-তোমার ভাইকে বলে দিলে...?
-সে আমার জানের দোস্ত, জান যাবে তবু মুখ থেকে এক অক্ষর কথাও বেরোবে না।
-তাহলে আমি...?
-তুমি তো জানের জান।
মনছুরার ঠোঁটে মুচকি হাসির মৃদু ছলাৎ চোখে ঝিলিক মেরে উঠে। আজ তাকে অদেখা জান্নাতের হুরের মতো লাগছে। আজ মনছুরার বহুদিনের মনের আশা পূরণ হতে যাচ্ছে, ক্যাচ ক্যাচ করে কয়েকটা ফটো তুলবে শাহজানকে জড়িয়ে। ঠিক ছায়াছবিতে রোজিনা যেমন নায়ক রুবেলকে জড়িয়ে ফটো তোলে। নায়ক রুবেলের হুলুস্থূল মারপিট অথচ চুমু দেওয়ার সময় কী যে লাজুক! ওহ্, মনছুরার তর আর সয় না, বিছানায় বালিশের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, খামচিয়ে দেয়। বুকের লম্বা কেশগুলো দেখলে তো ওগুলো ধরে ধরে কাছে টানতে ইচ্ছে করে মনছুরার। রোজিনার বাম গালে কালো তিল আর রুবেলের বাঁ চোখের টিপ্পনীর মিল দেখতে দেখতে মনছুরা হরহামেশা দরদরিয়ে ঘেমে উঠে। নোনতা শরীরে শাহজানকে ফোন করে, তুমি আসছ?
-হ্যাঁ। ঘর থেকে বেরোলাম তো, তুমি তৈরি?
-হ্যাঁ।
মনছুরা বিছানা থেকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠে বুকের ওড়নাটা ঠিকঠিক করে কালো রঙের বোরখায় মাথা গলাচ্ছে আর মোবাইলে উত্তর দিলো, আমিও বেরোচ্ছি।
-ঘরে কী বললে?
-কেন! ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। গত মাসেও তো নিয়ে গেলে, এবার আর সমস্যা নেই। তোমার ভাইও জানে, তুমি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। উল্টো আরও খুশি হলো। আজকে রিকশাটা বাড়ির রাস্তায় এনে আমাকে নিয়ে যাবে।
-কেউ দেখলে?
-দেখলে, দেখুক। তোমার ভাইকে বলেছি, তুমি আজও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
ফোনের ওপাশে আমতা আমতা করে শাহজান উত্তর দিলো, আচ্ছা। বের হও...
মোবাইলটি রেখে আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নেকাব ঠিকঠাক করে, বিদেশি লালচায়ের রঙের মতো সেন্টের বোতলটি দু' বগলে, বুকে ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে মেরে রুম থেকে বের হয়। উঠোন পেরোতে পিছন থেকে দৌড়ে এসে বোরকা ধরে পাঁচ-ছয় বছরের ছেলে বলে ওঠে, মা... তুমি কোথায় যাচ্ছো...?
-একটু ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। তুমি দাদির সঙ্গে থাকো। আমি ফিরছি...
