এবার প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে সবকিছুই স্থবির হয়ে গেছে। করোনা মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে বৈশাখী অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বছরের দু'টি বড় উৎসব ঈদ ও পহেলা বৈশাখ। এ সময়ে পোশাকের কেনাবেচা জমে ওঠে। ফলে সারা বছরই এ দু'টি উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে বিভিন্ন প্রস্তুতি। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সব বন্ধ হয়ে গেছে। বৈশাখী বাণিজ্য এবার শেষ। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে পহেলা বৈশাখের পর ঈদ বাণিজ্যেও বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বৈশাখের বাজারে করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা। কারণ এ সময় সারা দেশের বাজারে এসএমই খাতের ব্যবসায়ীদের পণ্যই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
এজন্য সরকারের সহায়তায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে যেন অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত খাত যেমন বৈশাখসহ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের যেন সরকার অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জানা গেছে, গতবারের চেয়ে এবার ব্যবসার ২০ শতাংশ বেশি প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু ভেস্তে গেছে। পহেলা বৈশাখের সঙ্গে হালখাতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হালখাতায় ক্রেতা ও গ্রাহকদের মিষ্টি-নিমকি খাওয়ান ব্যবসায়ীরা। আধুনিক যুগে হালখাতা উৎসবের জৌলুস অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও মিষ্টি খাওয়ানোর প্রচলনটা অনেকেই ধরে রেখেছেন। সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের গ্রাহকদের নববর্ষের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে মিষ্টিকে রাখেন সবার ওপরে। ফলে পহেলা বৈশাখে মিষ্টির দোকানের ব্যবসা অন্য সময়ের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সবমিলে সারা বছরে যে পরিমাণ মিষ্টি বিক্রি হয়, তার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি পহেলা বৈশাখে বিক্রি হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ফলে নগরবাসীর মধ্যে ইলিশ কেনার এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। বাড়তি ইলিশের জোগান দিতে দেড়-দুই মাস আগে থেকে মাছ মজুদ করেন ব্যবসায়ীরা। তারপরও মাছটির দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। এবারও সে রকম প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। কিন্তু এখানেও পড়েছে সেই করোনার আঘাত।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দেশীয় পণ্যের ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব বিনিয়োগ হয়ে থাকে পহেলা বৈশাখে। এ বছর প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসেরকারণে বর্ষবরণ উৎসব বন্ধসহ মার্কেট-দোকানপাট বন্ধ থাকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে মাল তৈরি হয় সেটা অন্য সময় বিক্রি হয় না। এক বছর পরে আর এ পণ্যের চাহিদা থাকে না।
করোনা ভাইরাস এবার বৈশাখ কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অনেক ব্যবসায়ী এবার পথে বসে যাবে। তাই এ অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে সামলে উঠবেন সে চিন্তাতেই দিশেহারা ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, কতো টাকার ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। কারণ এর প্রভাব আরো কতো দিন থাকে তা বলা যাচ্ছে না। তবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের সব খাত মিলিয়ে অন্যান্য বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। এ বছর আমাদের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। সেটা বেচাকেনা করতে পারলে আমাদের ব্যবসা হতো ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। তবে আমরা সেটা বলবো না যেহেতু বিনিয়োগ করেছি ১৫ হাজার কোটি টাকা। তাই আমাদের ক্ষতি ১৫ হাজার কোটি টাকাই বলবো।
হেলাল উদ্দিন বলেন, সব ব্যবসাই বন্ধ। এ করোনা পরিস্থিতিতে এখন আর ব্যবসার কথা চিন্তা করা যাবে না, জীবন বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে। তবে এ ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকার যে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেট ঘোষণা করেছে সেখান থেকে ১৫ জন থেকে তার নিচে যে সব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তাদের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি। কারণ এ মুহূর্তে আমাদের দোকানপাট বন্ধ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারছি না। আমরা ক্যাশ টাকায় ব্যবসা করি। এ ঋণ পেলে আমরা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবো।
