৩৬.
জেগেই দেখি অনিন্দ্য আলোর ভোর। শামুকের পিঠের মতো পুরোটা দ্বীপের বালুচর চকচক করছে অলৌকিক সূর্যালোকে।
এখানে দিনের পত্রিকা দিনে আসে না। কয়েক দিন পর পর পত্রিকা পাওয়া যায়। জরুরি খবর অবশ্য আজকাল মোবাইলেও লভ্য। সঙ্গে রেডিও বা ইন্টারনেটের সুযোগ স্বাভাবিক ঘটনা। বেশ কিছুদিন পত্রিকা দেখা হয় না। রোকসানার মৃত্যু নিয়ে নতুন কিছু লিখেছি কি? পত্রিকা টেনে নিতেই আমার চোখ ছানাবড়া।
প্রথম পাতাতেই বড় হরফে লিখা ‘মাদক বাণিজ্যের কালো থাবায় ফোকলা অর্থনীতি: প্রতিদিন নেশার পেছনে অপচয় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা! বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত পাঁচ ধরনের মাদক ১. গাঁজা, ২. মদ, ৩. ইয়াবা, ৪. হেরোইন ও ৫. ফেনসিডিল: রোজ শুধু রাজধানীতেই ইয়াবা বাবদ হাতবদল হয় ৭ কোটি টাকা’। বিস্তারিত খবরে নজর দিই। সেখানে লিখা: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট চক্রের অবৈধ মাদক বাণিজ্যের কালো থাবায় ফোকলা হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন গবেষকের সমীক্ষালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিদিন দেশে নেশাদ্রব্যের পেছনে জাতীয় অপচয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশের বেশি। জব্দকৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংসের কারণে জাতীয় অর্থনীতি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অপমৃত্যু হচ্ছে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদশেকে মাদকের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ইউরোপীয় দেশসমূহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাদকাসক্তদের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারীরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। স্থানীয় সিন্ডিকেট বিদেশিদেরও ব্যবহার করছে এ চোরাচানের কাজে। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯৪ সালে মিয়ানমারের সাথে, ১৯৯৫ সালে ইরানের সাথে এবং ২০০৬ সালে ভারতের সাথে মাদক চোরাচালান ও মাদকের অপব্যবহার বিরোধী দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে; মাদকবিরোধী সার্ক কনভেনশন, ১৯৯০ স্বাক্ষর করা হয়েছে; তথাপি মাদক চোরাচালানের অবাধ প্রবাহ দেখে মনে হয় এসব চুক্তি সমঝোতা স্মারক কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এসব চুক্তি-সমঝোতা স্মারকের অধীনে সময়ে সময়ে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে।
১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির মাধ্যমে ফেনসিডিল ও এলকোহলযুক্ত হোমিওপ্যাটেন্ট ওষুধসহ নেশার উপকরণরূপে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কতিপয় হেলথ টনিক, ট্যাবলেট, সিরাপ ইত্যাদির উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৪ সালে আফিম এবং মদের বিকল্প সুরা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজার চাষ বন্ধ এবং ১৯৮৯ সালে সকল গাঁজার দোকান তুলে দেওয়া হয। কিন্তু মাদক বিভাগের সার্বিক দুর্বলতা, মাদক ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লোভ, মাদকচক্রের বাড়-বাড়ন্ত ও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে ফেনসিডিল, আফিম, গাঁজাসহ হরেক নেশাদ্রব্যের অবাধ বেচা-কেনা চলছেই।
গবেষক জানাচ্ছেন, ইউরোপীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, গত বছর মোট ৫৭টি নতুন মাদকদ্রব্য আবিষ্কার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে একটিরও বেশি নতুন পণ্য সরবরাহ পেয়েছে মাদকাসক্তরা। বাংলাদেশেও গবেষণা পরিচালনা করে পুরনো ও নতুন মিলিয়ে তিন ডজনের বেশি মাদকদ্রব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে।
গবেষক জানান, এ জনপদে কয়েকশ’ বছর আগে থেকেই মদ, তাড়ি, পাঁচুই, গাঁজা ইত্যাদির ব্যবহার ছিল। সাম্প্রতিক বছরে এমফিটামিনযুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট বিশেষ করে যৌন বিকার-প্রবণ মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয় মাদক হয়ে ওঠে। এছাড়াও অভিজাত পাড়ার চাইনিজ রেস্তোরাঁ, ম্যাসেস পার্লার, বিভিন্ন কেন্দ্র ইত্যাদিতে সীসা, পথশিশুদের ডান্ডি, ফেনসিডিলের বিকল্প দেশীয় কফের সিরাপ পিরিটন, ফেনারগ্যান ইত্যাদি মাদকের দেখা মেলে। ফেনসিডিলের বহুল ব্যবহৃত নাম ‘ডাইল’। কোমল পানীয়ের সাথে সিডাক্সিন, ইউনোকটিনের মতো ঘুমের ট্যাবলেট গুঁড়ো করে ‘মিকশ্চার’ তৈরি, টিকটিকির লেজ পুড়ে খাওয়া, ঘামে ভেজা মোজার পানি, জামবাক দিয়ে পাউরুটি খাওয়া ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে। আইন ফাঁকি দিতে এগুলো বেশ কার্যকর।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত হবে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যকে মাদক অভিহিত করলে নিশ্চয়ই তা কয়েক কোটি। ডিএনসি ২০০৩ সালেও বলতো দেশে ৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত এই মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা স্বীকার করে, দেশে ৬০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। মাদকদ্রব্যের প্রতি মারাত্মক আসক্তি ব্যক্তি জীবনে যেমন সর্বনাশ সৃষ্টি করছে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিকে স্থবির করে দিচ্ছে, বিঘ্নিত করছে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, মুদ্রা ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক জীবন।