কথা শেষ হতে না হতে এগারশো মডেলের নকিয়া মোবাইলটি বেজে উঠলে হাঁটা শুরু করে। -রাস্তার মুখে এনেছ রিকশা? আচ্ছা, আমাকে এখন দেখবে, এই তো।
পিছনে ছেলেটি ‘মা মা’ করে যাচ্ছে। আর যখন রিকশায় উঠেই গেলো পিছনে দৌড়ে যেতে রিকশাওয়ালা প্যাডেল মেরে চালানো শুরু করে দিলো। ছেলেটির মুখে হঠাৎ নিষ্পাপ রেখা উবে গিয়ে হিংস্র রূপ নিলো। রাস্তার ইট তুলে রিকশার পিছনে মারতে চাইলো অথচ একটা ইটও তার শরীরের ক্ষমতায় ওঠানো গেলো না। রিকশা দৃশ্যের বাইরে চলে গেলো এর মধ্যে।
স্টুডিওর ভেতরের রুমটার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো নান্দনিক মহিমায়, যেনো স্বর্গের একটা টুকরো মনছুরার সামনে। ভেতরটা ফকফকা আর গোপনীয় কোমলতায় উদ্ভাসিত। কালো বোরখাটি স্টুডিওতে ঢুকতে সামনের ক্যাশের পাশে একটা পলিথিনে ঢুকিয়ে রাখল। যেনো বোরখাটি মনছুরার সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ সতীনকাঁটা।
বোরখা খুলে ভেতরের রুমটাতে ঢুকতে একটা বড় ছবি ঐশ্বর্য রাইয়ের, মেদহীন কোমর ছাড়ানো। রুমের মধ্যে একটা বড় ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় একটা বাটিতে ফেইস পাউডার ও মেকাপের গোলাকৃতির ফোম। মোহনীয় ঘ্রাণে মাতাল হয়ে উঠলো সারা রুমটা। চুড়ির ঝনঝনানিতে শাহজানের ভেতরটা কারবালার প্রান্তর। ছুরি দিয়ে কাটছে আর কাটছে। পলকহীন চেয়ে আছে। দুই দুই বার দরজাটা ঠেলে দোকানদার বলে গেলো, ভাবী হলো?
শাহজান রসিক ঢঙে জবাব দেয়, মেয়েদের সাজের শেষ আছে?
মনছুরা আয়না থেকে মুখ নিয়ে কাঁধ ঘুরিয়ে শাহজানকে মুখ ভেঙিয়ে শব্দ করে, অ্যা…।
শাহজান সন্তর্পণে মনছুরার পিছে এসে কাঁধে হাত বুলায়। মনছুরা বন্ধ দু'চোখ খুলে আয়নাতে তাকায়। খুব যত্নে করে বলে, খুব পেতে চাও না?
-হুম। খুব।
শাহজান পুকুরের জলে নাক ডুবানোর মতো ডুবতে চায়। মনছুরা কাঁধ ঠেলে দাঁড়ায়। চোখ পানি। দৃঢ় দৃষ্টিতে শাহজানের দিকে তাকিয়ে বলে, জানো তোমার ভাই আমার আগে আরেকটা বিয়ে করেছে, সেটা আমার বাবা জানতো না।
শাহজান একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, কেন! একটু খোঁজ নেবে না? তুমি কি কোনোদিকে কম?
মনছুরা শাহজানের এই কথাকে তুচ্ছরূপে হেসে উড়িয়ে বলে, যাদের সৎমা আছে, তারাই জানে। একটা বাঘিনীর সঙ্গে প্রতি নিশ্বাসে যুদ্ধ হয়। আমাকে যেকোনোভাবে ঘর থেকে তাড়াতে পারলে তো তারা বাঁচে, তার ওপর বিদেশে থাকা স্বামী, উল্টো বিয়ের সব খরচ দেবে। আমার বাবার হাতে পাঁচশো টাকার ব্যান্ডেল ধরিয়ে বেহুঁশ করে দিলো।
-প্রতিবাদ করোনি?
-প্রতিবাদ করার সময় পেলাম কোথায়? এক শুক্রবার এরকম একটা স্টুডিওতে ছবি তোলার কথা বলে চুরি করে দেখালো। তারপরের শুক্রবার জোড়া-গাঁথা। তারপর উঠিয়ে নিয়ে এলো।
মনছুরার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ায়। আত্মসমর্পিত দৃষ্টিতে শাহজানকে বলে, না হয় এমন ঘুচঘুচে কালো কাউকে জামাই নেয় কেউ? তাও আবার আমি দ্বিতীয়া!
