তাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাজধানীর কাঁটাবনে বইঘর দীপনপুরের দীপনতলায় ঐহিক বাংলাদেশ আয়োজন করে ‘কবির সঙ্গে’ শীর্ষক আলাপন। যাতে ফরিদ কবির মনের দুয়ার খুলে গল্প করেন।
ফরিদ কবিরের কবিতা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বলেন বাংলানিউজের সম্পাদক কবি জুয়েল মাজহার, পশ্চিমবঙ্গের কবি সুব্রত সরকার, কবি চঞ্চল আশরাফ, নজরুলসঙ্গীত শিল্পী সুজিত মোস্তফা ও কবি শোয়াইব জিবরান৷স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঐহিকের সম্পাদক তমাল রায়।
ফরিদ কবির বলেন, অনেকেই বলেন একজন কবি দায়বদ্ধতা থেকে লেখেন। আমি সেটা মনে করি না। একজন কবির কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। যেহেতু সে একটি সমাজে বাস করে, সেহেতু সেখানকার রসায়ন তার লেখার মধ্যে থাকে।
তিনি বলেন, আমি বিষয়ভিত্তিক কবিতা লেখি না। বলতে গেলে, লিখতে পারিনা। আমার মনে যা আসে, তাই লিখি। যে কথা মুখে বলি না, মনে থাকে, সেটাই আমার মাঝে কবিতা। আমি মনে করি, কবির কাজ ইশারা দেওয়া। একজন পাঠক সেখান থেকে নিজের মতো করে অর্থ খুঁজে নেবেন।
‘সত্যবচন’ শিরোনামের পর্বে ফরিদ কবির বলেন, আমার জীবনে আত্মীয়-স্বজনদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। জন্ম দেওয়ার কারণে আমার বাবা-মায়ের কিছু ভূমিকা রয়েছে। বাকি যা ভূমিকা সব পালন করেছেন আমার বন্ধুরা। এই ফাঁকে আমি একটা কথা বলতে চাই, আমার মতে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ সে তার বাবা-মা, দেশ পছন্দ করে নিতে পারেনা। তবে এ নিয়েও আমার দুঃখ নেই। আমি যে ভাষায় কথা বলি, কবিতা লেখার চেষ্টা করি সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাষা।
আলাপনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ছিল ফরিদ কবির সম্পর্কে তার স্ত্রী ঝর্ণা ইয়াসমিনের কথা। শুরুতেই তিনি বললেন, লোকটা মন্দের ভালো। এর পর তিনি বললেন তাদের বিয়ের গল্প।
‘আমি কখনই ওকে বিয়ে করার কথা ভাবিনি। ও ছিল আমার বোন নাসরীন জাহানের বন্ধু। সে সুবাদে পরিচয়। ও একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করত। সে প্রেম ব্যর্থ হওয়ার পর আমি ওর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করি। এ সময় ওর কিছু বন্ধু বলে, “পাত্রী দেখার দরকার কি? ঘটকই পাত্রী”। এর পর থেকেই আমার প্রতি ওর দৃষ্টি পরিবর্তন হয়। এক সময় বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমিও কিছু সময় নিয়ে রাজি হয়ে যায়। এর পর তো কেটে গেলো ২৭ বছর। ’
এ সময় দর্শক সারি থেকে প্রশ্ন আসে- বিয়ের আগে একে অপরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন তারা, তুই থেকে তুমি কবে হলো-মিষ্টি করে হেসে ঝর্ণা বললেন, বিয়ের পরও তুই করেই বলতাম। আমার শাশুড়ি মানা করার পর তুমি করে বলা শুরু করি। প্রথম দিকে মনে হতো আমি আমার স্বামীর সঙ্গে নয়, ভাসুরের সঙ্গে কথা বলছি।
এ সময় নিজের প্রেম নিয়ে কথা বলেন ফরিদ কবির। বললেন, ‘আমি আসলে কথা সুন্দর করে বলতাম। এর জন্য আমার শতাধিক প্রেম হয়েছে। যার দুইটি বাদে সবগুলোই একপাক্ষিক। মেয়েরা আমার কথা শুনে কাছে এলেও, পয়সা না থাকার কারণে চলে যেত। কারণ, আমি আমার সব প্রেমিকাদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম। এখনও অনেকের টাকা শোধ করিনি। ’