গবেষক জানাচ্ছেন, মাদকাসক্তদের ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেকার শ্রেণী, ২৯ দশমিক ১৫ শতাংশ ব্যবসায়ী, ২২ দশমিক ৯১ শতাংশ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এবং ৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ পেশাদার আসক্ত। এছাড়া ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ মাদকাসক্ত ১৮ থেকে ৩২ বছর বয়সী। ২০০৫ সালে একজন মাদকাসক্তের দৈনিক নেশার খরচ ছিল গড়ে প্রায় ১৫০ টাকা। গত ৭/৮ বছরে মাদকদ্রব্যের তালিকায় নতুন নতুন দামি মাদক যোগ হওয়ায় নেশার খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। সহজলভ্যতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, কালো টাকার আধিক্য, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, হতাশা ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্তের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। রাজধানীর মাদকাসক্তদের ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ ও ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। মাদকাসক্তদের ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশই অবিবাহিত। যাদের ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ হয় ছাত্র, নতুবা বেকার। এক লাখেরও বেশি লোক প্রত্যক্ষভাবে অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও সরবরাহের সাথে জড়িত। এই সিন্ডিকেট চালাচ্ছে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীরা। মাদকচক্রকে সাহায্য করে অপরাধচক্র। আবার অপরাধচক্রকেও সাহায্য করে মাদকচক্র। এদের মধ্যে গড়ে উঠেছে স্বার্থের মধুচক্র। আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে মাদক বহন ও বিপণনে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক ব্যবহারজনিত ব্যয় বছরে ৫৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮শ’ টাকা। গড়ে দৈনিক মাদকের জন্য ব্যয় হয় ১৩০ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ১৯৪ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৭৮ টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য আটক করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মাদকের মধ্যে রয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২৪১ বোতল ফেনসিডিল, ২ লাখ ৬৩ হাজার ২৩৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট। ৭১ হাজার ৮১১ বোতল বিদেশি মদ, ১ হাজার ৯৩০ লিটার স্থানীয় মদ, ৪ হাজার ১০২ বোতল বিয়ার, ২ হাজার কেজির বেশি গাঁজা, ১২ কেজি ৫৫ গ্রাম হেরোইন এবং ১৩ হাজার ৬৮১টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন। এর চেয়ে বহু গুণ দেশের মধ্যে চলে আসতে সক্ষম হয়েছে।
গবেষণায় জানা যায়, আগের বছর, ৬ লাখ ৫ হাজার ৪৫৫ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৫২ লিটার বিদেশি মদ, ৭৬ হাজার ৬৭৯ লিটার দেশি মদ, ২২ হাজার ৬৩৪ লিটার বিয়ার, ৯ হাজার ৪৮২ কেজি হাশিস এবং ৩৩ কেজি ৩০২ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। গত অর্ধযুগে ফেনসিডিল আটকের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। ৫৪ হাজার ১শ’ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৪৩ হাজার ৭১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যাদের কেউই দৃষ্টান্তমূলক সাজা পায় নি। নেপথ্যের ক্ষমতাসীনরা এদের রক্ষা করেছে।
উল্লেখ্য, সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ২১০টি পপি গাছ, প্রায় ১৬০ কেজি হেরোইন, ১১ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৪ বোতল ফেনসিডিল, ২ হাজার ৯৫৫ লিটার ফেনসিডিল, প্রায় ৩২ হাজার ৯৫৬ কেজি গাঁজা, ৭৯১টি গাঁজা গাছ, ৮৯ হাজার ৪৬৯টি নেশার ইনজেকশন এবং ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। এতে সকল ধরনের মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের প্রবণতা স্পষ্ট হলেও সবচেয়ে উদ্বেগজনক হারে অর্থাৎ গত ৪ বছরে ১৫ গুণেরও বেশি বেড়েছে ইয়াবা চোরাচালান। তথ্যে এটা স্পষ্ট যে, বানের পানির মতো আসা মাদকদ্রব্যের মাত্র ৯ শতাংশ ধরা পড়ে। বাকিগুলো বিভিন্ন চেইনের মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়।