শাহজানের এতোক্ষণ পর বুকে ধক করে কী যেনো ভাঙে নিঃশব্দে, চোখে অশ্রু জমে ওঠে। মনে পড়ে, প্রথম প্রেমিকার অশ্রুভরা চোখ, আনত মুখ। বিয়ে হয়ে যাবে বলে হাতজোড় করা কাকুতি-মিনতি। সেসময় শাহজানের কোনো কূল ছিলো না। এখনকার মতো বাড়ন্ত ব্যবসা ছিলো না। শাহজানের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ঝকঝকে মেঝের রেকসিনে, মনছুরা মুখ তুলে চাইলো। ভরসা করা দৃঢ়দৃষ্টিতে। ভাবে, এমন কেউ কি আছে এ পৃথিবীতে তার জন্য চোখের অশ্রু ঝরাবে। নিজেকে ধন্য মনে করে মনছুরা। যা হোক, জানে না কার জন্য কাঁদলো শাহজান!
হঠাৎ দোকানদার দরজা ঠেললো। দু’জন হকচকিয়ে নিজেদের ঠিক করে নিলো। গলা ঝেড়ে দোকানদার ঢুকে বললো, ভাবি রেডি?
-হ্যাঁ
-চেয়ারে গিয়ে বসেন।
পাশে বসে শাহজান সন্তর্পণে কাঁধে হাত রাখল মনছুরার। দু'দিকের দু’টি স্ট্যান্ড লাইটগুলো এক এক করে জ্বালিয়ে দিলো। মনছুরা ও শাহজানের মাথাটা হালকা সোজা করে দিলো গিয়ে। ক্যামেরায় চোখ রাখল। আবার সুইচ দিয়ে একটা বাতি নেভাল-জ্বালাল। পরক্ষণে নিজের মনপছন্দ হয়ে গেলে ক্যাচ ক্যাচ করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। শাহজান মনছুরাকে আবেগে কোলে তুলে বসালো, কখনও হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ফটো উঠছেই, ক্যাচ, ক্যাচ...।
ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে মনছুরার। রাস্তার দুই পাশের দোকানের লাইটগুলো পেরিয়ে রিকশা একটু অন্ধকারে এলে বারবার শাহজান চেপে ধরছিল মনছুরাকে তার বুকে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চেপে দু'গালে চুমাচুমি বিছানায় শুয়ে থাকা মনছুরাকে এখনও উত্তেজিত করে তুলছে। খুব ঘেমে নেয়ে যেতে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল বেজে উঠল মনছুরার। খুব খুশিমুখে মোবাইলের স্ক্রিন দেখে মুখ মলিন হয়ে এলো। গা-মরা ভাব নিয়ে কল রিসিভ করে। ওইদিক থেকে বলে, কি, ঘরে আসলে?
মনছুরা চুপ।
বলতে থাকে, আমি এয়ারপোর্টে যাচ্ছি, কাল হয়তো বাংলাদেশে পৌঁছাব ইনশাল্লাহ্।
মনছুরার ভেতরটা কেঁপে উঠে হুটহাট। দপ্ করে নিভে যায় যেনো সব হুঁশের বাতি। মনছুরা মোবাইলে এক লফজ কথাও বলে না। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে কল কেটে দেয়। কতোক্ষণ বেহুশের মতো চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর আলমারি খুলে শাড়ি, গয়নাগাটি ব্যাগে গোছাচ্ছে। কখন ঘুম থেকে উঠে ছেলে মাশুক বাম হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, মা তুমি এতো রাতে কোথায় যাবে? মা, মা... বলো, বলো...
মনছুরা খোলা জানলার লোহার শিক ধরে পথের দিকে চেয়ে আছে। আকাশে হেলে আছে ফোলা রুটির মতো একটি চাঁদ।
একদিন মাশুক ঘুম চোখে টের পায় একজন নারীর হাত তার মাথার চুলে পরশ বুলাচ্ছে। চোখ খুলে দেখল, একজন মধ্যবয়স্কা নারী। কাতান শাড়ি পরিহিতা। বাবা কাছে এসে বললেন, আজ থেকে ইনি তোমার মা।
হঠাৎ ধানি জমির মাঠে শো শো করা দখিনা বাতাস যেনো মাশুকের লোমকূপে বয়ে যায়। তার কপাল পুড়ে জ্বর আসে, খুব ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে।
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্ সাঈদ
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
এসএনএস