ফুলতলা (খুলনা) ঘুরে: শীতের সন্ধ্যে। গাঁয়ের পথ বলে রাতের নিস্তব্ধতা নেমে গেছে।
ঐতিহ্যবাহী গামছাপল্লী যেতে হবে শুনে ভ্যান চালক গাইডেরই ভূমিকা নিতে উৎসাহবোধ করলেন। ভ্যান রেখে ঢুকে পড়লেন একেবারে সড়ক লাগোয়া একটি বাড়িতে। পা এগোলো তার পিছু পিছু।
এতোক্ষণ রাস্তায় যে নিস্তব্ধতা ছিল, তা এই বাড়িতে ভেঙে চলেছে খটখট খটখট শব্দ। বাড়িটা রোবন ইসলামের। কীসের খটখট শব্দ? কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো-এটা তাঁতকল। গামছা বুননের কাজ চলছে, এই রাতেও। তাঁতকলে সুতো গেঁথে হাতল টেনে টেনে গামছা বুনছিলেন রোবনের স্ত্রী হালিমা বেগম। রোবন এখন আর তাঁতীর কাজ করেন না। করেন হালিমা।
রাতে কেন? হালিমা বললেন, ‘দিনের কাজকর্ম সাইরে (সেরে) বসি। সারাদিনের ফাঁকে ফাঁকেও কাজ চলে। ’
বোঝা গেল, গামছা বুননটা হালিমার কাছে এখন ‘পার্টটাইম’। ফুলতলা বাজারের গামছা চান্দিনায় আবুল কালাম নামে এক খুচরা বিক্রেতা এখানকার গামছাশিল্পের খোঁজখবর জানতে চাইলে তার হতাশার কথা বলতে চান। হালিমার ‘পার্টটাইম’ গামছা বুননের কথাটা বুঝি সেই হতাশাকেই যৌক্তিকতা দিলো।
হালিমার সঙ্গে মাঝে-সাঝে তার শাশুড়ি রহিমাও কাজ করেন গামছা বুননে। প্রথমে বাজার থেকে সুতো কিনে আনেন তারা। এরপর রঙ ও মাড় দিয়ে সেই সুতো রোদে শুকান। সেখান থেকে কিছু সুতা দিয়ে টানা বাঁধেন, কিছু সুতা চরকায় পেঁচিয়ে সেখান থেকে ভিমে বা গুটিতে পেঁচান। তারপরই বোনা শুরু করেন, খটখট খটখট শব্দে।
দিনের বেলায় অন্যকাজ সেরে এ দিন রাতে কেবল চরকা ও গুটিতে পেঁচিয়ে বোনার কাজ করছিলেন হালিমা।
দুই থেকে আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ফুলতলার গামছাগুলোর প্রচুর চাহিদা তৈরি হয় আশির দশকের শুরু থেকে। বাহারি রঙ, নকশা, নিখুঁত বুনন ও মানবৈচিত্র্যের কারণে এ অঞ্চলের গামছার কদর তৈরি হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি বিদেশেও। সেসময় ফুলতলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাঁতকল ছিল। কিন্তু এখন হালিমাদের দামোদর গ্রামে মাত্র ৫০-৬০ পরিবারে গামছা বুননের কাজ হয়। পার্শ্ববর্তী আলকা গ্রামে এমন তাঁতশিল্প বাঁচিয়ে রাখা পরিবার আছে শ’খানেকের মতো।
ফুলতলার গামছার বিশেষ নকশার মধ্যে রয়েছে- ‘ঝুড়ি’, ‘চেক’, ‘ঝালকাঠি’ ও ‘লেডিস’। এখানে বোনা গামছার জমিন এবং পাড়ের রঙ ও নকশার মধ্যে আলাদা বিশেষত্ব হলো, সবক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা রঙ ও নকশার ব্যবহার হয়। সাদা, লাল, হলুদ, খয়েরি, নীলসহ প্রায় সব রঙের সুতো ব্যবহার করা হয় ফুলতলার গামছার নিখুঁত বুননে।
হালিমার সঙ্গে কথা বলে তার রসুঁই ঘর পেরিয়ে পা বাড়ে পাশের সাহিদা খাতুনদের ঘরে। তার স্বামী অন্য পেশায় রয়েছেন, তবে কাজ করেন গামছা বুননেও। তারা দু’জন দুই মেয়েকে নিয়ে দু’টি তাঁতকলে গামছা বোনেন।
টিনের বেড়া ও চালের ঘরের নিচু বারান্দার মতো জায়গায় সাহিদার একটি তাঁতকল রয়েছে। সেখানে কাজ করছিলেন তিনি। আরেকটি তাঁতকল পড়ে আছে পাশেই ঘরের কোণে। সেটা মেরামত করা লাগবে।