গবেষক জানাচ্ছেন, প্রতিদিন দেশে ভোগ্য-ব্যবহার্য মাদকের পেছনে অপচয় হচ্ছে প্রায় ২৮ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা যা জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশের বেশি। আটককৃত মাদক ধ্বংস, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিপুল জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা, মাদকসেবী বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের উৎপাদন ক্ষমতা বিনষ্ট ইত্যাদি বাবদ আরো হাজার হাজার কোটি টাকা ধ্বংস হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় এক বোতল ফেনসিডিল বিক্রি হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা। কিন্তু ঢাকায় তা বিক্রি হয় ৫ থেকে ৬শ’ টাকা। উৎসস্থলের দাম ধরে মাত্র এক বছরের জব্দকৃত বোতলজাত ফেনসিডিল বাবদ দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। জব্দকৃত হেরোইন বাবদ পাচার হয়েছে অন্তত: ১৫৮ কোটি টাকা। যার প্রকৃত মূল্য কয়েক গুণ বেশি।
গবেষণায় আরও জানা যায়, অভিজাত নেশাদ্রব্য হিসাবে পরিচিত ইয়াবার বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। তরুণ-যুবক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এ সুযোগে রাজধানীজুড়ে গড়ে উঠেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অপ্রতিরোধ্য নেটওয়ার্ক, যা নিয়ন্ত্রণ করছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। এরমধ্যে ‘ডিরেক্ট পার্টি’ নামে পরিচিত পাইকারি বিক্রেতার সংখ্যাই শতাধিক।
তথ্য মতে, নগরীতে প্রতিদিন দেড় থেকে ২ লাখ পিস ইয়াবা বিক্রি হয়। ক্রেতার একটি বড় অংশই বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝে মধ্যেই ধরা পড়ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। প্রচুর ইয়াবাও উদ্ধার হচ্ছে। ক্ষমতাসীন, আমলা-সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ক্লিনিক মালিক, চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তিও এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। ইয়াবা বাণিজ্যে রাজধানীতে দিনে অন্তত ৭ কোটি টাকা লেন-দেন হচ্ছে। আকারে ছোট বলে শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে বা ছোট হাত ব্যাগে সহজেই শত শত পিস ইয়াবা ট্যাবলেট বহন করা যায়। অন্যদিকে ফেনসিডিল বহনের জন্য যানবাহনের দরকার হয়। রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীরা এখন ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজার ব্যবসায় বেশি ঝুঁকছেন। তরুণ মাদকসেবীদের মধ্যে ইয়াবার চাহিদা সর্বাধিক। এটি সেবন করে আসক্ত ব্যক্তি সমাজ, পরিবার ও পরিচিতজনদের চোখে ফাঁকি দিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই চলাফেরা করতে পারেন। ফলে অভিজাত বা ভদ্রনেশা হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সর্বনাশা ইয়াবা।
গবেষকের মতে, সীমান্তে ইয়াবা কেনা থেকে শুরু করে রাজধানীতে পৌঁছাতে কাজ করছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সম্পন্ন সিন্ডিকেট। এর মধ্যে কয়েকটি স্তর রয়েছে। সীমান্তের চোরাচালানির কাছ থেকে পাইকারি বিক্রেতারা ইয়াবা কিনে আরেক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে হস্তান্তর করেন। তারা বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে নানা কৌশলে ইয়াবা ঢাকার পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছান। যাদের বলা হয় ‘ডিরেক্টর পার্টি’। পরে তাদের কাছ থেকে ইয়াবা বিপণন করা হয় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। রাজধানীর ইয়াবা ও মাদক ‘মহাজন’ চলতি ভাষায় ‘মামা’ নামে পরিচিত হলেও তাদের রয়েছে অসংখ্য সাগরেদ। ‘মামা’দের পরিচালনা করে ‘বড় মামা’। সবাই মিলে ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অতি কৌশলে। রাজধানীতে এখন চার রকমের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে গাঢ় লাল রঙের ‘চম্পা’ প্রতি পিস ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। সীমান্তে এটি কেনা হয় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। হালকা গোলাপী রঙের ‘আর সেভেন’ ইয়াবার দাম সবচেয়ে বেশি। এটি ঢাকায় কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ফিকে গোলাপী রঙের আরেক ধরনের ইয়াবার নাম ‘জেপি’। এর খুচরা মূল্য ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ‘ডগ’ নামের মাটি রঙের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এছাড়াও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে এক রকমের ভেজাল ইয়াবা। এগুলো ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়। বিশেষ কোনো উপলক্ষ্যে প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটের খুচরা দাম ১ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। ইয়াবা বেচা-কেনা বাবদ রাজধানীতে রোজ অন্তত ৭ কোটি টাকা হাত বদল হচ্ছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইয়াবার উৎস দেশ সীমান্তের ওপারে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
