্দা তাও না। তবে ওরা নানাদের থেকে বড়লোক! ওদের ঘরগুলো বড় বড়। প্রত্যেকের জন্য আলাদা। দুই বাচ্চা দুই খাটে ঘুমায়। দু’জনের জন্য উঁচু বালিশ, কোলবালিশ সেই খাটের বিছানায় সুন্দর ক’রে তাদের মা গুছিয়ে রাখে। তাদের পরিবারে আর এক সদস্য আছে। ওদের দাদি। সেই দাদিরও আলাদা ঘর আছে। দাদি হাঁটতে পারে না। পায়ে কোনো অসুখ তার সবটুকু বাচ্চারা জানে না। সেই দাদি পাশের ঘরে শুয়ে, কখনও মেঝেতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বারান্দায় বেরিয়ে তাদের মাকে গালি দেয়! কেন গালি দেয় বাচ্চারা জানে না। একটা গালি তারা প্রায় শোনে, “ফকিন্নির বেটি; বাপের বাড়ি থেকে খালি হাতে আসিছে, এখন আবার আমার সংসার দখল নিছে”। এরপর দাদি চেচিয়ে বাবাকে ডাকে। বাবা কাছে-পিঠে না থাকলে বলে, “স্ত্রৈণ হইছ তুমি? হওয়াচ্ছি দাঁড়াও, ওই হারামজাদির আঁচলের তলে থাকার সাধ মিটাচ্ছি”! বাচ্চারা প্রায় শোনে এইসব। ওরা ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকায় একে-অন্যের মুখে! মা কোনো কোনোদিন চুলায় লাকড়ি-খড়ি ঠেলতে ঠেলতে বলে, “আমি কি ভাইসা আসছি? উইড়া আসছি? জোর ক’রে ঢুকছি এই সংসারে? তখন হুঁশ আছিল না? ছেলেরে কোলের মধ্যে বাইন্ধা রাখতেন”। দাদি তখন বলে, “তুইতো শাকচুন্নি, পেতনি- কী রূপ দেখালু আমার ব্যাটাক রূপের নাই এক ছটাক”! কোনো খাবার দিলেই দাদি প্লেটসহ ছুড়ে দিত! বলত- কিছু হয়নি! আজ লবণ বেশি তো কাল লবণ কম, আজ ঝাল হ’লো তো কাল ঝাল হয়নি! দাদি কেন খেলো না- এই নিয়ে বাবা-মায়ের রোজকার ঝগড়া। আর দাদির অভিযোগ- ‘সে তো চায় আমি না খায়ে মরি। মরলে তো সুবিধা মা-ভাইদের নিয়ে চেটেপুটে খেতে পারে তখন’। বাবা মাঝে মাঝে উত্তর করে- খাওয়াব, খাওয়ানোর ব্যবস্থাই করব! মা আর কখনও কাঁদত না। শুধু যখন বাপ-মা-ভাই নিয়ে খাওয়ানোর কথা উঠত, মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদত! বাচ্চারা নিজেরা নিজেদের বলত, মা কাঁদছে কেন? ‘কারণ মায়ের অপমান হয়েছে’! একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করত, আচ্ছা নানারা কি খেতে পায় না? একজন আরেকজনকে উত্তর দিত, আমরা বড় হয়ে নানা বাড়ি যাইনি।
ছোট হ’লেও বাচ্চারা খুব বুদ্ধিমান। পরদিন সকালে সরাসরি প্রশ্ন করে না। শুধু, ওদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিল আছে এখানে নেই, মেঝেতে বসে; সকালের নাশতার দিকে চেয়ে দেখে ডিম, রুটি, আলুভাজি, কলা- ওদের জন্য গরম দুধ দেওয়া হয়েছে! একজন আরেকজনকে ফিসফিস ক’রে বলে, নানারা তো না খেয়ে থাকে না! কিন্তু তবু নানাদের দুটির বাইরে আর একটা বাড়তি ঘর নেই! ডাইনিং ঘর নেই। কোথাও সোফা নেই। টিভিও নেই! একটা কলপাড় তার সাথে লাগানো বাথরুম। ছোট্ট উঠান। তারওপর দাঁড়ানো মস্ত পেয়ারা গাছ। ছোট্ট একটু বারান্দা আছে। সেই বারান্দার টানা তিন ধাপ সিঁড়ি। বাচ্চারা দেখেছে এর বাইরে আর কিছু নেই!
