ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

পুরান ঢাকায় হালখাতা বন্ধে অনিশ্চয়তায় ১০ হাজার কোটি টাকা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২০
পুরান ঢাকায় হালখাতা বন্ধে অনিশ্চয়তায় ১০ হাজার কোটি টাকা

ঢাকা: আজ মঙ্গলবার, ১ বৈশাখ, ১৪২৭। নববর্ষের শুরুতেই হয় ‘হালখাতা’। পুরোনো হিসেব চুকিয়ে শুরু হয় ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার পালা। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলে আসছে। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনার হুমকিতে এ বছর সেই ঐতিহ্যে ছেদ পড়লো। বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম নববর্ষের দিন হালখাতা উদযাপিত হলো না। 

নববর্ষ ঘিরে বরাবরই রঙিন হয়ে ওঠে পুরান ঢাকা। কিন্তু এবারে তা হয়নি।

কোথাও নেই ঢাক, ঢোল আর বাঁশির শব্দ। মানুষের মধ্যে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য নেই। হালখাতা উৎসব ঘিরে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের বড় বড় সব বকেয়া আদায় হতো। এবারে সেই হালখাতা অনুষ্ঠান না হওয়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার অনিশ্চয়তায় পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।  

পুরান ঢাকার তাঁতী বাজার এবং শাঁখারি বাজারের জুয়েলার্স ও অলংকার তৈরির কারখানা, শ্যাম বাজার, চক বাজার ও মৌলভী বাজারের আড়ত এবং ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানগুলোতে প্রতিবছরই হালখাতা হয়। কিন্তু, এ বছর কোথাও এ উৎসব হচ্ছে না। কোনো ব্যবসায়ীই পয়লা বৈশাখ ঘিরে এবারে ক্রেতাদের হালখাতার নিমন্ত্রণ জানায়নি। এবারে দেখা যায়নি ফুলে ফুলে সাজানো দোকান, আমন্ত্রিতদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করার দৃশ্য। প্রতিটি মার্কেটের প্রায় সব দোকানই ছিল বন্ধ।  

সংশ্লিষ্ট ব্যাবসায়ীরা জানান, এবারে হালখাতা ঘিরে বস্ত্রখাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আদায় হতো। এছাড়া  স্বর্ণ, কাঁচা বাজার, মুদিপণ্য ও মিষ্টি ব্যবসায়ীদের বকেয়া আদায় হতো আরও ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্ত, হালখাতা না হওয়ায় তাদের এই বিপুল অংকের টাকা এক ধরনের অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি দিলীপ কুমার আগরওয়াল বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর দেশের কোথাও কোনো জুয়েলারিতে হালখাতার অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আমার ৪৫ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম। আমাদের অবশ্যই ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে। এটা মেনে নিতে হবে। আমাদের পহেলা বৈশাখে ক্ষতির পরিমাণটা এখনও হিসাব করা যায় নি। তবে, ধারণা করি মোট ব্যবসার ৫০ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে ব্যবসায়ীরা। করোনা ভাইরাসের জন্য দেশের সব জুয়েলারি দোকান বন্ধ আছে। আমরা এটা মানুষকে বোঝাচ্ছি যে, এখন আমাদের সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে ও বেঁচে থাকতে হবে।

তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের জুয়েলারি কর্মীরা যাতে বেতন ও উৎসব ভাতা পায় সেই ব্যবস্থা করেছি। আমি নিশ্চিত করেছি, সব জুয়েলারি মালিক যেন কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে সেখানে যেন জুয়েলারি খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাজুস সভাপতি বলেন, আমরা এখন ডিজিটাল ক্যাম্পেইন করছি, যাতে মানুষ ঘরে বসে কেনাকাটা করতে পারে। এতে করে ক্রেতারা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দিতে পারবে। যখন দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হবে তখন হোম ডেলিভারি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম সজল বাংলানিউজকে বলেন, ইসলামপুরে কাপড় কিনতে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন। পহেলা বৈশাখ ও রোজার সময়ই তাদের আনাগোনা বেশি থাকে। তাই অধিকাংশ বকেয়া ওই সময়ই আদায় হয়। তবে এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে কোথাও হালখাতা অনুষ্ঠান করবেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে এবারে বকেয়া আদায় আর হলো না। গত ৪৫ বছর ধরে ব্যবসা করি, এ বছরের মতো পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি। আমার ধারণা, এ বছর আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা। আমাদের ব্যবসায়ীরা সারা বছর ব্যবসা করে, কিন্তু বেশিরভাগই বাকিতে। সবাই হালখাতার এই দিনের অপেক্ষায় আশায় বুক বেধে থাকে, কারণ এই দিনই ব্যবসায়ীরা বকেয়া পরিশোধ করে নতুন হিসাব খুলবে। যেহেতু এ বছর হালখাতা হলো না, আমাদের বকেয়া টাকাগুলো পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে গেল।

তাঁতীবাজারের শম্ভুনাথ সোনারু বুলিয়ন ভাণ্ডারের শ্যামল সিং বাংলানিউজকে জানান, সারা বছর ধরে এ মাসটির জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করেন তারা। কাস্টমার তাদের লক্ষ্মী। সারা বছর যারা বকেয়ায় স্বর্ণালঙ্কার কেনেন, তারা পয়লা বৈশাখে প্রায় সব টাকা পরিশোধ করেন।  

