২০১৩ সালে দেশে ফেরেন তিনি। সে সময়ই বাংলাদেশ ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন মনে দাগ কাটে তার।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুত ও ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে প্যাকেটজাত মুকুলের অর্গ্যানিক শুঁটকির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। 'পিউরিটি অর্গানিক ড্রাই ফিশ' নামে এ শুঁটকি বর্তমানে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিওএফপি) ছাড়াও আমেরিকা ও কানাডাতেও রপ্তানি হচ্ছে। সব খরচ মিটিয়ে এ থেকেই মাসে ২ লাখ টাকারও বেশি আয় করছেন মোকাদ্দেছুর রহমান মুকুল।
এরই মাঝে এ খাতে সফলতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক, এনএ বাংলাদেশ'র শ্রেষ্ঠ কৃষি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন মুকুল। স্বল্প আয়ের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে কাজ করা স্বীকৃতিস্বরূপ তাকেসহ দেশের ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রূপসী বাংলা বলরুমে এক অনুষ্ঠানে অন্যদের সঙ্গে মুকুলের হাতে পুরস্কারের চেক, সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
অর্গ্যানিক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেন, সচরাচর পচনরোধে শুঁটকিতে কীটনাশক ও ওজন বাড়াতে লবণ ও বালু ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পিউরিটির শুঁটকিতে এসব করা হয় না। শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে আমরা কেবলমাত্র সূর্যের তাপে শুঁটকি উৎপাদন করি। এসময় শুঁটকির চাংগুলো প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা থাকায় মশা-মাছিও বসতে পারে না। 'শুকানোর পর আমাদের শুঁটকি উন্নত প্রযুক্তির ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে প্যাকেটজাত করা হয়। প্যাকেটের সময় ভেতরে অক্সিজেন থাকলে পোকা বা জীবাণু জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু পিউরিটির শুটকিতে সে ঝুঁকি নেই। এছাড়া এতে করে শুঁটকি দীর্ঘদিন সতেজও থাকে। আমাদের এ কাজে কারিগরী সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। '
একই প্রসঙ্গে মুকুল আরও বলেন, সাধারণভাবে তৈরি শুঁটকিগুলো বেশিরভাগ সময়ই নাড়িভুঁড়িসহ শুকানো হয়। কিন্তু অর্গ্যানিক শুঁটকিতে নাড়িভুঁড়ি, লেজ, মাথাসহ খাওয়ার অনুপযোগী সব কিছু ফেলে দেওয়া হয়। নাড়িভুঁড়ি না ফেললে মাছের বিষাক্ত পিত্তও শুঁটিকিতে থেকে যায় বলে জানান তিনি। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিজ্ঞানসম্মতভাবে গড়ে তোলা মুকুলের ড্রাইফিশ কেন্দ্রে বর্তমানে প্রতি মাসে ৩০ হাজার কেজির মতো শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। এখানে কাজ করেন ৩০ জন শ্রমিক।
মাছ সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ প্রসঙ্গে তরুণ এ উদ্যোক্তা বলেন, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট থেকে বিভিন্ন সামুদ্রিক কাঁচা মাছ সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে তাঁর থেকে জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা প্রতি মাসে ছয় থেকে আট হাজার কেজি শুঁটকি সংগ্রহ করে। সেসব শুঁটকি কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এছাড়া আমেরিকা ও কানাডার দুজন বায়ার কাছে প্রতি মাসে রপ্তানি করা হয় প্রায় ছয় হাজার কেজি। বাদবাকি শুঁটকি যায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রতিষ্ঠানে।
নাড়িভুঁড়িসহ খাওয়ার অনুপযোগী সব কিছু ফেলে দিয়ে অর্গ্যানিক উপায়ে উৎপাদন করা হয় বলে এ শুটকির দাম কিছুটা বেশি। সাধারণ উপায়ে উৎপাদিত এক কেজি ছুরি মাছের শুঁটকির দাম আটশ' টাকা হলে এক্ষেত্রে দাম পড়ে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১৬শ' টাকা। প্রতি কেজি লইট্টা ২ হাজার, মলা ১ হাজার ও লাখ্যা মাছের শুঁটকির দাম পড়ে ৪ হাজার ৮০০ টাকার মতো।
দামের ব্যাপারে এ উদ্যোক্তা বলেন, আমাদের ২০০ গ্রামের একটি ছোট লইট্টার প্যাকেটেই ৪০ থেকে ৪২টি মাছ ধরে, অন্যদিকে সাধারণভাবে উৎপাদিত লইট্টার ৫০০ গ্রামের বড় প্যাকেটেও ধরে একই সাইজের ৪০ থেকে ৪৫টি শুঁটকি। প্রায় সব মাছের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে। ফলে হিসেব মেলালে দামেও খুব একটা তারতম্য থাকে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আমাদের শুঁটকি নিরাপদ।
অর্গ্যানিক শুঁটকিখাতে কাজ করে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে মুকুল বলেন, শিক্ষিত লোকজন সাধারণত এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে আগ্রহী নয়। কিন্তু, তারা বেশি বেশি এগিয়ে এলে দ্রুত এ শিল্পের প্রসার ঘটবে। তরুণদের এসব নিয়ে ভাবার আহ্বান জানান তিনি।
কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী ও সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এহেসানুল করিম মুকুলের অর্গ্যানিক শুঁটকি উৎপাদন ও এ খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের শিক্ষিত লোকজন এগিয়ে এলে যে কোনো কাজে সফলতা বাড়ে। তাদের সহযোগিতা নিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে মুকুল অর্গ্যানিক শুঁটকি উৎপাদন করছেন। তাঁর শুঁটকির প্যাকেটের গায়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কারিগরী সহযোগীতার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
আরও কেউ এ ধরনের প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহী হলে এ প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার ব্যাপারে প্রস্তুত বলে জানান দুই কর্মকর্তা। তারা বলেন, এক সময় কক্সবাজারে শুধুমাত্র মুকুলই এভাবে শুঁটকি উৎপাদন করতেন। কিন্তু বর্তমানে নতুন করে আরও একজন এ কাজে নেমেছেন। আমরা সবাইকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। আমরা চাই বেশি বেশি উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা,অক্টোবর ০৫, ২০১৯
এসবি/এইচজে