এরপর কেমন জড়তা জড়িয়ে যাচ্ছিল এই বাড়ির মানুষগুলোর শরীরে! একধাপ দিলে তিনধাপের কষ্ট হচ্ছিল! শ্বাস পড়ছিল না বাড়িটার। বাইরের কারা কারা যেনো বলল, ‘ওই দুই ঘরে কেমন ক’রে থাকবে অতোগুলো মানুষ’! কে যেনো বলল, ‘বড়লোক হওয়ার সাধ হয়েছিল না? বড় ঘরে বিয়া বসল’!
কতোজনে কতো কথা বলল! একটা পর্যায়ে গিয়ে এই বাড়ির লোকগুলো সেইসব কথাতে কান দিত না। ওরা না দেওয়া শিখে নিয়েছিল। শুধু বাবা সুস্থ হয়ে ছোট্ট প্রাণী দুটির সাথে হই-হুল্লোড় ক’রে বাড়ি মাথায় তোলার পর হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে গেলো। মেয়েটি বাবাকে বলেছিল, বাবা তোমাদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম! কেমন শেলের মতো বিঁধেছিল বাবার বুকের ভেতর কথাটা! বুকের মধ্যে ওই একটা দুঃখই তখন বাবার ‘আমি আমার মেয়েকে একটা ঘর দিতে পারিনি। তার জন্য আমাকে মুক্তি দিয়েছিল’! বাবার অসুখ বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে তার কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেলো। টাকার জোগাড় না হওয়ায় ঘর তুলতে না পারার জন্য বড় ভাইয়ের বিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিছু ইট-বালু কেনা হয়েছিল। সেগুলো দীর্ঘদিন ঘরের কাছে রাস্তার ওপর পড়ে থাকল। পাড়ার ছোট ছোট দুষ্টু ছেলেরা সেই বালু অনেকটাই পায়ে পায়ে ছড়িয়ে দিল রাস্তায়। একটা বাচ্চা একদিন ওই বালুর ওপরই ঘরের মতো কিছু বানাল! তারা সেগুলোতে খুব একটা মনোযোগ দিলো না। বাবাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিল সবাই মিলে। কারণ, এই বৃক্ষটা আরও কিছুদিন টিকে গেলেই ওরা টিকে যাবে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খুব হইচই হলো এই বাড়িতে। বাচ্চা দুটি নিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিলো মেয়েটি। খুব গরম ব’লে মশারি লাগায়নি। সকালে উঠে দেখে একটা বাচ্চার পায়ে পোকা জাতীয় কিছু কামড়েছে, দরদর করে রক্ত ঝরছে। সবাই ছোটাছুটি করল। অনেকটা সুস্থ বাবা সেদিন দুই হাত দুইপাশে ছড়িয়ে দম ধ’রে বিছানায় বসেছিল। বাবার চোখ দুটো হঠাৎ করমচার মতো লাল হয়ে গেল! মেয়েটি দেখল। হয়তো বাবার শরীরটা আবার হঠাৎ খারাপ লাগছে। মেয়েটি হাতের কাছে থাকা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বাবা দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে পা দুটি মেঝেতে ঝুলিয়ে মৃদু মৃদু দুলছিল। মেয়েটির মনে হলো শরীর কাঁপছে বাবার। কিন্তু নাহ্ বাবা যেনো মৃদু মৃদু হাসছিল! ঘরের এমন অবস্থায় বাবা কেন হাসছে মেয়েটি বুঝল না। বাবা গ্লাসটি নিলো। তারপর একটা মৃদু রহস্যের হাসি হাসতে হাসতে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমিও আমার মতো অযোগ্য’! মেয়েটি এর অর্থ কিছু বুঝল না। কিন্তু এরপর সবাই কেমন বিমূঢ় হয়ে দেখল বাবা পানির গ্লাসটা মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে মেয়েটির গালে প্রচণ্ড শক্তিতে একটা চড় মেরে বললেন, ‘অনেকদিন থেকে দেখছি বাচ্চাদের প্রতি তোমার কোনো খেয়াল নেই! আশ্চর্য! সবসময় নিজের খেয়াল নিয়ে থাক’! পোকা কাটা জায়গাটা ততোক্ষণে যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হয়ে গেছে। বাবা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে মরচে ধরা দরজাটায় শব্দ করে বাইরে গেলো। বাচ্চাটার মুখ ভয়ে মাখা। সে বিহ্বল ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকাল যেতে যেতে!