শম্ভুনাথ বলেন, প্রতি বছর কার্ড ছাপিয়ে ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে আমরা হালখাতা করে থাকি। এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যবসাবাণিজ্যসহ সবকিছু বন্ধ। আজ তাঁতি বাজার, শাঁখারি বাজার, ইসলামপুরের কোথাও হালখাতা হচ্ছে না। এ উপলক্ষে কোনো দোকানপাট সাজানো হয়নি। সকাল ১০টা বাজে কেউ দোকান খোলেনি। অন্যান্য বছরগুলোতে ভোর থেকেই দোকানগুলো নতুন বছর ঘিরে নতুন সাজে সেজে ওঠে।

‘তাঁতী বাজার, শাঁখারী বাজার ও ইসলামপুরে কয়েক হাজার অলংকার তৈরির কারখানা আছে। জুয়েলার্সের সংখ্যা হবে শ’দুয়েক। এ ছাড়া সোনা বেচা-কেনা, বন্ধকি ও অলংকার তৈরির সরঞ্জাম বিক্রির দোকান আছে ৬শ’ থেকে ৭শ’। সব মিলিয়ে ব্যবসার ক্ষতি কী পরিমাণ হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে ধারণা থেকে একুটু বলতে পরবো স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে।

শাঁখারি বাজারের শোলা কারিগর স্বাধীন সুর জানান, তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে শোলা দিয়ে মঞ্চ তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের নকশা ও লেখালেখির কাজ করে আসছেন। পহেলা বৈশাখ ঘিরে মাসব্যাপী শোলার বোর্ডে ‘শুভ হালখাতা’সহ বিভিন্ন লেখা লিখতেই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকেও তার করা কাজ কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু, এ বছর এসবের কিছুই হয়নি। কোনো ব্যবসা নেই। গত ১৫-১৬ দিন ধরে তার দোকানপাট বন্ধ।  

বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ১১৫টির মতো জুয়েলারি দোকান আছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, এবার বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে কোনো হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। অন্যান্য বছরগুলোয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কম-বেশি হালখাতার আয়োজন করলেও, এ বছর করোনা ভাইরাসের জন্য সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিবছর এখানে চার থেকে পাঁচ হাজার ক্রেতাকে আপ্যায়নের প্রস্তুতি থাকে, কিন্তু এবারে একটি দোকানও খোলা হয়নি। ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর মার্কেট জুড়ে এখন হাহাকার।  

শ্যাম বাজারের হৃদয় ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম খান জানান, শ্যাম বাজারে বৈশাখের আলাদা আমেজ থাকে। দুই সপ্তাহ আগে থেকেই এ বাজারে শুভ হালখাতা শুরু হয়ে যায়। তবে পহেলা বৈশাখের দিন বড় করে অনুষ্ঠান হলেও এ বছর কিছুই হচ্ছে না। করোনা ভাইরাসের জন্য সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছি। এর ফলে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে, কারণ, এ দিন যে টাকা আদায় হতো, বছরের অন্য সময়ে তা হয় না।

তিনি বলেন, শ্যামবাজারে প্রায় ৫শ’ দোকান রয়েছে। এ বাজারে কৃষি ও কাঁচাবাজারের মালামাল বেশি। এক একজন ক্রেতা হালখাতা ঘিরে ৫ লাখ থেকে শুরু করে আড়াই-তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধ করেন। এবার অনুষ্ঠান না হওয়ায় কিছুই আদায় হবে না। করোনায় মানুষের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, কারো কাছে আমরা পাওনা টাকা চাইতে পারবো না। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমাদের অন্তত ৩-৪ বছর লেগে যাবে।

চকবাজারের ব্যবসায়ীদের মুখেও একই কথা শোনা যায়। তারা জানান, করোনার কারণে এ বছর কোনো হালখাতার আয়োজন করা হচ্ছে না। গত ১৭ দিন ধরে মার্কেট প্রায় বন্ধ রয়েছে। মুদির খুচরা ও পাইকারি দোকান খোলা থাকলেও দুপুর ২টার মধ্য সব বন্ধ করে দিতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা করার আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে। এ জন্য আমরা সরকারের নির্দেশ মতো কোনো ধরনের হালখাতা আয়োজন করছি না। যদিও এটা আমাদের পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্য। ছোট থেকে বাপ-দাদাদের এই হালখাতা আয়োজন করে আসতে দেখছি। এ বছর করতে পারছি না, মন তো খারাপ হবেই। আমরা ব্যবসায়ীরা এ দিনটার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি। এ দিন আমাদের বকেয়া আদায় হয় সবচেয়ে বেশি।
সূত্রাপরের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের কালীপদ ঘোষ জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমার দোকানে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি তৈরি করে থাকি। এগুলো বছরের অন্য সময় তৈরি হয় না। এদিন আমার দোকানে অন্তত ১০ মণ মিষ্টি খুচরা বিক্রি হয়। অর্ডার থাকে আরো ১০ থেকে ১৫ মণ মিষ্টির। এর সাথে দইও বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ মণ। এ বছর কিছুই হয়নি। করোনার কারণে দোকানই খুলতে পারছি না, আর হালখাতা। বেঁচে থাকলে আগামী বছর হালখাতা করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২০
জিসিজি/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।