ফ্যাশন এন্টারপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সভাপতি মো. শাহীন আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, করোনার কারণে মার্চের শুরুর দিকে বেচাবিক্রি কমে যায়। এরপর প্রায় ৩০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার ফলে বৈশাখি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে দেশীয় পোশাকশিল্প প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, করোনা ভাইরাস শুধু দেশের নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বৈশাখ আমাদের একটি বড় উৎসব। এটা এবার বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ এ উৎসবে আমাদের বিক্রি থাকবে শূন্যের কোটায়। তাই আমরা বার্ষিক বিক্রির যে টার্গেট নিয়েছি সেটা এবার পূরণ হবে না। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আমরা কর্মপন্থা নির্ধারণ করছি। এ জন্য সেফটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন বা এক মাসে যদি এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে এ ক’দিনে যে ক্ষতি হবে এটা হয়তো দু-এক বছরে পুষিয়ে নেয়া যাবে। তবে যদি বর্তমান অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি থাকে তাহলে আমাদের জন্য সামনে কঠিন সময় আসবে।
এ বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মৌসুম কেন্দ্রিক। সারা বছর অব্যাহত ব্যবসা খুব সীমিত ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে পারে। সেদিক থেকে আমাদের উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতির মধ্যে বৈশাখ হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। করোনার কারণে বৈশাখ কেন্দ্রিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যতো ধরনের কর্মকাণ্ড আছে সেখানে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটা অবধারিত। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো যারা বৈশাখ নির্ভর ব্যবসা করে থাকে। যাদের বছরের অন্য সময়ে ব্যবসা খুব সীমিত তাদের ওপর প্রভাবটা আরো বেশি পড়বে।
তিনি বলেন, এ করোনা প্রভাব কাটাতে আমাদের নীতি প্রণেতাদের সে জায়গায় নজর দিতে হবে। তারা যেন সবধরনের ব্যবসাকে সমভাবে বিবেচনায় না নেয়। করোনা সংশ্লিষ্ট কারণে এ সময়ে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা যেমন বৈশাখ এরপর হয়তো ঈদ আসতে যাচ্ছে সেটাতেও প্রভাব পড়তে পারে। তাই মৌসুমি ব্যবসাগুলোকে আলাদা বিবেচনায় নিয়ে সহায়তা করতে হবে। এজন্য সরকার সাড়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ আছে। আমরা প্রত্যাশা করবো বরাদ্দের ক্ষেত্রে যেন অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত খাত যেমন বৈশাখসহ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের যেন সরকার অগ্রাধিকার দেয়।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশাখ কেন্দ্রিক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তা। তারা এককভাবে একটা ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। সরকার সহায়তার ক্ষেত্রে যেন ঢালাওভাবে বিবেচনায় না নিয়ে এ ধরনের সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা নির্বাচন করে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে যে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে অবশ্যই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে ব্যাংকগুলো যেন এ ঋণ দেয়। সর্বশেষ সামনে যে বাজেট আছে সেখানে এসব উদ্যোক্তাদের কিছু রাজস্ব সুবিধা দেয়া যেতে পারে। যেমন তাদের জন্য যে ভ্যাট ট্যাক্স আছে এ সময় কালের ( মার্চ থেকে জুন) জন্য মওকুফ করা যেতে পারে। একইসঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ট্যাক্স এক্সেজের যে লিমিট আছে সেটা ৫০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত করা যায় তাহলে তারা ক্ষতিটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুরকি, নাড়ু বাজারেই বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখি বাজারে।
তাছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বৈশাখে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলে বৈশাখে কেবল পোশাক বিক্রিই হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। বৈশাখি উৎসব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। বাজারে বাড়ে টাকার প্রবাহ। চাঙ্গা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত জোগান রাখে। প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও লেনদেন বাড়ে।
অন্যদিকে গত দুই বছর ধরে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সারা দেশে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে। এ বছর সেটি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আগ পর্যন্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভালোই ছিল। সেজন্য এবারের বৈশাখ বাজারে সবধরনের পণ্য বিক্রি হতো আরও বেশি। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো করে দিলাে করোনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২০
জিসিজি/আরবি