৪. বাচ্চাটাকে এনে বিছানায় শোয়াতে গেলে সে ঘাড় বাঁকা ক’রে উঠে যেতে চাইল। নানা বলল, ‘শোও শোও, তুমি শোও; এই বিছানায় শোও; এ ঘর তোমার’! বাচ্চাটা শোবে না; তখন তার ঘুমের সময় না। নানা জোর ক’রে এক হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে চেপে ধ’রে আরেক হাতে মশারি নামাল। ওকে ধ’রে রেখেই মশারি গুঁজে দিতে চাইল। বাচ্চাটা চেঁচাল। মেয়েটি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মা তার দিকে তাকাচ্ছে, মেয়েটি মায়ের দিকে। ঘরের শেলফে মেয়েটির শরীর ঠোকর খেল। অস্ফুট হয়ে উচ্চারিত হ’লো কথা, বাবা ওর এখনও ঘুমের সময় হয়নি। বাচ্চাটা প্রায় কাঁদো কাঁদো। বাবা বলল, ‘ও এখন থেকে এ ঘরে ঘুমাবে বুঝলে’! মেয়েটি বলল, ‘ও তো এ ঘরেই ঘুমায় বাবা’! হু ঘুমায়- বাবা বলল, ‘এই বিছানাতে ঘুমাবে, আমি ঘুমাব মেঝেতে’। বাবা এরপর জোরে হেসে উঠল, যেনো নিজেকেই তাচ্ছিল্যভরে বলছে, ‘কেমন অধম দেখ আমি, নিজের মেয়েকে একটা ঘর দিতে পারিনি, আজ মেয়ের সন্তানকেও— আমার-তো মরে যাওয়া উচিত!
মেয়েটির মা ধমকে উঠল কী কথা যে শুরু করলে! তিনি বাচ্চাটাকে মশারির ভেতর থেকে বের ক’রে আনলেন। বাচ্চাটা কু কু ক’রে কাঁদছিল। বাবা ভেতরটা মুচড়ে তোলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ইচ্ছা মৃত্যু হোক আমার, বুঝলে মা! মেয়েটি কাঁদতে গিয়েও গিলে ফেলল। ওদিন অমাবস্যা। পাশের বাড়ি থেকে বাজি-পটকা পোড়ানোর শব্দ আসছে। ছোট থাকতে মেয়েটিও পাশের বাড়িতে গিয়ে ফুলঝুরিতে (এক জাতীয় পটকা) আগুন দিত, চতুর্দিকে ছড়িয়ে যেত আগুনের ফুলকি। সে আগুনে ফুটে উঠত মেয়েটির নিষ্পাপ সরল মুখ! শুধু রাত হ’লে দাদি ওকে পাশের বাড়িতে যেতে দিত না। ওরা মাঝে মাঝে পাঠা বলি দিত। ওই বাড়ির এক কাকুর নাকি মাথা খারাপ। ! কালী পূজোয় তার সুস্থতার জন্য পাঠা বলি দেওয়া হত! ওরা সবাই হই হই ক’রে ভূত পুড়াত, ভূত পুড়ানোর উৎসবে অবশ্য মেয়েটির ভাইরাই বেশি উপস্থিত থাকত, মেয়েটিকে ওরা নিতে চাইত না সঙ্গে। কালী পূজো মেয়েটির স্মৃতিতে রয়ে গেছে আঁধার কালো রং হয়ে, এক অসুস্থ কাকার জন্য পাঠা বলি আর সে তীব্র অন্ধকার দূর করতে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বালানো! অতো অতো অন্ধকারে ওই ছোট ছোট প্রদীপগুলো সলতে সমেত সারা বাড়িতে মৃদু মৃদু জ্বলত, মেয়েটির মনে আছে। আজ কালী পূজোর দিন। ওর ইচ্ছে হলো, সারা বাড়িতে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বালাতে। ওর কাছে সবকিছু কেমন অন্ধকার অন্ধকার ঠেকছিল। বাবা কেন এমন করল! মনে হলো, বাবার মাথাতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে!
রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। মা ঘরে টুক টুক ক’রে বাসন-কোসন গোছাচ্ছে। বাবা নাছোড়বান্দা ওই দুই প্রাণীকে খাটের বিছানায় পাশে নিয়ে শুয়েছে। দু’জন বাবার দু’পাশে। মেয়েটি বারান্দার সেই সিঁড়ির ধাপে এসে বসল। আজও সে কাঁদছে- আজও তার চোখজুড়ে অশ্রু! তাই-তো কেমন মুক্তি দিলো সে সবাইকে! রাতের বাতাসে কোনো জংলী ফুলের গন্ধ ভাসছে। কুটকুটে অন্ধকার আকাশে কোনা তারা নেই। ওদের বাজি পোড়ান শেষ হয়েছে, ওদের বাড়িতে এখন যেসব ছোট ছোট বাচ্চা ওরা কেউ ভূত পোড়ায় না- আগের মানুষগুলো পুরনো হয়ে গেছে, মাথা খারাপ কাকা মরে গেছে অনেকদিন। মেয়েটি পা এক সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আরেক সিঁড়িতে রাখল। ভেতরে মায়ের সব গোছানো শেষ হ’লে মেঝেতে বিছানা করলেন। ঘরে মৃদু ডিম লাইট জ্বলছে, তিনটা মানুষ ঘুমাচ্ছে মশারির ভেতর, ওদের মুখে লাইটের লাল আলো। মা মেয়েটিকে ডাকল। মেয়েটি ঘরে এসে জানালার কাছে রাখা চেয়ারে বসল। বিছানা পাতা শেষ হ’লে মা তার তেলের শিশি নিলো। মেয়েটি চাইল মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিতে। মা বলল, তুই ঘুমা। মেয়েটি শুলো না চেয়ারে বসেই মায়ের গন্ধ তেল চুলে বিলি কেটে দেওয়া দেখল; এই সমস্ত গন্ধ, আলো, মায়া, কান্না মেয়েটিকে ভরে তুলছিল বেদনার একশেষ! মেয়েটি যেনো অনেক ব্যথার বোঝা শরীররটা আস্তে ক’রে চেয়ার থেকে নামিয়ে ছেঁচড়ে মেঝের বিছানায় নামাল। মা কোনোমতে গিয়ে ওই তিন প্রাণীর পাশে জায়গা ক’রে শুয়ে পড়ল। মেয়েটি আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল। একটা কাজ খুঁজতে হবে, সকালে বের হবে ঠিক করল।
রাতের শেষে বৃষ্টি নামল। আকাশে তারা ছিলো না, কোনো মেঘও ছিলো না। হঠাৎ বৃষ্টিতে মেঝের ঠাণ্ডা মেয়েটির শরীরে ঢুকে যাচ্ছিল। মেয়েটি ঘুমের মধ্যেই ভাবল কোনো পোকা না ঘরে ঢুকে পড়ে। মেয়েটি বিছানার মশারি অনর্থক একবার টানল!
সকাল। ভেজা। একদম সবুজ সবুজ গন্ধ, কান্না কান্না গন্ধ চারপাশে। ওদের ঘরের শেষ মাথায় দেয়ালের ওপাশে একটা ফাঁকা জায়গা জঙ্গলে ভরা। দেয়ালটা সবুজ শেওলা ধরা, এখানেই একটা ঘর তোলার কথা ছিলো ওদের; মেয়েটির ভাইয়ের বিয়ের আগে। দেয়াল বেয়ে অসংখ্য পা ঠেলে ঠেলে একটা কেল্লা পোকা নামছিল। পোকাদের পৃথিবীতেও সকাল হয়েছে। মা দেখেছে আগে। একটা ঠাণ্ডা, শান্ত, ভেজা মানুষ চোখ মুদে দেয়ালে পিঠ দিয়ে সামনে দুইপা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। পাশে ফণিমনসার গাছ দুলছিল। গর্তে জমেছে বৃষ্টির পানি, ছোট ছোট ব্যাঙ সেখানে লাফাচ্ছে। কচু গাছের পাতায় জমা বিন্দু বিন্দু পানি টলমল করছে। সবুজ আর কাদা-মাটির গন্ধে নাক ভরে আসছিল।
মেয়েটি দূরে দাঁড়িয়ে দেখল ওর চিরতরে ঘুমিয়ে যাওয়া বাবাকে! রাতে শরীরে যখন ঠাণ্ডা ঢুকছিল, একবার হঠাৎ ঘুম চোখেই মনে হয়েছিল কেউ দরজা খুলল, বাইরে গেলো, একবার তার বিছানার মশারি টান খেল!
মনে হলো সামনে পা ছড়িয়ে চোখ বুজে থাকা বাবা বলছে, ‘এইখানে একটা ঘর তুলব; বুঝলে মা, তোমাদের ওই ঘরটা দিয়ে দিলাম’!
একে কি বলে ইচ্ছামৃত্যু? মেয়েটি সবুজ গন্ধ নাকে ভরে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কী বলে?
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৭
এসএনএস
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে