ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: একাদশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৭
নীল উড়াল: একাদশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে

১১.
আমি রোজ সকাল ছ’টার পর ফেসবুক খুলি। ওই সময়টা ফ্রিটাইম থাকে ইন্টারনেটে।

সারা রাত নেটে জেগে থাকা উগ্র-তরুণ-তরুণীরা তখন ঘুমায়। ব্যবহারকারীর চাপ বলতে গেলে থাকেই না। নির্বিঘ্নে পত্রিকা পাঠ আর ফেসবুক নিয়ে ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে আমি প্রাত্যহিক কাজে যোগ দিই। সকালবেলা মানুষের মন ও মেজাজ বেশ স্নিগ্ধ ও ফুরফুরে থাকে। কিন্তু পত্রিকার নেতিবাচক খবরে মন স্থির রাখা প্রায়শ সম্ভব হয় না। এরই মাঝে একদিন হঠাৎ দেখি আমার একজন পরিচিতের ফেসবুকে এক ভয়ানক অশ্লীল ছবি। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি ফেসবুক ব্যবহারের সময় বদলে দিলাম।

সকালবেলা আমন্ত্রণ জানিয়ে মন বিষিয়ে তুলতে আমি নারাজ।

নীল উড়াল: দশম পর্ব

আমার পরিচিত জনের সঙ্গে আমার ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী এবং তার আত্মীয়-স্বজনের বন্ধুত্ব আছে ফেসবুকে। আপত্তিকর ছবিটি তিনি লোড করেন নি; তাকে ট্যাগ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! এ তো সবাই দেখছে। তিনি খবর পেয়ে বা অপছন্দ করে ঐ কুৎসিত ছবি ডিলিট বা মুছে না-ফেলা পর্যন্ত তো বিশ্বজুড়ে সবাই সেটা দেখবেই। যারা সাবালক তাদের কথা আলাদা। কিন্তু ছোটরাও তো আজকাল ফেসবুকে আছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না কী করবো? এসব কথা কাউকে জিজ্ঞেসও করা যায় না। কোনও মন্তব্য লিখে প্রতিবাদ করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাহলে সবাই তো বুঝবে আমিও ছবিটি দেখছি এবং এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করে বিষয়টিকে উপভোগ করছি। আমার মতো অনেকেই বুঝেন যে, এ নোংরামি আসলে ভয়ানক বদমাইশি এবং নিম্নশ্রেণীর বিকৃতি। মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে এহেন বিকৃতির যোগসূত্র রয়েছে।

ডা. ফাহমিদ সাইবার জগত ও ফেসবুক থেকে কিছু কিছু তরুণ-তরুণীর মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার এবং ড্রাগসে আসক্ত হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একদিন  ফোন করে তিনি আশ্চর্য এক ঘটনা জানান। যার ব্যাপারে জানাচ্ছে, ধরা যাক তার নাম ‘ক’। ‘ক’ ফেসবুকে কয়েকটি একাউন্ট করেছে নামে-বেনামে। ব্যাঙ্কে কালো টাকা রাখার জন্যে বেনামি একাউন্টের মতো ব্যাপার মনে হলো আমার কাছে বিষয়টিকে। ‘ক’ তার ফেক-একাউন্টের মাধ্যমে উত্তেজক ছবি নিজের ওয়ালে পোস্ট করে; অন্যত্র এমন কুৎসিত কিছু পেলেও অশালীন মন্তব্য করে সেসবে যোগ দেয়।

‘ক’ একদিন দেখলো একটি মেয়ের ছবিতে বহুজন লাইক দিয়েছে। সে ছবিটিতে ক্লিক করে ফুলস্ক্রিনে দেখে চমকে গেল। এ যে ওরই ছোট বোন!  বাসের ভিড়ে কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো ওর ওড়নাটা সরে গিয়েছিল। আর বিকৃত মনের কেউ একজন তখনই গোপন এঙ্গেল থেকে মোবাইলে লোভনীয় ভঙ্গিতে ছবিটি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে দিয়েছে। তখনই ‘ক’ টের পেল সে নিজে মানসিক বিকৃতিকে আক্রান্ত একজন মানুষ এবং এ কারণে সে-ও মানসিক বিকারগ্রস্থ একদল অচেনা নোংরা লোকের সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েছে, যারা তার বোনকে পর্যন্ত ছাড়ছে না।