সেই নিচু বারান্দায় কুঁজো হয়ে ঢুকতে হলো। এরপর সাহিদার পাশে বসে তার গামছা বোনার গল্প শোনার আগ্রহ দেখালে তিনি বলতে থাকেন, আগের সেই উদ্যম নেই। পুরো আলাপের শেষেও বলেন, ‘বসে না থেকে দুই পয়সা আয় করা যাবে বলেই এই কাজ করছেন। ’ যে কথায় কেবল ‘অভাবের ঠেকায় পড়া’র সুরই বাজে।
এই তাঁতশিল্পীর সঙ্গে আলাপে জানা গেল, সুতো কেনা থেকে শুরু করে পুরো গামছা বুনতে তাদের দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৩ হাত ও প্রস্থে দেড় হাত একটি গামছা বুনে তারা বিক্রি করেন সর্বোচ্চ একশ’ টাকায়। আর দৈর্ঘ্যে ৪ হাত ও প্রস্থে ২ হাত গামছা বিক্রি করেন ১২০-১৩০ টাকায়। প্রত্যেকটি গামছায় তাদের লাভ আসে ৩০-৪০ টাকা। সে হিসাবে তাদের প্রতি শ্রমঘণ্টার মূল্য পড়ছে ১৫-২০ টাকা।
সাহিদারা আবার খুচরা বিক্রি করেন না, মহাজনের কাছ থেকে সুতো কেনেন বা টাকা ধার নেন বলে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের কাছে গামছা দিয়ে দেন। মহাজনের ‘দা এর তলে’ পড়ে না থাকলে বিক্রি করেন ব্যাপারীর কাছে। আড়াইশ’ টাকার মতো খরচের বিপরীতে একথান (প্রত্যেক থানে চারটি করে) ৪০০ টাকা। তাদের প্রতিদিনে তৈরিও হয় ৪টি বা সর্বোচ্চ ৫টি গামছা। এভাবে প্রতিদিনে দেড়শ’ টাকার মতো আয় হলে মাস শেষে সেটা দাঁড়ায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার মতো।
এভাবে কী পোষায়? এমন প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পান না সাহিদা। বলেন, ‘একটা তাঁতকল বানাতেই খরচ পড়ে ৪-৫ হাজার টাকার মতো। আগে সুতোর দাম ছিল কম। এখন সব খরচ বেড়েছে। খালি আমাগের গামছার দাম বাড়ে না। ’
তবে, গামছাশিল্প ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনুৎসাহের এমন অনেক কারণ থাকলেও যে কাজটি করেন, তাতে কোনো ফাঁকফোঁকর রাখেন না ফুলতলার তাঁতশিল্পীরা। যেমন সাহিদা বলছিলেন, ‘এক নাগাড়ে ব্যবহার করতে থাকলে এ গামছা বছরখানেক পর্যন্তও যেতে পারে। আর যত্ন-আত্তি করে ব্যবহার করলে দুই-আড়াই বছল পর্যন্তও টিকে যাবে। ’
সেজন্যই বুঝি ফেরার পথে ভ্যান চালক আবুল হাশেম বলছিলেন, ‘খুলনায় কেউ বেড়াতে এলে এই ফুলতলায় আসেন, উপজেলার দক্ষিণঢিহি গ্রামে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি দেখতে। যাওয়ার সময় প্রায় সবাই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এখানকার গামছাপল্লীতে বোনা গামছা নিয়ে যেতে। ’
তবে দিনে দিনে ফুলতলার এ গামছাশিল্প থেকে কারিগররা দূরে সরে যেতে থাকায় হাশেমের চিন্তা বাড়ে, ‘এ গামছাপল্লীকে বাঁচাবে কে?’
**সবচেয়ে বড় এক গম্বুজের মসজিদ বাগেরহাটে
**বাগেরহাটে মধ্যযুগীয় সড়কের পথ ধরে
**ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!
**শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
**রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
এইচএ/এএ/