ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: উনবিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
নীল উড়াল: উনবিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

১৯.
ঠিক চারটায় শামীমের মোটরসাইকেল পাবলিক লাইব্রেরির চত্বরে এসে পৌঁছুল। সাংবাদিকদের সময় জ্ঞান বেশ উচ্চ পর্যায়ের হলেও কাজের চাপে তারা সেটা সচরাচর বজায় রাখতে পারেন না।

শামীম পেরেছেন। পাবলিক লাইব্রেরির ভেতরে যে ক্যান্টিন রয়েছে, সেখানে ওর মোটরসাইকেল থামালেন। শামীম নামলেন না। চারপাশে চোখ রেখে সম্ভবত আমাকেই খুঁজলেন।

এক পাশে একটি গাছের ছায়ায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাছে গিয়ে বলি:
-কেমন আছেন শামীম?
আমাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে বলেন:
-ভালো। কথা পরে হবে। আগে উঠে পড়ুন। আমাদের কেউ ফলো করতে পারে। চলুন। এখান থেকে সরে গিয়ে কথা বলি।

নীল উড়াল: অষ্টাদশ পর্ব

শামীম আমার চেনা, তবে ঘনিষ্ঠ নন। ওর সাথে কোথায় চলে যাওয়া কি নিরাপদ হবে? ফোনে একাধারে তার রুক্ষ আচরণ ও পরে দরদী মনের উদাহরণ পাওয়া গেছে। ওর সাথে যাওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। একটি উক্তি মনে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের। আমি খুব মানি। রবীন্দ্রনাথ মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস না হারাতে বলেছেন। উঠে পড়ি শামীমের বাইকে। স্টার্ট দেওয়াই ছিল। চোখের পলকে শামীম বড় রাস্তায় এসে ডানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটলেন। বাইক চালাতে চালাতেই লজ্জিত গলায় বলেন:
-ভাই আমার আচরণে ভুল বুঝবেন না? আমি সাবধানতার জন্য এমন করছি।
আমি পাল্টা জানতে চাই:
-কি হয়েছে? এতো সাবধানতা কেন?
শামীম মন খারাপ স্বরে বললেন:
-আপনাকে আর কোনও সাহায্য যেন না করি, সে ব্যাপারে আমাকে প্রচ্ছন্নভাবে শাসানো হয়েছে। হুমকি-টুমকি আমি বিশেষ পাত্তা দিই না। তবে মুশকিল হয়েছে অন্য খানে।
আমি সবিস্ময়ে বলি:
-কি মুশকিল?
শামীম তার সন্দেহের বিষয়টি খুলে বলতে থাকেন:
-আপনাকে যা যা বলেছি, সব খবর চলে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের কাছে। আমি যে নানাজনের ঠিকানা ও সূত্র আপনাকে জানাচ্ছি, সেটাও জেনে যাচ্ছে। এজন্যই সেদিন ফোনে কিছুই বলি নি। রূঢ় ভাবে কথা বলেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না যেন। আমার আশঙ্কা, প্রতিপক্ষ খুবই নিকট থেকে আপনাকে ওয়াচ করছে। কিন্তু তাকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

এখন আমি ঠিক বুঝতে পারছি, শামীমের সে দিনের ফোনের অসংলগ্ন আচরণ সম্পর্কে। মনে হয় ওর উপর আস্থা রাখা যায়। শামীমের মোটরসাইকেল কার্জন হলের আঙিনায় চলে এসেছে। মোটরসাইকেল একটি চায়ের দোকানের সামনে থামিয়ে শামীম দোকানিকে বললেন:
-তপু, গাড়ি দেখিস। আমি আসছি।
চা দোকানী মাথা নাড়ল।
শামীম বলল:
-চলেন রমনায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। সবাই ভাববে ইভিনিং ওয়াক করছি। আমি মাঝে মাঝেই সময় পেলে হাঁটতে আসি। সন্দেহ করার কিছুই থাকবে না। দু’ জন দুই গেট দিয়ে ঢুকবো। কেউ দেখলেও ভাববে, কাকতালীয়ভাবে আমাদের দেখা হয়েছে।

শামীমের প্রস্তাব মন্দ নয়। আমরা আবার মিলিত হওয়ার লক্ষে দু’জন দুই পথে চলে গেলাম।
রমনার ভেতরে এসে মনে হলো মৃত্যুর উৎসবে এসেছি। এ যেন সবার সামনে মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তিলে তিলে হত্যার যজ্ঞ। মেরে ফেলার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমাদের স্মৃতির শহর রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একদার নিবিড় সবুজ রমনা-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসমূহকে দৃশ্যত হত্যাই করা হচ্ছে।