‘ক’-এর বোধোদয় হলো তখনই, যখন সে নিজেই আক্রান্ত হয়েছে। যারা এমন কুৎসিত কাজে আক্রান্ত তারা হয়তো নিজেদের ঘরের মা-বোনদের কথা স্মরণ রাখে না; কিংবা মানুষ হয়েও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে খুব আদিম বা পশুর মতো জ্ঞান রাখে। এরা যখন মানুষের সমাজে মিশে তখন পশুর মতোই ‘কাজ’ বা ‘আচরণ’ করে। অতএব বাধ্য হয়ে অধিকাংশ সুস্থ মানুষ এমন আপত্তিকর ও অশ্লীল বিষয় ‘উপেক্ষা’ করেন।

উপেক্ষা করেও কিন্তু মনে শান্তি পাওয়া যায় না। কারণ, ছবিটা তো থেকেই গেল। একটি মেয়ে গোটা বিশ্বের সামনে লাঞ্ছিত হলো এবং কতিপয় বিকৃতমনা পশু-মানুষের খোরাকে পরিণত হলো। এর চেয়ে মানবিক বিপর্যয় ও অপমান আর কি হতে পারে!  সবই দেখলাম অথচ কিছুই না দেখার ভান করলাম; এক অর্থে এমন অবস্থা আমরা যারা মেনে নিতে বাধ্য হই, সেটাও এক অক্ষমতাই বটে। এখন মনে হচ্ছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের কোনও অপছন্দনীয় বিষয়/ছবিকে ‘উপেক্ষা’ করাটা আসলে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার নামান্তর হলেও এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষেধক।

ডা. ফাহমিদের পাঠানো ঘটনা আর তার মন্তব্য পড়ে ভাবছি, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে মানসিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায়-অসম্ভব। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেও কাজটি সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে এখানে যাচ্ছে-তাই ধরনের পরিস্থিতিও তো চলতে পারে না। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে ইনট্রোডাকশন লাগে। যেমন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলেও লাগে। তাহলে একটা আইডেনটিটি স্বীকৃত হল। আবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নানা ‘হ্যাঁ’-এ ক্লিক করে এগিয়ে এগিয়ে  ফাইনালি ডিজিটাল জগতে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। অনেকেই কিসে ‘হ্যাঁ’ করেছেন, মনে রাখেন না। আর একাউন্ট খোলার সময় তো সবাই ‘সুনাগরিক’। এরপর ফ্রেন্ডশিপ অ্যাকসেপ্ট করলে তবেই অ্যাকসেসের অনুমতি পাওয়া যায়। এটাও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে চুক্তি বিশেষ। এখন যদি সব কিছু ‘উপেক্ষা’ করতে হয়, তাহলে এতোসব চুক্তি ও শর্তের কী প্রয়োজন? ওয়েবসাইটগুলো চুক্তি-শর্ত উঠিয়ে দিলেই পারে!

ডা. ফাহমিদ অবশ্য মনে করেন, এ পরিস্থিতিতে অবশেষে ‘উপেক্ষা’ ও ‘পরিত্যাগ’ই  শেষ ভরসা। রুচিহীনতা যে কোনও পর্যায়েই নামুক, ‘পরিত্যাগ’ ও ‘উপেক্ষা’ নামক গণতন্ত্রসহায়ক ভীষণ হাতিয়ার কিন্তু সব সময়ই আমরা প্রয়োগ করতে পারি। নিয়ন্ত্রণের ছড়ি ঘোরানোর চেয়ে অনেকাংশেই শক্তিশালী অথচ সহজতর এ ‘উপেক্ষা’র পথ। প্রয়োগ করতে পারলে মূলেই বিনষ্ট ও কোণঠাসা হবে হীনচেষ্টা। তত্ত্বগতভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমা কতটা বা কোথায়, বাস্তবে থাকলেও সাইবার ভুবনে এর মাপকাঠি নির্ধারিত নেই। যা আছে তা হল একটি মানসিক সীমানা আর মূল্যবোধের আড়াল। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে রুচির তারতম্যে এই সীমানা ও আড়াল বাড়ে-কমে বটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও সামাজিক জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমানা ও মূল্যবোধের আড়াল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় নয়; অন্যের জন্যেও হয় সুখের, নয় হানির কারণ।   ফলে কারও কু-চেতনা যে অধিকাংশের সু-চেতনায় হানি ঘটাচ্ছে, এ কথাটা আঘাত নয়, ‘পরিত্যাগ’ ও ‘উপেক্ষা’ করে বার বার মনে করিয়ে দিয়ে এটাই জানান দিতে হয় যে, সমাজে তোমার উপযোগিতা নেই, তুমি পরিত্যাজ্য। ঘৃণা, পরিত্যাগ ও উপেক্ষার শক্তিই এখানে একমাত্র সম্বল। যেমন আমরা সমাজে ও রাজনীতিতে অনেক কিছু উপেক্ষা ও ঘৃণা করি, তেমনই আর কি!