গবেষক জানাচ্ছেন, রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ী ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ইয়াবা সেবন কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। সেখানে ইয়াবা বিক্রির পাশাপাশি ‘ভিআইপি’ ক্রেতার জন্য সেবনের সুবন্দোবস্ত এবং বিভিন্ন যৌন উত্তেজনাকর ব্যবস্থা রাখা আছে। কিছু তথাকথিত ক্লিনিক এবং ক্লাবেও ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ী ইয়াবা বিক্রিতে সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করছেন। সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, পুলিশ এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিছু পরিচিত মুখও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে গেছেন প্রভাবশালীদের তদবিরে।
গবেষকের মতে, দেশে এক শ’ গডফাদার, শত শত সিন্ডিকেট, হাজার হাজার লোক জড়িত মাদক ব্যবসায়। যাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, আমলা, মাফিয়াসহ অনেকেই জড়িত। এমন কোন দিন নেই, যেদিন সীমান্ত পথে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ মাদকদ্রব্য ঢুকছে না। সীমান্তে অসংখ্য পয়েন্টে রয়েছে শত শত চোরাচালানি। মুষ্টিমেয় কিছু গডফাদার তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ লগ্নি করে। তারা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। মাঝেমধ্যে মাদকসহ আটক হয় চুনোপুঁটি চোরাচালানি।
গবেষণার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে একশ্রেণীর যুবসমাজ ও মাদকসেবীর কাছে ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদার কারণে আসলের পাশাপাশি নকল ফেনসিডিল তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে নকল ফেনসিডিল বানানো হয়। চিটা গুড় গুলিয়ে তাতে নেশার ট্যাবলেট মিশিয়ে নকল ও ভেজাল ফেনসিডিল তৈরি করে প্যাকিং ও রিপ্যাকিং করে পাঠানো হচ্ছে এপারে। দেশের অন্যান্য সীমান্তের চেয়ে কলকাতা নিকটবর্তী হওয়ায় তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তপথে ভারত থেকে ফেনসিডিল ঢোকে বেশী। সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া এই ৬টি সীমান্ত জেলার শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ঢুকছে। কক্সবাজার, টেকনাফ নিয়েও মায়ানমার থেকে মাদক আসছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাসে, ট্রাকে, প্রাইভেট কারে ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন বাহনে এবং বিভিন্ন পন্থায় সর্বনাশা ইয়াবা ও ফেনসিডিল পৌঁছে যাচ্ছে যশোর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নগর, শহর এমনকি গ্রাম এলাকার বড় হাট-বাজারে। সবজি, বই, গ্যাস সিলিন্ডার, ট্রাকের চেসিজে, প্রাইভেট কারের সিটের নীচে লুকিয়েসহ অভিনব পন্থায় মাদক চালান হচ্ছে একস্থান থেকে আরেক স্থানে। আসলেই দেশে মাদকের ভয়াল থাবা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সীমান্তে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪ লাখ বোতল ফেনসিডিল আটক হয় বিভিন্ন সংস্থার হাতে। যার আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকা। সাধারণত চোরাচালানের সর্বোচ্চ ১০ ভাগ আটক হয়। বাকি দ্রব্য মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছে যায়।
পত্রিকার রিপোর্টে আরও লেখা হয়েছে, মাদকের বিরুদ্ধে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক সিন্ডিকেটের আক্রমণের শিকার হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। তিনি এখন অজ্ঞাত স্থান থেকে তার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে, গবেষকের কাছে মাদক সিন্ডিকেটের তথ্য রয়েছে। তিনি সেগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শামীম রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। আমাকে আক্রমণ করে যে ওরাও অক্ষত নেই, সেটা এবার টের পাবে। শক্তিশালী পক্ষ যখন দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছ থেকে প্রচণ্ড আঘাত পায়, তখন বিচলিত হয়ে যায় কিংবা বড় রকমের ভুল করে। মনে মনে এনামুলের চেহারা কল্পনা করি। নিশ্চয় এ রিপোর্টের পর তার মুখের অবস্থা স্বাভাবিক থাকবে না। যথেষ্ট খেলেছো। এবার তোমার পালা।
যতদ্রুত সম্ভব আমাকে আবার ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। অবতীর্ণ হতে হবে পুরনো রণাঙ্গনের সরাসরি সমর-যুদ্ধে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৭
জেডএম/