মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের চিত্র এটি। ঠিকমতো খেতে না পাওয়ায় অপুষ্টিতে ভুগছে সব শিশু।
শুধু শিশুরা নয় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন রোহিঙ্গা নারীরাও। বিশেষ করে নবজাতকের মা ও গর্ভবতী নারীদের যে স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রয়োজন তার ছিটোফোঁটাও নেই এদের। ক্ষুধা সঙ্গে যুদ্ধ আর রোগে ভুগে এভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা।
গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তপথের মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ২২টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে। এর মধ্যে উখিয়ার পালংখালীর আনজুমান পাড়া ও সাহেবপাড়া এবং টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে।
উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, মূল ক্যাম্পের পাশে অস্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলেছে নতুনভাবে আসা রোহিঙ্গারা। পাহাড়ের ঢালে, রাস্তার পাশে, জমিতে বাঁশের মাচা আর ত্রিপল দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত বসতি। এসব ঘরে আছে কয়েক হাজার পরিবার।
এসব রোহিঙ্গাদের দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ৫ জনের বেশি শিশু। কোন ঘরে ১০-১২ জন করেও শিশু রয়েছে। এদের অধিকাংশের বয়স আবার ৫ বছরের নিচে। এর মধ্যে আবার এক বছরের নিচের শিশুই বেশি। অনেকের ঘরে রয়েছে ৬-৭ দিনের নবজাতকও।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় হালিমা খাতুনের সঙ্গে। মংডুর ভুদাইশন থেকে ৮ সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট মো. হারেসের বয়স মাত্র ১০ মাস। ওমরের বয়স ২ বছর ও রফিকের ৩। বাকীদের বয়স ৫-১০ বছরের মধ্যে।
হালিমা বলেন, ‘তিনটা এখনো কোলের বাচ্চা। বাকিগুলো একটু বড় হওয়ায় নিজেরা এর-ওর থেকে নিয়ে, ভিক্ষা করে খেতে পারছে। কোলের বাচ্চাগুলোকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারছি না। খেতে না পেরে বাচ্চাগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হারেসের জ্বর-সর্দি-কাশি দেখা দিয়েছে। চিকিৎসাও করাতে পারছি না। নিজেরা যেখানে খেতে পারছি না, ডাক্তার দেখাবো কিভাবে। ’
একই বক্তব্য গুলবাহার, সেতারা বেগমেরও। ভুচিদংয়ের ফাতিয়া থেকে আসা গুলাবাহারের ৪ সন্তান। এর মধ্যে ইব্রাহিমের বয়স ৯ মাস, বাকীদের ৫ এর নিচে। একই এলাকা থেকে আসা সেতারার ৫ সন্তান। ছোট মেয়ে মিনারার বয়স ৮ মাস, বাকীদের ৫ এর নিচে।
দুজনেরই বক্তব্য, ‘বাচ্চাকে বুকের দুধ ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারছি না। নিজেরাই ঠিকমতো থেকে পাচ্ছি না। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চারা শুধু কাঁদছে। ’
ভুচিদংয়ের থামী থেকে ৮ সন্তান নিয়ে আসা মোস্তফা বেগম বলেন, ছোটটার বয়স ৯ মাস। ওখানে সুজি আর কৌটার দুধ খাওয়াতাম। এখন কিছুই খাওয়াতে পারছি না। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চা কাঁদছে। ১৫-১৬ দিন ধরে হেঁটে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে আসার সময় বাচ্চার জ্বর বেঁধে গেছে। ডাক্তারও দেখাতে পারছি না। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবো কিনা জানি না।
ভুচিদং থেকে আসা ৮ সন্তানের জননী মাহমুদা খাতুন (২৫) আবারও সন্তানসম্ভবা। ৯ মাসের গর্ভবতী মাহমুদার কোল জুড়ে যেকোন সময় আসবে নবজাতক। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যে ধরনের স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রয়োজন তা পাচ্ছে না মাহমুদা।
তার স্বামী নুর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, এখানে কোথায় হাসপাতাল, কোথায় ডাক্তার কিছুইতো চিনি না। কিছুদিন আগে অস্বাস্থী স্বাস্থ্য ক্যাম্প এসেছিল। ডাক্তাররা বলেছেন, এ অবস্থায় আপাতত ওকে এভাবে রাখতে। কোথাও নাড়াচাড়া না করতে।
জন্মের দিন রাতেই সদ্যজাত মেয়েকে নিয়ে মংডুর নাসিদং থেকে পালিয়ে এসেছেন সফুরা বেগম। সঙ্গে প্রায় অন্ধ স্বামী এবং আরও ৭ সন্তান। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ৮ সন্তানের মা হওয়া সফুরা পরিবার নিয়ে ঠাঁই পেয়েছেন বালুখালী পাহাড়ে।
সফুরা বলেন, ‘চারদিন হাঁটতে হয়েছে। মেয়ে মাত্র প্রসব হয়েছে। হাঁটতে খুবই কষ্ট হয়েছে। স্বামীর এক চোখ অন্ধ। আরেক চোখেও ভালোভাবে দেখতে পায় না। তবুও চলে এসেছি। '
তবে প্রসূতি হিসেবে বিভিন্ন রোগে ভুগলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন সফুরা। এমনকি তার অন্য সন্তানরাও ভুগছে জ্বরে।
ভুচিদংয়ের হারী থেকে ৮ সন্তান নিয়ে বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন নাসিমা। তিনি বলেন, নিজে গত তিনদিনে একবেলা করে খেয়েছি। বাচ্চা বুকের দুধ পাবে কোত্থকে।
একই ভাষ্য আনোয়ারারও। একই এলাকা থেকে ৬ সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন আনোয়ারা। এর মধ্যে ছোটটার বয়স ৮ মাস। বাকীদের বয়সও ৫ এর নিচে।
রোহিঙ্গা শিশুদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা শিশু যাদের বয়স ১ বছরের নিচে ও নবজাতক বাচ্চাদের তিনটি ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। তাদের শরীরে তাপমাত্রা কমে যাবে, শরীর শীতল হয়ে পড়বে। ওজন কমে যাবে। ফলে মৃত্যু হতে পারে। এজন্য শিশুদের মাথায় টুপি ও হাত-পায়ে মোজা পরিয়ে রাখতে হবে।
তিনদিন ধরে শিশু তার উপযোগী খাবার খেতে না পারলে রক্তের গ্লুকোজ কমে যাবে। অপুষ্টিতে ভুগে খিঁচুনিতে মৃত্যুও হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশান হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে খুব সহজেই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
এছাড়া ১-৫ বছরের শিশু যারা আছে, এরা অপুষ্টিচক্রে পড়ে যাবে। এতে ডায়রিয়া-নিউমোনিয়া-জ্বর-সর্দি-কাশি হবে। তারা মিয়ানমারে চোখের সামনে যে মারধর-খুন দেখেছে, হেঁটে পাহাড় পাড়ি দিয়ে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে যে কষ্ট সহ্য করে এসেছে, এসব দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবন ভুলতে পারবে না। এতে তাদের মনোবৈকল্য দেখা দেবে, মানসিক বিকাশ স্বাভাবিকভাবে হবে না।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম বলেন, যেসব রোহিঙ্গারা এসেছে এদের কোন পরিবার পরিকল্পনা নেই। একেকজনের কমপক্ষে ৫টা করে বাচ্চা। কারও কারও ১০-১২টা করে বাচ্চা। এত শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ঝুঁকির বিষয়। তারপরও সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ক্যাম্প করা হচ্ছে। ৬ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের ওরাল ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের হাম-রুবেলার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এত কষ্টের পর তারা এমনিতেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারপরও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ করা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের কর্মকর্তা সরোয়ার বলেন, আমরা ত্রাণের সঙ্গে শিশুদের জন্য সুজি দিচ্ছি। শিশুদের এমনিতেই খাবার অনেক কম। এজন্য সুজি দিচ্ছি যেন তারা খাদ্যাভাবে না পড়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
আরডিজি/আইএসএ/টিসি
**আরও পড়ুন
রোহিঙ্গাঢলে হুমকির মুখে পর্যটন শিল্প
কত রোহিঙ্গা এসেছে, সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে
সক্রিয় দালালচক্র, পুঁজি রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ
রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪ চেকপোস্ট
‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি
‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
মঙ্গলবারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ছাড়ার আলটিমেটাম
স্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বামীরা