ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: পর্ব ঊনচল্লিশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৭
নীল উড়াল: পর্ব ঊনচল্লিশ নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩৯.
একটি গাড়ির কাছে কত অসহায় একটি কবিতা। বোঝা যায় সন্ধ্যার ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ালে।

প্রতি মিনিটে সেখানে একটি করে গাড়ি সুগন্ধি রুমালের মতো উড়ে আসে। ধারালো ছুরির মতো একে-ওকে ডিঙায়। সন্ধ্যায় যখন পথের ডিভাইডারে ফুটে ওঠে সিগন্যাল-সদৃশ্য কৃষ্ণচূড়া ফুল, পেছন থেকে ডাকে মরা বুড়িগঙ্গার বাতাস। উজ্জ্বল গাড়ির ঢল রাস্তায়। স্থাণুবৎ সেখানে জীবন ও কবিতা।

এয়ারপোর্টের পথে যেতে যেতে আমার মনে হলো, কত অবহায় জীবন, স্বদেশের সুমৃত্তিকা থেকে পালাচ্ছে রাতের উড়ালে। পালানোর বা চলে যাওয়ার সঙ্গে নৈঃশব্দের এক ধরনের সাযুজ্য আছে। অথচ আমার চলে যাওয়া পথের ধুলিগুলোও মুখর।

নীরবতা ঢাকা শহরে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের একটি। পৃথিবীর যে কোনও শহরের ল্যান্ডস্কেপের মতো নিজস্ব একটি সাউন্ডস্কেপ আছে। ঢাকার শব্দপুঞ্জের সঙ্গে কলকাতার শব্দমালা মিলবে না। নিউইয়র্কের সঙ্গে কায়রো শহরে সৃষ্ট ধ্বনি ও শব্দ তরঙ্গের আকাশ-পাতাল প্রভেদ। শৈশবের ঢাকায় প্রকৃতির দখলে ছিল শব্দ। গাছেদের কানাকানি। পাখি-পাখালির কলরব। এখন সেই সাউন্ডস্কেপ উধাও। যন্ত্র-যান-মানুষের শব্দ সমরে নরক গুলজার! মানুষ মনে হচ্ছে শব্দ সংক্রান্ত স্পর্শকাতরতাও ভুলে যাচ্ছে। ভোঁতা হয়ে গেছে শ্রবণ-ইন্দ্রিয়। নৈঃশব্দে দাঁড়ানোর মতো একখণ্ড নীরবতা কোথাও নেই এই ঢাকায়। অথচ উনিশ শতকের বিখ্যাত সংগীতস্রষ্টা গুস্তাফ মাহলার (১৮৬০-১৯১১) নাকি চূড়ান্ত নীরবতায় সুর সৃজন করতেন। তার জন্য অস্ট্রিয়া শহরের প্রান্তে প্রকৃতির গভীর ভিতরে চলে যেতেন। এমন কি, কোনও খামারবাড়ির গরুর গলায় ঘণ্টা বাঁধা থাকলে সেটিও নাকি খুলে নিতেন যাতে অত্যল্প শব্দও তাঁর কাজের কোনও ক্ষতি করতে না পারে। একবিংশ শতাব্দীর সাউন্ডস্কেপে কোনও সুরস্রষ্টা নিজেকে স্তব্ধতায় গুটিয়ে নিয়ে মগ্ন রয়েছেন সাধনায়, এমনটি ভাবতেও যেন অবিশ্বাস্য লাগে। ঢাকায় আগে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এখন কল্পনাতীত ব্যাপার।

নীল উড়াল: পর্ব আটত্রিশ

শব্দজটের শরীরে মাখা সন্ধ্যার অন্ধকার ভেঙে নীরব পদক্ষেপে গাড়িতে উঠে বসেছি আমরা। নিঃশব্দে গাড়ি চলছে। আমি আর মার্গারেট পেছনের সিটে। সামনে তানিয়া। ঢাকার রক্তিম আকাশের সঙ্গে অব্যক্ত লড়াইয়ে নেমেছে রাতের আঁধার। নিওন সাইনের আলোতেও কাটছে না অন্ধ-অন্ধকার। আমি মার্গারেটের দিকে তাকালাম। প্রদোষের মায়াবী আলো-আঁধারিতে তার মুখ ম্লান। মনে হচ্ছে, এই শহরে, এই গলিপথ, এভিনিউ ধরে, বহুদূর, বহুপথ, হেঁটেছি একসাথে। তুমি। আমি। নগরের প্রতিটি মুখের ভিতর তোমার হাসি ডানা ঝাপটায়। প্রতিটি বিলবোর্ড ছুঁয়ে ঝরে পড়ে তোমার ছায়া। প্রতিটি সড়কদ্বীপে তোমার মতো বসে থাকে ‘শান্তির ধ্যানী হাওয়া’। প্রতিটি বাঁকে তোমার আবছায়া ঘিরে ফেলে আমাকে। অসীম নৈকট্যে আমাকে স্পর্শ করে তোমার অনঙ্গ আনন্দ।