ডা. ফাহমিদকে জানিয়েছি যে, আমি মনে করি, উপেক্ষার সঙ্গে সতর্কতাও জরুরি। সাইবার ঝড়ে আপনি, আমি সকলেই কোনও না কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে বাধ্য। ফেসবুকের কথাই ধরি। প্রতিদিন দেখা হওয়া সম্ভব নয় সময়ের বা দূরত্বের কারণে, এমন বন্ধুদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। নিজের স্বচ্ছ অনুভূতি, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি খুব সহজে ও অতি দ্রুত তাদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় ফেসবুকের মাধ্যমে। হারিয়ে যাওয়া পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে, নতুন কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে, কাছের কিংবা দূরের বন্ধুদের সঙ্গে চিন্তার নৈকট্যে সম্মিলিত হয়ে ফেসবুকের উদ্ভাবক মার্ক জুকারবার্গকে ধন্যবাদ দেয় না, এমন লোক সামান্যই। এখন তো এমনও বলতে শোনা যায়, যার ফেসবুক আইডি নেই, পৃথিবীতে তার কোনও অস্তিত্বই নেই।

ডা. ফাহমিদ সতর্কতার সঙ্গে আমাকে জানান, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নতুন আইডি খুলে ফেসবুকের আবর্তে চলে আসছে। কিন্তু যারা কুরুচিপূর্ণ, বিকারগ্রস্ত, তারা রাস্তায় থাকুক অথবা ফেসবুকে, সবখানেই তাদের বিকৃত-রূপ একই রকম। এ কারণে ফেসবুকের পরিবেশও বিষাক্ত হচ্ছে। অশ্লীল নামের ভুয়া পেজে বা অশ্লীল ও আপত্তিকর বা সাধারণ্যে ব্যবহার অনুপোযোগী ছবিতে দুষিত হচ্ছে ফেসবুক এবং যারা সুস্থ, সামাজিক, মুক্তমনা, এমন ব্যবহারকারীরা। এ কারণে উপেক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীদের সতর্কও থাকতে হয়। কেউ আপনাকে আক্রান্ত করতে পারে কিংবা আপনাকে ব্যবহার করে অন্যকেও আক্রমণ করতে পারে। আপনার অগোচরে আপনার কোনও কিছু অশ্লীল বা বিকৃতভাবে অপ-প্রয়োগও করে ফেলতে পারে কোনও মানসিক-অপরাধী। ফলে আপনার ব্যক্তিগত ছবির অ্যালবাম, ভিডিও ইত্যাদিতে প্রাইভেসি সেটিং দিয়ে রাখুন। তাহলে আপনার বন্ধু তালিকার নিদির্ষ্ট ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছাড়া অন্যরা সেটা দেখতে পারবে না। যেটা পাবলিবলি দেখাতে চান সেটার কথা অবশ্য আলাদা। অচেনা কাউকে বন্ধু করার আগে দশ বার ভাবুন। আইডিটি আসল না ফেক সেটা যাচাইয়ের চেষ্টা করুন। মাঝে মাঝে অচেনা বন্ধুর ওয়ালে গিয়ে তার এক্টিভিটি ফলো করে দেখুন, আসলে সে কি নিয়ে ব্যস্ত আছে। যদি ওকে দেখা যায়, বিকৃতি প্রাধান্য পেয়েছে, তবে তাকে নির্দ্বিধায় বন্ধু তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলুন। আপনি কোন পোস্ট আপনার কোন বন্ধুকে দেখাতে চান, অথবা দেখাতে চান না, সেগুলোও প্রাইভেসি সেটিং-এর মাধ্যমে নির্ধারিত করুন। মনে রাখা ভালো, ফেসবুকের মতো একটি খোলা জানালার ‘দেয়াল’ উন্মুক্ত থাকুন আপনার ও আপনার পছন্দের বা সুস্থ মনের মানুষের অনুভূতি বা ছবি শেয়ার করার জন্যে; নিজেকে বা অপরকে কলুষিত করার জন্যে নয়। মানসিক বিকৃতি ছড়ানোর জন্য নয়।