১৬১০ সালে পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকায় মুঘলদের শাসন পাকাপোক্ত করার পর বাগানের অনুরাগী শাসকরা উদ্যান রচনার উদ্যোগ নেন। তখন এর আদি নাম ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহি’। বর্তমান ইস্কাটন থেকে নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সচিবালয়, আজিমপুর ইত্যাদি পুরো এলাকাই ছিল রমনা উদ্যানের অংশ। কোম্পানি আমলে রমনার দক্ষিণের একটি অংশে রেসকোর্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে রমনা এলাকা ক্রমে ক্রমে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। অভিজাত-নান্দনিক গুলবাগিচার রমনা হয়ে যায় বুনো জন্তুদের আশ্রয়স্থল। ১৮৫২ সালে ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস ঢাকা জেলের কয়েদিদের দিয়ে রমনার কিছুটা অংশ জঙ্গল কাটিয়ে সাফসুরত করেন। এ সময় রমনার আভিজাত্য ফিরতে থাকে। নগরের বিদেশি বিত্তবানরা এ এলাকায় বাগানবাড়ি করতে থাকেন। নবাব আবদুল গণি এসব বাগানবাড়ির মধ্য থেকে অবসরপ্রাপ্ত জজ জন ফ্রান্সিস গ্রিফিথের বাড়িটি কিনে নেন। এলাকাটিকে আরও উন্নত করে তিনি নাম দেন ‘শাহবাগ’।

১৯০৫ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামের নতুন প্রদেশ স্থাপিত হলে রমনা এলাকা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। নবাবদের মালিকানায় ‘শাহবাগ’ এলাকা, উত্তর দিকে মিন্টো রোডে ‘সিভিল স্টেশন’ নামে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, মাঝখানে রেসকোর্স ও বর্তমানের উদ্যান মিলিয়ে ‘রমনা’ এলাকা। রেসকোর্সে পাকিস্তান আমলেই আইন করে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনে রমনা ঐতিহাসিক হয়ে আছে। সংগ্রাম ও স্বাধীনতার উচ্চাশা প্রকাশিত হয় এখানকার জনসভায়। পরাজয়ের দলিলও লিপিবদ্ধ হয় এখানেই। যার বর্তমান নাম ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’।  

ফুটওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে শামীমের দেখা পাওয়া গেল। আমি ক্ষোভ সামলাতে না পেরে বলে উঠি:
-সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের রমনার এ কি অবস্থা শামীম!
শামীম হাঁটতে হাঁটতেই বলেন:
-আপনাকে শুধু হাঁটা বা নিরাপত্তা বা লোকচক্ষু এড়ানোর জন্য এখানে নিয়ে আসি নি। কিছু দেখাতেও চাইছি। আসুন...।

আমরা উদ্যানের পশ্চিম দিকে চলেছি। গোল চত্বরের ফুটওয়েতে শত শত নারী-পুরুষ স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ব্যস্ত। মনে হয় প্রাণের উৎসব। এরই মাঝে শামীম পশ্চিম প্রান্তের গাছগুলোর তলায় কয়েকটি জটলার দিকে ইঙ্গিত করল। গোল হয়ে বসে এরা কি করছে? আমি ঠিক ঠাউর করতে পারি না। আমার অজ্ঞতা লক্ষ্য করে মুখ খুললেন শামীম:
-বিকালের পর থেকে এখানে একটা-দুটো জটলার মতো ‘মজমা’ জমে। ছোট ছোট দলের এমন আসরে মাঝ রাত পর্যন্ত সরগরম থাকে উদ্যানের এই অংশ। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে গাঁজা ও নানা নেশার গন্ধে।

তাকিয়ে জটলার মাথার ওপর ছোপ ছোপ খোঁয়া দেখতে পেলাম। শামীম আরও জানান:
-গাঁজা ছাড়াও এখানে ফেনসিডিল, চরস ইত্যাদি নানা ধরনের নেশা সেবনের ব্যবস্থা রয়েছে। বিষয়টি কারও অজানা নেই। কিন্তু করার কিছুই নেই। এসব ব্যবসা যারা চালাচ্ছে, তারা খুবই শক্তিশালী। শুধু এখানেই নয়, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, মেডিকেল ইত্যাদি এলাকায়, এমন কি জেলখানার ভেতরেও স্থায়ীভাবে চলছে শত শত ভাসমান আসর। দেদারে মাদক আসছে, নানা পেশা ও বয়সের মানুষ মাদক গ্রহণ করছে। কেউ কিছু বলছে না। ঢাকা শহরে কয়েক হাজার মাদক সাপ্লাই সেন্টার আছে। কোনও কোনও পত্রিকা সেটার রিপোর্ট করতে গিয়ে এমনভাবে লিখে যে, কোথায় কোথায় কি পাওয়া যায়, সেটা পর্যন্ত আগ্রহীরা জেনে যায়। এসব রিপোর্ট মাদক বন্ধের চেয়ে প্রচারই করছে বেশি।