আমি ধীর ধীরে হাত বাড়িয়ে মার্গারেটের করতল স্পর্শ করতে চেষ্টা করি। সে হাত টেনে নেয় নিজের কাছে। ‘না, স্পর্শ করো না! আমি সহ্য করতে পারবো না। ’ মার্গারেট বিড়বিড়িয়ে বলে। ‘তুমি স্পর্শের বদলে ছুঁয়ে যাও, শুধু ছুঁয়ে যাও...। ’ পুষ্প-পাপড়ির মতো ওর দু’টি গোলাপি ঠোঁট আমাকে গভীরে-গহীনে ছুঁয়ে যায়। আমরা স্পর্শাতীত নিবিড়তায় আমাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই।

মার্গারেটের ছোঁয়ায় ছুঁয়ে যাচ্ছি নিজের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ। এই শহরে, প্রিয় শহরে, স্বদেশে আর আসা হবে কিনা জানি না! এই কি শেষ যাওয়া, না ফিরে আসা, কে জানে? আমার ভিতরে তুমুল ঝড়। শেকড়-ছেঁড়া বিটপীর মতো টলোমলো আমি, আমি আমার অস্তিত্বকে আগলে রাখতে পারছি না।
অকস্মাৎ আমার অস্তিত্বের গভীরে শক্ত টান অনুভূত হলো। আমি গাড়ি থামাতে বলি।

মার্গারেট আঁতকে ওঠে:
-কি করছো? নেমো না। তোমার চারপাশে শত্রুর হানা।
আমি বলি:
-আমি যদি না নামি, তবে চিরদিন কাপুরুষ থেকে যাবো। আমি কাপুরুষের কলঙ্কের চেয়ের শত্রুর হাতকে প্রিয় মনে করি।

মার্গারেট বুঝতে পারে, আমি এক ঘোরাক্রান্ত মানুষ, যে নিজের পথ থেকে সরে আসবে না। মার্গারেট আলতো করে আমার কপালে চুমু খেয়ে বলে:
-আমি কি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো?
আমি অসম্মতি জানিয়ে বলি:
-না, এটা আমার একার লড়াই। আমি একাকী লড়বো। তোমার অপেক্ষা আমার জীবনের সমান দীর্ঘ। তুমি আছো আমার জীবনের সমান্তরাল।

আমি নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকার গলি পথে ঢুকে যাই। জানি, আমার কোনও নির্দিষ্ট শোক নেই; গতিপথ নেই; অভিমুখ নেই। ফিরে যাওয়া ছাড়া এগুনোর সব পথ আপাতত বন্ধ। নিজের কাছেই যাকে মাঝে মাঝে ফিউজিটিভ মনে হয়, তার নিজস্ব কোনও শোক ও পথ থাকে না। তাহলে কি অভিমান থাকে? তা-ও আমি স্পষ্ট জানি না। যাপিত জীবনের পুরোটা অস্তিত্ব ছুঁয়ে ফোঁটা ফোঁটা গলিত জোছনার মতো কষ্ট ঝরে পড়ে। দিকশূন্যপুরের দিগন্ত জুড়ে উদ্বাহু ছুটোছুটি করে দুঃখেরা। রাঙামাটির বনভূমির আলতো চুমো আমার বিস্মৃতি বাড়ায়। পাহাড়ি টিলার আবছায়া ভুবনের পলাতক স্মৃতি পেরিয়ে হিম সন্ধ্যার মহুয়া স্খলিত দুঃখে-কষ্টে ঢাকার ফুটপাতে অন্য ভুবনের অচেনা মানুষের মতো আমি হেঁটে যাই। ভাবি, এভাবে কি চলে যেতে হয়? এভাবেই বুঝি কাউকে কাউকে চলে যেতে হয়!  জীবনের তৃষ্ণা নিঃশঙ্কে চেটেপুটে নিয়ে উৎসবের ঝরনায় ভেসে যাওয়া স্মৃতির শহরে আসি হাঁটছি দীর্ঘ ছায়া রেখে, নির্লিপ্ত ফিরে যাওয়ার পথে। আমাকে অনুসরণ করে দ্রাঘিমার মেঘকালো দীর্ঘশ্বাস। মাথার উপর অন্ধকার আকাশ। হেঁটে ফিরছি সেই বাড়ি, যাকে ফেলে যেতে হবে। ভিতরে প্রবল ঝড়ো মুহূর্ত। মাথার উপর কি পড়ল একটি জলের ফোঁটা? কিছু ভাবার আগেই দ্বিতীয় ফোঁটাটিও পড়লো বুঝি! একেবারে নাকের ডগায়। দুঃখের প্রপাতে কেমন অনাস্বাদিত সুখানুভূতিতে মনে হচ্ছে ভালোবাসার হাসিতে আঁধারজয়ী অরুণালোক ছড়িয়ে দিল মার্গারেট। পেছনের পথে ওর গাড়ি চলে গেছে বহুদূর। আহা! বড় ভুল হয়ে গেলো ! ওকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয় নি। যত বারই দেখা হয়েছে, ভেবেছি, বলবো। বলা হয় নি। এখন মার্গারেটের চলে যাওয়া স্মৃতিমাখা পথের দিকচিহ্ণহীনতার দিকে তাকিয়ে আমার মধ্যে সেই কথা গুঞ্জরিত হচ্ছে:
        আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
        বলে দেব স্ট্রেটকাট: ‘ভালোবাসি’।
        এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
        অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
        আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
        তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
        দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাঁচে
        দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।
        এরকম উন্মোচনে যদি তুমি অনুরাগে মূর্ছা যেতে চাও
        মূর্ছা যাবে, জাগাবো না, নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।
        ‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।