জুয়েল মাজহার বলেন, আমাদের সময়ের কবিদের মধ্যে ওপরের দিকে ফরিদ কবিরের নাম থাকবে। এটা আমি কোনো প্রীতিবোধ থেকে বলছি না। শুধু এই বাংলায় নয়, দুই বাংলায় বর্তমান সময়ে যারা কবিতা লেখেন তাদের মধ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি। আশির দশকে কিছু তরুণ উচ্চকণ্ঠের কবিতা থেকে বাংলা কবিতাকে তার শিল্প, আঙ্গিকের জায়গায় ফিরিয়ে আনার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন ফরিদ কবির তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি আরও বলেন, ফরিদ কবির মনচোর। তার সান্নিধ্যে যিনিই এসেছেন, তাদেরই মন জয় করেছেন। তিনি এক জাদুকর। তার শরীর যেন অলৌকিক চুম্বকের। সবাইকে লোহা বানিয়ে তার কাছে নিয়ে আসেন। পরিচয়ের পর থেকেই আমি ফরিদ কবিরের সঙ্গে, ফরিদ কবির আমার সঙ্গে ‘আইকা’র মতো লেগে আছে। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট রয়েছে।
ফরিদ কবিরের প্রতি অনুযোগ নিয়ে তিনি বলেন, তার লেখা অতি বেশি আধুনকি ও ইউরোপীয় ছাপ রয়েছে-এটা আমার অনুযোগ। তিনি আরো অনেক লিখতে পারতেন। আলস্যমুক্ত হয়ে লিখলে তার হাত থেকে সোনা ঝরবে। সুব্রত সরকার বলেন, ফরিদ কবির মানুষের সঙ্গে অবলীলায় মেশেন। যার প্রভাব তার কবিতায় রয়েছে। সে যেমন মানুষকে সম্মোহন করে রাখেন, তেমনি তার কবিতার মাঝেও সম্মোহনী শক্তি রয়েছে।
চঞ্চল আশরাফ বলেন, ফরিদ কবির আশির দশকের গুরত্বপূর্ণ এবং অগ্রগণ্য কবি। স্বাধীনতার পর বাংলা কবিতার যে চিত্র ছিল, সেখান থেকে ফরিদ কবির স্বতন্ত্র কাব্যধারা তৈরি করেছিলেন।
ফরিদ কবিরের সহপাঠী নজরুলসঙ্গীত শিল্পী সুজিত মোস্তফা বলেন, ফরিদের মতো বন্ধু পাওয়া আনন্দের এবং গর্বের। সে মেয়েদের তো বটেই যেকোনো মানুষকে দ্রুত আকর্ষণ করতে পারে।
শোয়াইব জিবরান বলেন, ফরিদ কবির এমন এক সময় কবিতাচর্চা শুরু করেছিলেন, যখন তার সামনে ছিল ’৭০ দশকের কবিতা। সে সময়কার কবিতা ছিল স্লোগাননির্ভর, অন্তর্মুখী না। আশির দশকে যখন লিটলম্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদল হয়েছিল, তিনি সে সময় কবিতা লেখেন এবং বাঁকবদলে ভূমিকা রাখেন। সত্তরের কণ্ঠস্বর এবং আশির অন্তর্মুখীতাকে ধারণ করে তিনি কবিতা লেখেন।
সবশেষে ছিল কবি ফরিদ কবিরের স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ৷ তিনি একে একে নিজের বিভিন্ন বই থেকে কবিতা পাঠ করেন। সে সঙ্গে নিজের কবিতার বাঁকবদলের কথাও শোনান। তার পাঠ করা কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘কার জন্য যুদ্ধে যাবে’, ‘এখন রাস্তাতে এখন ছায়াতে’, ‘বাড়ি’, ‘দেয়াল বন্ধুরা’, ‘তত্ত্বদেহকথা’, ‘ডিমেন জগত’, ‘আয়না’, ‘সাপলুডু’ ইত্যাদি।
এর আগে ঐহিক বাংলাদেশের সম্পাদক মেঘ অদিতির বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ঐহিক বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ক নানা পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়নের কথা তিনি এ সময় বলেন। এরপর অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা শুরু করেন স্নিগ্ধা বাউল।
অনুষ্ঠানের পুরো সময় বসে নিজের বাবা ফরিদ কবির ও তার বন্ধু-সুহৃদদের আলাপন শোনেন কবি তনয়া মুগ্ধ চন্দ্রিকা।
অনুষ্ঠানটি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ফরিদ কবিরের গুণমুগ্ধ কবি-সাহিত্যিকদের আগমনে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক নাসরিন জাহান, কবি আশরাফ আহমেদ, কবি মাহবুব কবির, কবি সাখাওয়াত টিপু, কবি সঞ্জীব পুরোহিত, কবি সুমী সিকানদার, কবি মাহবুবা ফারুক, শিশু সাহিত্যিক ও প্রকাশক হুমায়ূন কবীর ঢালী, কবি-সাংবাদিক শিমুল সালাহ্উদ্দিন, কবি হিজল জোবায়ের, কবি নভেরা হোসেন, কবি বিধান সাহা, কবি রণজিৎ দাস, কবি নুরেন দূর্দানী প্রমুখ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কবি গৌতম গুহরায় ও অভিযান পাবলিশার্সের কর্ণধার কবি মারুফ হোসেন।
বাংলাদেশ সময় ০০৩৩ ঘন্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
ডিএন/এমএমএস/টিএ