কিন্তু কী কারণে একেকটি তক্ষকের মূল্য এত! এর কারণ অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞরা জানান, মূলত মহাবিপন্ন বা বিপন্ন প্রাণীদের অতি উচ্চমূল্যে বিক্রির দূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই অবৈধভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে এসব প্রাণী। আর প্রাণীগুলো সংগ্রহ করছে চীন।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছর ১৪টি তক্ষক আমরা উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছি। চলতি বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪টি তক্ষক আটক করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। ৩০ মে টঙ্গীবাজার থেকে ১টি, ৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে ৪টি, ১৭ সেপ্টেম্বর শরণখোলা থেকে ১টি, ১০ অক্টোবর বগুড়ার শেরপুর উপজেলা থেকে ৫টি, ২ অক্টোবর পাবনার চাটমোহর থেকে ৩টি উদ্ধার করা হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক ড. কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, এর দু’রকম কারণ রয়েছে। আমি কয়েকদিন আগে ভারতে সরীসৃপ প্রাণীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় যোগদান করেছিলাম। ওরাও সমস্যার মধ্যে রয়েছে। প্রায়ই তাদেরও বিভিন্ন জায়গা থেকে তক্ষক ধরা পড়ে। এগুলোর মূল হোতা হচ্ছে চায়না। চায়নাতে ওরা যেটা করে তাহলো এক. মেডিশনাল কাজে ব্যবহার করে এবং দুই. বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণ ও প্রজনন। অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের বিপন্ন বন্যপ্রাণীগুলোকে টাকার বিনিময়ে ধরে নিয়ে যায়।
‘মনে করেন কোনো প্রজাতি পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন হয়ে পড়লো। আর সেগুলোর খবর যখন পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তখন ওরা ওই প্রাণীটাকে টার্গেট করে সংগ্রহ করে তাদের প্রজননকেন্দ্রে নিয়ে রাখে। এর উদ্দেশ্যই হলো যখন আমাদের এ অঞ্চল থেকে এই প্রাণীগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে তখন ওরা সেগুলো উচ্চমূল্যে আবার বিক্রি করতে পারবে। এটা শুধু তক্ষকের ক্ষেত্রেই না। অন্য বিরল প্রাণীর ক্ষেত্রেও। ’
উদাহরণ টেনে ড. কামরুল হাসান বলেন, যেমন ধরেন- প্যাঙ্গোলিন (বনরুই)। এটি পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন প্রাণী। চায়না এই প্যাঙ্গোলিনগুলো আফ্রিকা, ভারতসহ আমাদের দেশ থেকে সমানে অবৈধভাবে সংগ্রহ করছে। আমাদের দেশ থেকে প্যাঙ্গোলিন যখন চিরতরে শেষ হয়ে যাবে তখন ওরা তাদের কাছে পাঁচগুণ-দশগুণ দামে বিক্রি করবে। এটা চায়নার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
তক্ষকের ওষুধি গুণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এর মেডিশনাল ভ্যালু (ওষুধি গুণাগুণ) তেমন নেই, কিন্তু আমাদের দেশ বা ইন্ডিয়াতেও একটা ‘রিউমার’ (গুজব) আছে যে, একেকটা তক্ষক কোটি টাকা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই কোনো তক্ষক পাচার করে কোটি টাকা তো অনেক দূরের কথা, লাক টাকাও পায়নি। কেউ লাখ টাকায় তক্ষক বিক্রি করছে এমন কাউকেও আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটা গ্রুপের মাধ্যমে মিথ্যা গুজব ছাড়ানো হয়। বর্তমানে এটা কমে আসছে। কিছুদিন আগেও এটা বেশি পরিমাণে ছিল।
এটার পেছনে বড় একটি গ্রুপ রয়েছে। তবে এখন বাংলাদেশে অবৈধভাবে এই তক্ষক ধরার প্রবণতা অনেকটা কমে আসছে। মাঝখানে বাংলাদেশে খুব বেশি ধরা শুরু করেছিল। এগুলোও অবৈধভাবে চীনে যায়। ভারত থেকে এগুলো সংগ্রহ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন পোর্টগুলো (বন্দর) ব্যবহার করে ওরা। বিশেষ করে ভারত থেকে হিলি বা জয়পুরহাট উত্তরবঙ্গের কোনো পোর্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলো। তারপর জাহাজে করে মিয়ানমার হয়ে চায়নার দিকে চলে যাবে। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের পোর্টগুলো ব্যবহার করা সহজ। তাই পাচারকারীরা বাংলাদেশের পোর্টগুলোকে বেছে নেয়।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মোট ১৬৭ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী রয়েছে। ‘তক্ষক’ একটি সরীসৃপ প্রাণী। সরীসৃপ অর্থ শীতল রক্তবিশিষ্ট মেরুদণ্ডী প্রাণী, যারা বুকে উপর ভর দিয়ে চলাচল করে। দৈহিক গঠন অনুযায়ী তারা জলে, স্থলে এমনকী গাছ বা দেয়ালে চলাচল করতে সক্ষম। সরীসৃপ প্রাণীরা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকে পরিবেশের উপকারসহ খাদ্যশৃংখলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন-২০১২ (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) এর একটি ধারায় বলা আছে- বন্যপ্রাণী আটক, ধরা, মারা এবং কেনাচেনা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। উক্ত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক (১) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমান অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের পরিচালক জহির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু তক্ষকই বাংলাদেশের মূল্যবান যে কোনো বন্যপ্রাণী পাচারকারী ধরতে আমরা প্রস্তুত। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা মূল্যবান পাখি ও বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিয়েছি।
তক্ষকের ইংরেজি নাম Tokay Gecko এবং বৈজ্ঞানিক নাম Gekko gecko। ঠোঁট থেকে লেজের শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ সেন্টিমিটার। ‘কক্কক’ ‘কক্কক’ শব্দে উচ্চৈঃস্বরে ৫-৭ বার ডাকার পর স্থির হয়ে যায়। কীটপতঙ্গ, ছোট সাপ, টিকটিকি প্রভৃতি তার খাদ্যতালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৯
বিবিবি/এএ