এসব কথা ডা. ফাহমিদ একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে পত্রিকায় ছাপিয়ে প্রচার করতে চান। তার কাছে তথ্য আছে, বহু তরুণ-তরুণী সাইবার ক্রাইম বা বিকৃতির শিকারে পরিণত হয়ে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউ কেউ কু-সঙ্গের ডাক পাচ্ছে সাইবার জগত থেকে। মাদকের বিস্তারের সঙ্গেও ক্রমে বাড়ছে সাইবার কার্যক্রমের সম্পর্ক।

সত্যিই, এখন জগত ভাগ হয়ে গেছে বাস্তবে আর ভার্চুয়ালে। যে জগতে আমরা বাস করি, তার চেয়ে বহু বেশি মানুষকে আমরা চিনি ও যোগাযোগ করি ভার্চুয়াল জগতে। এ জগতের আনন্দ আর বেদনা; বিপদ আর সম্ভাবনা বর্তমান সময়ের অন্যতম বাস্তবতা। একে মেনে নিয়েই এবং সামলে নিয়েই আমাদের অতিক্রম করতে হচ্ছে ডিজিটাল পৃথিবীর সাইবার পথ। কক্সবাজারের রামুর সহিংস দাঙ্গার সূত্রপাত সাইবার জগত থেকে। শাহবাগ আন্দোলন ও চলমান পরিস্থিতিতে সাইবার জগতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যবহার ও অপব্যবহারের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। মতলববাজরা পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। চরিত্রহনন, কুৎসা রটনা, গুজব ও তথ্য বিকৃতি ছাড়াও সাইবার সন্ত্রাসে নিমিষে লোপাট হয়ে যেতে পারে মানুষের ইমেজ ও ইজ্জত, ব্যাঙ্কের জমানো আপনার টাকা; গোপন নথি। এলোমেলো হতে পারে কম্পিটারে রাখা ই-মেইল, বিভ্রান্তি ছড়ানো হতে পারে বিশেষ কাউকে নিয়ে  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কাউকে ব্যবহার করে বা কারও নাম ভাঙিয়ে অনাকাক্ষিত পরিস্থিতিও সৃষ্টি করতে পারে দুষ্টচক্র। কাউকে জড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে অপরাধের সঙ্গে। অতএব এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাবধানতা অনস্বীকার্য।

সমস্যাটি নিয়ে আরও কথা বলেছিলাম কয়েকজন আইটি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারা জানান, বর্তমানে অনেকেই ব্রডব্যান্ডের জন্য ওয়াই-ফাই ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। সতর্ক না হলে হ্যাকাররা সেটা ব্যবহার করতে পারবে। এর থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো, যাকে দিয়ে আপনার নেটওর্য়াক ইন্সটল করিয়েছেন, তাঁকে বলবেন, আপনার নেটওর্য়াকটি যেন লুকনো থাকে। এবং সেটি যেন ডব্লিউপিএ-২ হয়। কখনও ডব্লিউইপি ব্যবহার করবেন না। এটা সহজেই হ্যাক করা যায়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কম্পিউটারের সঙ্গে সঙ্গে ফোনও সব সময় অনলাইন থাকে। সেখান থেকেও হতে পারে ‘আইডেনটিটি থেফ্ট’। ‘আইডেনটিটি থেফ্ট’ মানে যখন কেউ কারও নাম, প্যান নম্বর বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর সেই ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করতে পারে। এসব ঠেকানোর প্রথম ধাপটি হলো, কখনওই ব্যক্তিগত বা গোপনীয় তথ্য ব্যবহার না করা।   সাবধান থাকতে হবে কোনও রিকোয়েস্ট গ্রহণ বা কোন অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও। কম্পিউটার থেকে কোড বা তথ্য চুরি ঠেকাতে ‘ফায়ারওয়াল’ ইন্সটল করার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এন্টি-ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে এন্টি-ম্যালওয়ার প্রোগ্রামও ইনসটল করা জরুরি।   জোরদার ও জটিল পাসওর্য়াড ব্যবহার করা নিরাপদ। মাঝেমাঝে সেটার পরিবর্তন করাও দরকার।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, ই-মেইলে আসা কোনও অজানা ছবি বা লিঙ্কে ক্লিক না করা।   সাইবার সন্ত্রাস থেকে নিরাপদে থাকার জন্য বিশেষজ্ঞরা কিছু টিপস দিয়েছেন। যেমন, ডিকশনারি বা অভিধানের চেনা শব্দ দিয়ে পাসওর্য়াড তৈরি করা উচিত নয়। এ্কই পাসওর্য়াড দুইবার ব্যবহার করাও অনুচিত। বিভিন্ন ওয়েবসাইটের জন্য আলাদা আলাদা পাসওর্য়াড ব্যবহার করাই বিধেয়। যত বড় পাসওর্য়াড হয়, তত ভালো। পাসওর্য়াডের দৈর্ঘ্য যত বড় হবে, সেটাকে ভাঙা বা হ্যাক করা ততই কষ্ট ও সময়সাপেক্ষ।

