অভিযোগ রয়েছে- দেশের একমাত্র নারী নীলগাইটির মৃত্যুর পেছনে রয়েছে উদ্যানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিনের হাত। তার দায়িত্বহীনতায় মারা গেছে নারী নীলগাই।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পটুয়া গ্রামে দেখা মেলে বিলুপ্তপ্রায় ১টি নারী নীলগাইয়ের। এলাকাবাসী বনগরু সন্দেহে ধাওয়া করে। এলাকাবাসীর ধাওয়া আতঙ্কিত হয়ে নারী নীলগাইটি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা ও রানীশংকৈল উপজেলার মধ্যবর্তী ভারতীয় সীমান্তের কুলিক নদীর পানিতে লাফ দেয়। স্থানীয়রা কুলিক নদী থেকে নারী নীলগাইটি উদ্ধার করে আটক করে রাখে। এসময় নারী নীলগাইয়ের দৌড়াদৌড়িতে বুধু মন্ডল ও মকবুল হোসেন নামে ২ জন আহত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে নিয়ে আসা হয় নারী নীলগাইটিকে। উদ্ধারের সময় নারী নীলগাইটির পেটে ১টি বাচ্চা ছিল বলে রামসাগর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এর কিছুদিন পরে রামসাগরে ১টি মরা বাচ্চা জন্ম দেয় নারী নীলগাইটি। সে সময় রামসাগর কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- ঠাকুরগাঁওয়ে উদ্ধারের সময় এলাকাবাসীর আঘাতে পেটের ভেতর বাচ্চাটি মারা যায়।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি সব নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার জোতবাজারে ১টি পুরুষ নীলগাই আটক করে স্থানীয়রা। সে সময় স্থানীয়রা সাংবাদিকদের জানান- কিছু দুষ্কৃতিকারী একটি বড় ট্রাকে গরুর সঙ্গে নীলগাই পাচার করে নিয়ে যাচ্ছিলো। জোতবাজারে পৌঁছালে পুরুষ নীলগাইটি গাড়ি থেকে লাফিয়ে পাকা রাস্তায় পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ওই দিন রাজশাহী সিটি করপোরেশন দ্বারা পরিচালিত রাজশাহী বন্যপ্রাণী ও পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। নওগাঁয় পুরুষ নীলগাই উদ্ধারের খবরে দিনাজপুরে আশার সঞ্চার ঘটে যে, বিলুপ্তপ্রায় নীলগাইয়ের বংশ বিস্তার করা সম্ভব হবে। প্রায় ১৭দিন রাজশাহীতে চিকিৎসা নিয়ে চলতি বছর ৮ ফেব্রæয়ারি দিবাগত রাতে রাজশাহী থেকে পুরুষ নীলগাইটিকে দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে নিয়ে আসা হয়। রামসাগরের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন রাজশাহী গিয়ে নীলগাইটিকে নিয়ে আসেন। আগে থেকে রামসাগরে রাখা নারী নীলগাই ও পুরুষ নীলগাইটির জন্য তৈরি করা হয় কৃত্রিম বন।
সঙ্গী পাওয়ার প্রায় ১ মাস ৮দিন পর চলতি বছরের ১৬ মার্চ বিকেলে রামসাগরের কৃত্রিম বনে দৌড়াদৌড়ি করার সময় ঘেরা দেওয়া নেটের ভেতর আটকে মারা যায় দেশের একমাত্র নারী নীলগাইটি। অভিযোগ রয়েছে- দৌড়াদৌড়ি করার সময় নেটের ভেতরে আটকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা থাকলেও রামসাগর কর্তৃক তা দেখেনি। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার পর মরা অবস্থায় নেটের ভেতর আটকে থাকা নারী নীলগাইটি উদ্ধার করা হয়। ওই দিন রাত প্রায় ১০টার দিকে দিনাজপুরের সাংবাদিকদের জানানো হয় নারী নীলগাইটি মারা গেছে।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার নিমইল ইউনিয়নের কালুপাড়া সীমান্তে অপর ১টি পুরুষ নীলগাইটি উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। পরদিন ২ এপ্রিল রামসাগরের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা গিয়ে পুরুষ নীলগাইটি নিয়ে আসেন। রামসাগরের কৃত্রিম বনে এক সঙ্গে রাখা হয় ২টি বিলুপ্তপ্রায় পুরুষ নীলগাইকে।
পরবর্তীতে চলতি বছরের ১৯ মে রামসাগরে রাখা ২টি পুরুষ নীলগাইয়ের মধ্যে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার জোতবাজার থেকে উদ্ধার হওয়া নীলগাইটি মারা যায়। পুরুষ নীলগাই মারা গেছে অথচ কাউকে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকী দিনাজপুরের সাংবাদিকদেরও না। রাতের আধারে ময়নাতদন্ত করে রামসাগরের জঙ্গলে পুতে ফেলা হয় পুরুষ নীলগাইটিকে।
সরেজমিনে রামসাগর জাতীয় উদ্যানের নীলগাইয়ের জন্য তৈরি করা কৃত্রিম বনে গিয়ে দেখা গেছে, নীলগাইয়ের রাখার স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে চিত্রাহরিণ। এর এক কোণে চুপ করে বসে রয়েছে দেশের একমাত্র পুরুষ নীলগাই। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন পুরুষ নীলগাইটি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় এটিও মারা যেতে পারে।
এ বিষয়ে রামসাগর জাতীয় উদ্যানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন বাংলানিউজকে জানান, দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো পশুসার্জন নেই। তাই এখানে কোনো পশু আহত হলে বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে বাইর থেকে ভালো পশু সার্জন নিয়ে আসতে হয়।
নীলগাইয়ের মৃত্যুর পর দিনাজপুরের সাংবাদিকদের জানানো হয়নি কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি আব্দুস সালাম তুহিন।
দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জার ইনচার্জ সাদেকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিনের আমলে ২টি নীলগাই মারা গেছে। বর্তমানে ১টি পুরুষ নীলগাই রামসাগর জাতীয় উদ্যানে রয়েছে। দিনাজপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে পুরুষ নীলগাইটি চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষে পুরুষ নীলগাইটির ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে কোনো পশু সার্জন নেই। তাই পুরুষ নীলগাইটিকে এখানে রাখা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি আমরা।
কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা যাওয়া ২ নীলগাইয়ের ময়না তদন্তকারী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহিনুর ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ১৬ মার্চ বিকেলে প্রথমে নারী নীলগাইটি রামসাগরে মারা যায়। আকষ্মিকভাবে দৌড়াদৌড়ি করার ফলে নেটের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেখানে মারা গেছে। পরবর্তীতে ১৯ মে রামসাগরে ২টি পুরুষ নীলগাইয়ের ১টি মারা যায়। প্রচণ্ড গরমের কারণে ক্রোমাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২২ জানুয়ারি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার জোতবাজারে ট্রাক থেকে লাফ দেওয়ার ফলে আগে থেকেই অসুস্থ্য ছিল মারা যাওয়া পুরুষ নীলগাইটি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
এসএইচ