শামীম হাঁটতে হাঁটতে উদ্যানের উত্তর প্রান্তে চলে এসেছেন। শিশুপার্ক সংলগ্ন এই অংশে ভবঘুরেদের আড্ডা। ভাসমান পতিতাদের ঠাঁই। শামীম আমাকে জানান:
-এরাও মাদক ব্যবসার একটি বড় অংশ। ছোট ছোট সাপ্লাই ও খুচরা বিক্রির কাজটি এরাই করে। সবার সাথেই এদের সম্পর্ক ও লেন-দেন। কেউ কিচ্ছু বলে না।

রমনার মাঝখানের পুকুরগুলোর দিকে তাকানো যায় না। থকথকে দুষিত পানি। ভাগাড়ের মতো দুরবস্থা। আবর্জনার পাহাড়। যেন সবুজের মধ্যে কালো কালো কলঙ্ক চিহ্ন।
শামীম বাংলা একাডেমির সামনের অংশে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বললেন:
-অনেক হেঁটেছি। চলেন, চা খেতে খেতে বাকি কথা বলি।
আমিও সম্মতি জানিয়ে বলি:
-বেশ।

অসংখ্য অস্থায়ী চা দোকান রমনার চারপাশে। একটির বেঞ্চে বসা গেল। আশেপাশে উৎসবের ভিড়। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় ফাটাফাটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানুষের চাপে প্রাণান্তকর ব্যাপার। ঢাকার মানুষের জন্য বিনোদন ও ভ্রমণের যে যথেষ্ট ভালো আর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, এসব ভিড় তার-ই প্রমাণ দেয়। শামীম চা খেতে খেতে জানতে চাইলেন:
-আপনার কাজ কেমন এগুচ্ছে?
আমি নিরস গলায় বলি:
-চলছে। মাদকচক্রের আভাস পেলেও স্পষ্টভাবে চক্রটিকে শনাক্ত করতে পারছি না।
আমার কথা শুনে শামীম বলেন:
-কঠিন কাজ। আপনি বরং সীমান্ত এলাকাগুলো দেখুন। রুট ধরতে পারবেন। আর আমি যে দু’জন প্রফেসরের কথা বলেছিলাম, মনে আছে?
আমি বলি:
-হ্যাঁ, আছে। ড. ইমদাদ আর ড. মনোয়ার।
শামীম বললেন:
-ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ওরা ভয়-ভীতির পরোয়া না করে আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
আমিও একমত হয়ে বলি:
-সেটাই ভালো হবে।

শামীম উঠলেন। তার অফিস আছে। যেতে যেতে বললেন:
-আপনাকে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। অনুরোধ করবো কাজের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে। আপনি যে বিষয়ে খোঁজ-খবর করছেন, সে বিষয়টির সঙ্গে জড়িত লোকজন আপনার খুব কাছেই অবস্থান করছে। বিপদ দূরে নেই।
আমি শামীমের দিকে চেয়ে বলি:
-আপনাকে ধন্যবাদ শামীম। আপনার কথাগুলো আমি মনে রাখবো।

রমনার শরীরে জমাট সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে শামীম চলে গেলেন। আমি এখনও বসে আছি। আজ রাতটা রমনার সঙ্গে কাটালে কেমন হয়? গাঁজার জটলাগুলো, ভবঘুরে মানুষ, শাহবাগ মোড় থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত নিশুতি মানুষের জেগে থাকা, তরুণ-তরুণীর স্তব্ধ জীবন, নেশার কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার স্তর ভেদ করে আমি কি পৌঁছুতে পারবো লুকনো মনগুলোর কাছে, যেখানে খেলা করছে, আশা ও নিরাশার আলো ও অন্ধকার। স্বপ্নে আমি একটি চাবি দেখেছিলাম। সেটা কি মনের দরজা খুলতে পারবে? ভুতগ্রস্ত আনমনা মানুষের মতো আমি রমনার শরীরের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমাকে লক্ষ্য করলে যে কেউ দেখতে পেত, রমনার সবুজ ছায়ায় একজন অদেখা-অচেনা ছায়ামানব হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।