স্বাভাবিকভাবে ১৪ বা তার বেশি ক্যারেক্টারের পাসওর্য়াড ভাঙা প্রায় অসম্ভব। গোপনে রাখতে হবে পাসওর্য়াড। ইনবক্স বা ডেক্সটপে কখনওই রাখা ঠিক নয়। আলাদা কাজে আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ যে ওয়েব ব্রাউজার যেমন ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, মোজিলা ফায়ার ফক্স, গুগল ক্রোম ইত্যাদি দিয়ে এক একটি কাজই করা ভালো। সামাজিক যোগাযোগ ও ব্যাঙ্কিং বা গোপন বিষয় একই ওয়েব ব্রাউজারে কখনওই ব্যবহার করা উচিত নয়। বিশেষ করে, বাসা-বাড়িতে অনেকেই একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেন। বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে একই কম্পিউটারের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের একাউন্টে কাজ করার সময় বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। যাতে অসাবধানতা  বশত পাসওর্য়াড ফাঁস হয়ে না যায়।

বস্তুতপক্ষে বর্তমান যুগ শুধু বিশ্বায়নের যুগই নয়; সাইবার যুগও। সাইবার জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকার অর্থই হচ্ছে পৃথিবীতে যোগাযোগহীন থাকা। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, স্কাইপ, লিঙ্ক-ইন, ব্লগ তথা ভার্চুয়াল লাইফে যাকে পাওযা যায় না, তাকে অনুপস্থিতই ধরা হয়। মনে করা হয়, তিনি হারিয়ে গেছেন।

যোগাযোগের জগতে টিকে থাকার প্রতিযোগিতাই চলতি সময়কালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি ব্যস্ততার কারণে অনেকেই কেনা-কাটা, ব্যাঙ্কিং, বিল প্রদানসহ অনেক কিছুই অনলাইনে সারেন। সকল ক্ষেত্রেই নিজের তথ্য, হিসাব-পত্র, দলিলাদি গোপনে সংরক্ষণ রাখার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে সাইবার জগতের অনলাইন ভুবনে মানুষ যত বেশি প্রবেশ করবে, ততই বেশি নানা ভাইরাস আর সন্ত্রাস বা প্রতারণা, অপরাধ, নেশা মানুষকে চেপে ধরবে। সাইবার জগত ত্যাগ করে বর্ণবহুলভাবে জীবন-যাপন যেহেতু অসম্ভব, সেহেতু যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রতিষেধক নেওয়াই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ।

সাইবার জগত ও অনলাইন সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে এর নানা সমস্যাগত দিক সম্পর্কেও অবহিত হওয়ার দরকার পড়ছে। ডিজিটাল যুগ, সাইবার জগত আর ভার্চুয়াল জীবন-যাপনের পথে প্রয়োজন তথ্যগত জ্ঞানভিত্তিক সতর্ক পদক্ষেপ। নিজেকে আগে যেমন বাস্তব সমস্যা থেকে রক্ষা করতে হতো; এখন সাইবার সমস্যা থেকেও বাঁচানোর দরকার পড়ছে।
মাদকও এখন ঔপনিবেশিক আদিম পন্থার বদলে অত্যাধুনিক সাইবার পথে এগিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।