পঞ্চগড়: ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। /পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
সময়ের সাথে সাথে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে এক বিরূপ প্রভাব পড়েছে পঞ্চগড়ের ছোট-বড় প্রায় ৫০টি নদীর ওপর। পানির অভাবে বিলীনের পথে আজ নদীগুলো। জেলায় পানির স্তর কমে যাওয়ার পাশাপাশি নদীগুলোতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে আসায় পঞ্চগড়ের করতোয়া, তালমা, মহানন্দাসহ সব কটি নদী শুকিয়ে এখন খালে পরিণত হয়েছে।
নদীগুলোতে পানি স্বল্পতার কারণে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নদীনির্ভর কৃষক ও শ্রমিকদের। একইসঙ্গে মাছসহ জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকিতে পড়েছে নদীর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুগুলো। আর ভরাট নদীর চরকে কৃষি জমি হিসেবে ব্যবহার করছে স্থানীয় নিম্নআয়ের মানুষরা।
স্থানীয়রা বলছেন, ভরা বর্ষা মৌসুমে পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদীতে হাঁটুপানি থাকে। বর্তমানে নদীগুলো দেখে মনে হচ্ছে, শীর্ণকায় এক একটি খাল। জেলার অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে হওয়ায়, ভারত তাদের অভ্যন্তরে দেওয়া বাঁধসহ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে নদীর পানি নিজস্ব সেচ কাজে ব্যবহার করায় নদীগুলোতে ভরা মৌসুমে পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।
জেলা শহরের করতোয়া নদীর চরে ধান চাষ করা কামরুল ইসলাম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একসময় নদীতে প্রচুর পরিমাণ পানি দেখা যেত। তবে দিন যতই যাচ্ছে পানিশূন্য হয়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে নদী। তাই আবাদের নিজস্ব জমি না থাকায় পড়ে থাকা নদীর চরে ধান চাষ করে পরিবার চালাচ্ছি।
অন্যদিকে নদী থেকে নুড়ি পাথর সংগ্রহে আসা মোস্তফা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নদীতে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় বর্তমানে পাথর পাওয়া যায় না। এতে চরম সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাদের।
তালমা নদীতে মাছ ধরতে আসা বৃদ্ধ হোসেন আলী বাংলানিউজকে বলেন, জীবনের একটা বড় সময় নদীতে বিলিয়ে দিয়েছি। এই করতোয়া নদীতে একসময় প্রচুর মাছ শিকার করতাম। বর্তমানে উজানে বাঁধের কারণে আর নদীতে পানিও নেই, মাছও নেই। এই কাজ করে এখন আর সংসার চালানো যায় না।
এদিকে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, ভারতের অভ্যন্তরে নদীর বাঁধ নির্মাণসহ খননে পরিকল্পনার অভাব থাকাসহ দখল-দূষণ, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিলীন হচ্ছে নদীগুলো। এতে পরিবেশের ওপরেও নানা প্রভাব পড়ছে। তাই জেলার সব নদী রক্ষায় সরকারিভাবে স্থায়ী সমাধান বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাণ, প্রকৃতি পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা এবং কারিগরের নির্বাহী পরিচালক সরকার হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এতে এলাকায় মরুকরণসহ কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা না গেলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।
এদিকে পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোষ বর্মন বাংলানিউজকে বলেন, জেলার অধিকাংশ নদী ভারত থেকে এসেছে। আর ভারতীয় উজান থেকে নদীর পানির সাথে আসা পলির কারণে নদীগুলো ভরাট হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভরাট নদী পুনঃ খননসহ নদীগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৬ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫০ টাকা ব্যয়ে জেলার ১৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পূর্ণ খনন করা হয়। এদিকে গত এক দশক ধরে এভাবে প্রবাহ কমতে থাকা নদীগুলো খননে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে নতুন করে জেলার ছয়টি নদীর দৈর্ঘ্যে ২০ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলছে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫
এএটি